×

সাময়িকী

জয় হোক রনবীর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৩৩ পিএম

জয় হোক রনবীর

আরেক মহৎ ও বড় শিল্পী রফিকুন নবী। তেলরং, জলরং, কাঠ খোদাই সব মাধ্যমেই শীর্ষ সাফল্য। সারাজীবন আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন। এখনো তিনি জড়িয়ে আছেন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে। এখন তার পক্বকেশ। সত্তর ঊর্ধ্ব যুবা। সারাক্ষণ ছবি আঁকেন। সারাক্ষণ আড্ডা। মজার মজার কথা। হালকা রসিকতা। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা এক দুর্দান্ত শিল্পী। সেদিন গ্যালারি চিত্রকে দেখা। নবী স্যার কেমন আছেন? আর থাকা, মিয়া এক পাও তো কবরে। এক চোখে দেখি না। ছবি আঁকতে গেলে আঙুল কাঁপে। বইয়ের কাজ করা তাই ছাইড়া দিছি। এখন বড় ছবি আঁকি। সেসব ছবিতে হাত কাঁপন বোঝা যায় না। নিজে হাসেন না। আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। তার ছবির নিজস্ব সুর আছে। ড্রইং-এ জাদু জানেন। বাস্তবধর্মী ছবি আঁকায় তার তুলনা নাই। টোকাই ছবি এঁকে একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। অনুপম চরিত্র। যে রাস্তায় থাকে। ডাস্টবিনের পাশে যে কথা বলে, টীকা-টিপ্পনী কাটে। আর তাতেই পুরো সমাজ কিংবা পুরো দেশটা উঠে আসে। এই লেখায় টোকাইয়ের মহিমা কিংবা রফিকুন নবীর শিল্প সাফল্যের আলোচনা নয়। বরং তার কিছু বয়ান লিপিবদ্ধ করা যায় কিনা সেই চেষ্টা করি। জাতীয় কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে তিনি এসেছেন অতিথি হয়ে। মঞ্চে বসেছেন। ফেব্রুয়ারির হালকা শীত। গলায় মাফলার। পুরু কাপড়ের ব্লেজার। মঞ্চে কষ্ট করে আসনপিঁড়ি হয়ে তিনি বসলেন। শিল্পী মানুষ। কোনো এক তরুণ কবি অটোগ্রাফের জন্য একটা খাতা বাড়িয়ে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন রফিকুন নবী। বললেন ভরাট কণ্ঠে, আমারে এত বোকা পাওনি মিয়া। ছবি আঁকুম আর মঞ্চে কামরুল ভাইয়ের মতো মইরা যামু। সেইটা হইবো না। শুধু সই কইরা দিলাম। যাও। কিছুদিন আগে চ্যানেল আইতে আসেন রফিকুন নবী। তার সদ্য প্রকাশিত ছড়ার বইটা আমাদের উপহার দিবেন। তাই তার আগমন। তার মতো ব্যক্তির পক্ষেই এমন শিশু আচরণ প্রত্যাশিত। আমি বিনয়ের সাথে বললাম, নবী ভাই আপনি কষ্ট করে এলেন কেন? খবর দিলে আমরাই তো যেতাম। আরে মিয়া ছড়া লিখছি। তোমরা তো ছড়াকার। তাই তোমাগো তুইলা দিতে এলাম। লুৎফর রহমান রিটন, আহমাদ মাযহার এবং আমাকে তিনটা বই দিলেন। বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত। খুব যত্ন করে ছাপা বইতে ইলাস্ট্রেশানও করেছেন মন ঢেলে। রিটন ভাই ফোড়ন কাটলেন, নবী ভাই নিজের বই বইলা কি ফাটাইয়া দিলেন। এত সুন্দর ছবি! রফিকুন নবী নির্বিকারভাবে রসিকতা করলেন, আরে মিয়া আমার বইয়ের ছবি কে আঁকবো? কেউ আঁকেনি বইলাই তো নিজেরটা নিজে আঁকছি। এক সময় রফিকুন নবী প্রতিদিন দুইটা-তিনটা করে কার্টুন আঁকতেন। হয়তো বিদেশ গিয়েছেন তখন একসঙ্গে এঁকে দিয়েছেন কার্টুন। আশ্চর্য ক্ষমতা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। টোকাইকে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। টোকাইকে চেনে না এমন বাঙালি কি দেশে-বিদেশে কোথাও আছে?

তার সঙ্গে এক আড্ডায় নিবিড়ভাবে বললাম, আপনার ছবির তো ব্যাপক চাহিদা। নতুন ফ্ল্যাট সাজাতে গেলেই লোকে রফিকুন নবীর পেইন্টিং-এর খোঁজ করে। নবী স্যার হাসলেন। হ আমিও শুনছি। আরো শুনছি, চাহিদা আছে বলেই ছদ্মবেশী রফিকুন নবী তৈরি হইছে। আরে মিয়া হুবহু আমার মতো ছবি আঁকে। অনেক কষ্টে বোঝা যায় এইটা আমার ছবি না। একবার ফরিদুর রেজা সাগর, রফিকুন নবীর একটা ছবি কিনলেন কোনো গ্যালারি থেকে। আমরা বললাম, ছবিটা নকল। সাগর ভাই হেসেই উড়িয়ে দিলেন। আরে না। নকল হতেই পারে না। ছবিটা ছিল কাঁধে কাগজের বস্তা নিয়ে টোকাই হেঁটে যাচ্ছে। একদিন রফিকুন নবীকে ছবিটা দেখানো হলো। সাগর ভাইয়ের রুমে। ছবিটা একঝলক দেখেই তিনি সাগর ভাইকে বললেন, আমি খারাপ আঁকি সাগর। তাই বইলা এত খারাপ আঁকি না। এটার তো কোনো পারসপেকটিভ ঠিক নাই। তারপর ফরিদুর রেজা সাগর ছবিটা গুম করে দিলেন। আমরা আর সেই ছবির অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। সেদিন থেকে তাকে বললাম, স্যার অনেকের ছবির নাকি এখন অনেক চাহিদা। অর্ডার অনুযায়ী এঁকেও তাদের ফুরসত নাই। রফিকুন নবী স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, হ কথা ঠিক। তবে যাগো ছবি বেশি বিক্রি হয় তাদের বাড়ি গিয়া দেখবা গাঁট্টি বাইন্ধা ছবি পইড়া আছে। একদিন বেঙ্গল গ্যালারির চত্বরে রফিকুন নবীর সাথে দেখা চারপাশে তার ভক্তবৃন্দ। আমরাও নবী স্যারের ভক্ত। কিন্তু হৃদয়ের কাছে পৌঁছাতে পারি না। কি আমীরুল কি খবর? সাগর কেমন আছে। রিটন কি চইলা গেছে? এমন সব খোঁজ-খবর সব সময় নিয়ে থাকেন। ক্যান্টিনে চা কফি খেতে বসলাম। পাশে এসে বসলেন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী বীরেন সোম। রফিকুন নবীর প্রত্যক্ষ ছাত্র। প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। ধূমায়িত চায়ের কাপে আড্ডা জমে উঠেছে। রফিকুন নবী সরল মনের মানুষ। খোলামেলা কথা বলেন। নিজের গভীর উপলব্ধি আছে জীবন ও মানুষ নিয়ে। হঠাৎ করেই আমি বললাম, স্যার আপনার টোকাই তো অমরত্ব পেয়েছে। সমস্ত বাঙালি টোকাইকে চেনে। ধুর মিয়া কি যে কও না। এইটা কি শিল্পের সাফল্য হইলো? শোনো মিয়া জয়নুল স্যারের কথা ভাবো। ওই যে গরুর গাড়ি ঠেলার একটা ছবি আছে। গাড়িটা কাদায় আটকে গেছে। পোড়ামাটির মধ্যেও এই কাজটা দেখবা সবখানে পাওয়া যায়। পাট দিয়ে পাতলা বাঁক দিয়ে কিংবা কাঠের মধ্যেও এই ছবিটার রেপ্লিকা দেখেছি। লোকজন এগুলো কেনে। ঘরে সাজিয়ে রাখে। একটা পেইন্টিং কতটা শক্তিশালী হলে এটা সম্ভব! সাধারণ লোকশিল্পীরা নানা ফর্মে ছবিটা আঁকার চেষ্টা করে। এখানেই শিল্পের সার্থকতা বা সাফল্য। টোকাই শেষ পর্যন্ত শিল্প হয়ে উঠেছে কিনা জানি না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, রনবী। চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া এক শিল্পী। লোভ স্বার্থপরতা দৌড়াদৌড়ি কোনোকিছুর মধ্যে তিনি নেই। শুধু একমনে গান শোনেন আর ছবি আঁকেন। জয় হোক রনবীর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App