×

সাময়িকী

নবী স্যার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৩৩ পিএম

নবী স্যার

ছবির বাজারের খবর আমি তত রাখি না। শুনি নবী স্যারের পেইন্টিং নাকি অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রি হয়। হওয়ারই কথা। শুনি এই সুযোগটা নেয় অসাধু কিছু ছবির কারবারিও।

নবী স্যারকে নিয়ে একটা লেখা লিখছি, পান্থ।’ ‘কী লিখছেন দাদা? গল্প উপন্যাস?’ ‘উপন্যাস। ছোটদের উপন্যাস। নবী স্যার, টোকাই আর কিছু কাক ছাড়া কোনো চরিত্র থাকছে না। এখনও আসে নাই আর কি।’ ‘খুব ভালো। লিখেন। পড়ব।’ ‘হ্যাঁ, পড়বেন।’ ‘নবী স্যারের সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা কবে দাদা?’ ‘ইন্টারভিউ বোর্ডে।’ ‘ইন্টারভিউ বোর্ডে! বুঝতে পারলাম না। আপনি কি কখনো ইন্টারভিউ দিয়েছেন?’ ‘দেবো না! আমি কি ভিনগ্রহের মানুষ? চারুকলায় যখন ভর্তি হলাম ইন্টারভিউ দিতে হয়নি? নবী স্যার ছিলেন আমাদের ইন্টারভিউ বোর্ডে। ইংলিশ ম্যাডাম ছিলেন। আর একজন কে ছিলেন মনে নাই।’ ‘নবী স্যারের সঙ্গে তখন আপনার কথা হয়েছিল?’ ‘কথা হবে কেন, ইন্টারভিউ তো! স্যার একটা প্রশ্ন করেছিলেন। আমি উত্তর দিয়েছিলাম। একটাই প্রশ্ন।’ ‘কী প্রশ্ন দাদা?’ ‘সেটা আমি বলব না, পান্থ। প্রশ্নটা আমার মনে আছে। কিন্তু বলব না। গোপনীয় কোনো বিষয় না, কিন্তু মানুষ কখনো কখনো কিছু স্মৃতিকে আগলে রাখে, আর কাউকে শেয়ার করে না, সেরকম।’ পান্থ লেখক। আমার কথা বুঝল। আরেকদিন হয়তো এরকম হবে, পান্থকে আমি বলে দেব, নবী স্যার ইন্টারভিউ বোর্ডে আমাকে কী প্রশ্ন করেছিলেন। আপাতত থাক আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির গোপনীয়তা। কবুল করেছি, ছোটদের উপন্যাস লিখছি। নবী স্যার, টোকাই এবং কিছু কাক নিয়ে। কেন? এক কথায় বলি, নবী স্যার আমার সবচেয়ে প্রিয় আর্টিস্ট বলে। পেইন্টিং, জল রং, উডকাট, ইলাস্ট্রেশন, নবী স্যারের সব ধরনের কাজই আমার প্রিয়। উডকাটের ‘ঘোড়া’, ‘কবি’, কি কখনো ভুলবার? মজা করে একটা কথা বলি আড্ডায়, ‘ভিনচি এনজেলোদের রেনেসাঁ যুগের শেষ শিল্পী হলেন রফিকুন নবী।’ মজা করে বলি তবে নিছক মজা তো না, একটা বিশ্বাসেরও সারাংশ এটা। এই লেখা লিখছি আর মনে করে যাচ্ছি নবী স্যারের কিছু আশ্চর্য জল রং। মোষের পালের মতো মেঘ, মেঘের পালের মতো মোষ, জলরঙে এমন কে আঁকেন আর? রজতের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। রজত আর্টিস্ট। বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ করে। ‘গোলাপ ফোটে খুকীর হাতে- বইটা কখনো দেখেছো, রজত?’ ‘না, দাদা।’ ‘শামসুর রাহমানের ছড়ার বই। শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত আবার মুদ্রণ হয়েছে। দেখে নিও। নবী স্যারের কাজ। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না কী জিনিস! আমার দেখা বাংলাদেশের সেরা ছোটদের বই এটা।’

রজত শুধু না, অনুজপ্রতীম যারা, বইয়ের প্রচ্ছদ অলংকরণ করে, সকলকে বলি, নবী স্যারের প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ দেখে পাঠ নিতে। টোকাই তো আছেই, টানটোনে টোকাই, কাক, ডাস্টবিন, আঁকা কি খুব সহজ? বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়কর এক অলংকরণ শিল্পী হলেন নবী স্যার। আর বলি, নবী স্যার যে এত বইয়ের প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ করেছেন, আমার মনে হয় এ নেহাতই ভালোবাসা তাঁর। বইয়ের জন্য, সাহিত্যের জন্য ভালোবাসা। না হলে এই মানুষটা বইয়ের ছবি কেন আঁকবেন? না আঁকলে তো তাঁর চলতো। এমনকি ‘টোকাই’ না আঁকলেও চলতো। অথচ এক টোকাই এঁকেই সমধিক প্রসিদ্ধ তিনি। আমজনতার রনবী হয়ে আছেন কবে।

আমি বইয়ের জগতের মানুষ। নবী স্যারের আঁকা আরো দুয়েকটা প্রচ্ছদ অলংকরণের কথা বলি। মহাশ্বেতা দেবীর একটা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। শাহাদাত চৌধুরী সম্পাদিত ‘বিচিত্রা’ ম্যাগাজিনের এক ঈদসংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ‘বীরসা মুণ্ডার তীর’ সম্ভবত। নবী স্যারের ড্রয়িং, গা ছমছম করে এখনো। এখলাস উদ্দিন আহমদের ‘তুনু ও কেঁদো বাঘের গপ্পো।’ আহ! এমন বাঘ যদি আমরা আঁকতে পারতাম রে! চারুলিপি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত ‘শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পসমগ্র’। শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প যারা আগেভাগে পড়েছেন শৈল চক্রবর্তীকে তারা ভুলবেন না। রোয়ান্ড ডাল-কুইন্টিন ব্ল্যাকের মতো ছিলেন দুজন। শিবরাম-শৈল। শিবরাম গল্প লিখতেন, শৈল সেসব গল্পের অলংকরণ করতেন। রাজযোটক। শিবরাম যদি তাঁর গল্পের সঙ্গে নবী স্যারের অলংকরণ দেখতেন, তাহলে কী হতো তাই ভাবি!

পুরান ঢাকার মানুষ নবী স্যার। পুরান ঢাকায় বড় হয়েছেন। প্রতীক প্রকাশনা প্রকাশিত শামসুজ্জামান খানের ‘ঢাকাইয়া রঙ্গ রসিকতা’ বইয়ের অলংকরণ কি এক ধরনের স্মৃতিতর্পণ নবী স্যারের? নস্টালজিয়া? ড্রয়িংগুলো দেখলে তাই মনে হয়। সেই পুরান ঢাকা আর নাই। সেই পুরান মানুষরা নাই। তবে নবী স্যারের জলজিয়ন্ত ড্রয়িং, টানটোনে থেকে গেছেন তারা। এমন আরো কত অলংকরণ, কত প্রচ্ছদ! আবারো বলি এসব খণ্ডাংশ মাত্র, নবী স্যারের বিচিত্র ভুবনের। বিচিত্র মানে কতটা বিচিত্র? কিছু খোঁজখবর আমি জানি। নবী স্যারের আত্মজৈবনিক রচনা, নিকটজনের স্মৃতিচারণ এবং আরো কিছু সূত্র থেকে জেনেছি। সেসব শেয়ার দিতে যাচ্ছি না, আফসোসের কথা বলি একটা, নবী স্যার, রফিকুন নবী, রনবী, তাঁকে নিয়ে যতটা চর্চা হওয়া উচিত, ততটা কি আমরা করি? নাকি করেছি? এটা খুব মনে লাগে। ‘মাস্টার’ একজন আর্টিস্টকে দেখছি কিন্তু তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন করার মতো শিক্ষিত-সমঝদার আমরা এখনো হয়ে উঠতে পারি নাই। এটা অন্যায়। ন্যায় হোক। আমাদের দেখার চোখ খুলুক। তাতে আমাদেরই ভালো হবে।

আর্টিস্ট নবী স্যারের কথা শুধু বলছি, তিনি সক্রিয় আরো সৃষ্টিশীলতায়। ফিকশন লিখেন ছোটদের, বড়দের। আত্মজৈবনিক রচনা লিখেন। ছড়া লিখেন। তার টানটোনের মতো স্বাদু সেসবও। নিবিড় চর্চা হোক এই মানুষটাকে নিয়ে। হবে। তিনি নিজে অবশ্য কখনই বলবেন না, সে আর কবে? কেউ তাকে নিয়ে চর্চা করল কি না করল, কী যায় আসে রফিকুন নবীর? কেউ চর্চা করলেও তিনি, না চর্চা করলেও তিনি, একজনই, রফিকুন নবী।

ছবির বাজারের খবর আমি তত রাখি না। শুনি নবী স্যারের পেইন্টিং নাকি অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রি হয়। হওয়ারই কথা। শুনি এই সুযোগটা নেয় অসাধু কিছু ছবির কারবারিও। নবী স্যারের কাজ কপি করে অরিজিন্যাল বলে চালায়। অবসান হোক এসবের। আবার শুনি, এসব নিয়ে নবী স্যার নাকি মোটেও মাথা ঘামান না। এমনই হওয়ার কথা। তিনি নবী স্যার, এই ২৮ নভেম্বর ৭৬তম জন্মবার্ষিকী গেল তাঁর। এই উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে আমার যা মনে আসে কিছু লিখলাম। কোনোভাবে স্যার কি এই লেখাটা পড়বেন? পড়লে হাসবেন হয়তো, ‘তুমি দেখি সিনিয়র টোকাই হে!’ প্রণাম স্যার। শুভ জন্মদিন!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App