×

সাময়িকী

একটি নক্সি কবিতা এবং উনত্রিশটি চাঁদ রেখে চলে গেলেন রবি দা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৩১ পিএম

একটি নক্সি কবিতা এবং উনত্রিশটি চাঁদ রেখে চলে গেলেন রবি দা
একটি নক্সি কবিতা এবং উনত্রিশটি চাঁদ রেখে চলে গেলেন রবি দা
 

আমরা অনেকেই তাঁকে ‘রবি দা’ বলে ডাকতাম। তিনি খুব মজা পেতেন। বলতেন, রবি ঠাকুর নেই। তোমরা আমাকে ‘রবি’ বানিয়ে দিলে! অথচ আমি তো দেখতে নজরুলের মতো।

না। তিনি বরি ঠাকুরও না; নজরুলও নন। তিনি আমাদের প্রিয় রবিউল হুসাইন। বড্ড সাদা মনের মানুষ- কবি, স্থপতি, শিল্প-সমালোচক, সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী রবিউল হুসাইন।

রবি দা আমাকে কখনো ‘তুমি’ করে ডাকতেন আবার কখনো ‘আপনি’ করে ডাকতেন। তাঁর সাথে প্রচুর স্মৃতি। সেই স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে একটি ঘটনা তুলে ধরছি। তখন আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ উপস্থাপনা করি। কবি হিসেবে, স্থপতি হিসেবে এবং সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে ২/৩ বার আমার অনুষ্ঠানে এসেছেন।

একবার এলেন- ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর এসব আন্দোলন নিয়ে কথা বলার জন্য। বিটিভিতে আমাদের রেকর্ডিংয়ে তিনি দেরি করে এলেন। প্রযোজক সৈয়দ জামান আমার ওপর খুব বিরক্ত। তবু অনুষ্ঠান ধারণ করা হলো।

আমার বাসা মিরপুর, জামান ভাইয়ের বাসা আগারগাঁও। রেকর্ডিং শেষ করে কখনো কখনো বিটিভির গাড়িতে বাসায় ফিরি। সেদিন রবি দা আমাকে মিরপুর নামিয়ে দেয়ার জন্য তাঁর ড্রাইভারকে বললেন, ধানমন্ডি না; মিরপুর যাও।

যাওয়ার পথে গাড়িতে আড্ডা হলো। আমার বইয়ের নামকরণ নিয়ে বললেন- দুলাল, আপনার বইগুলোর নাম অন্য রকম, বৈপরীত্য। যেমন- তৃষ্ণার্ত জলপরী, অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো, ঘাতকের হাতে সংবিধান, একি কাণ্ড পাতা নেই, দ্রবীভূত গদ্যপদ্য, ঐক্যের বিপক্ষে একা, নির্জনে কেন এতো কোলাহল, নিদ্রার ভেতর জেগে থাকা... আমি খুব লজ্জা পেলাম।

আমিও পাল্টা বললাম, ‘কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে’, ‘আরও উনত্রিশটি চাঁদ’, ‘এইসব নীল অপমান’ আরো বেশি কাব্যিক। তা চাঁদ ২৯টি হয় কীভাবে? হ্যাঁ, কবিদের কাছেই তা সম্ভব! তিনি আমাদের জন্য উনত্রিশটি চাঁদ রেখে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন।

রবিউল ভাইয়ের সাথে আমার একটা অদ্ভুত মিল ছিল। বিপরীত থেকে উল্টো করে দেখা, উল্টো করে ভাবা। এ প্রসঙ্গে আনিসুল হকের কথাটা তুলে ধরছি : ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ মানুষের নাম রবিউল হুসাইন। তুমি জানো না তাঁর মাথায় কী উদ্ভট উদ্ভট আইডিয়া খেলা করে। তিনি একটা গল্প লিখেছেন, পুরোটা ক্যাসেট প্লেয়ারের রিউইন্ড করার মতো। মানে, শেষ লাইনটা সবার আগে লিখেছেন। ধরা যাক, এমন, সকাল সাতটায় তিনি মারা গেলেন। পৌনে সাতটায় তিনি নাশতা করেছেন। সাড়ে ছটায় তিনি দাঁত ব্রাশ করেছেন। ছটায় ঘুম থেকে উঠেছেন। তার আগের ৭টা ঘণ্টা ঘুমিয়ে ছিলেন। রাতে ১১টায় ঘুমুতে যাওয়ার আগে তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছেন। এইভাবে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে গল্প শেষ হবে’। (দ্র : রবিউল হুসাইন ভাই, স্যালুট/আনিসুল হক। দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ঢাকা।)

সেদিন আমাকে আমার বাসায় নামিয়ে দেয়ার সময় তিনি সিরিয়াসলি বলেছিলেন- ‘জামান সাহেব, আপনি তো দুলালের নাটক প্রযোজনা করছেন। আগামী নাটকে আমি অভিনয় করবো। আমার জন্য একটা চরিত্র চাই। জীবনে তো অনেক অভিনয় করলাম, আমার মনে হয়- আমি নাটকেও পারবো’। কেন এই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, তা আর কখনোই জানা হয়নি। সেদিন আমরা তাঁর গাড়িতে বসেই গলা ভিজিয়ে ছিলাম।

রবি দা আমাদের কতটা স্নেহ করতেন, তার আর একটি দৃষ্টান্ত দেই। আমার লিটলম্যাগ ‘সূচিপত্র’-এর জন্য লেখা চাইলাম। তিনি আমাকে একটি নক্সি কবিতা দিলেন। কবিতাটি ভেতরে না ব্লক করে ছেপে সূচিপত্রের চতুর্থ সংখ্যার প্রচ্ছদ করেছিলাম, ১৯৯০ সালে, ফেব্রুয়ারিতে।

নকশা কবিতার জনক গীয়োম এ্যাপোলিন্যাখের চিত্রকাব্যের চেয়েও রবিউল হুসাইনের এই শিরোনামহীন কবিতা অনেক বেশি শিল্পিত বলে আমার বিশ্বাস। পুরো কবিতা একটি নারী মুখাবয়বের ওপর রচিত। কপালে টিপের জায়গায় ‘টিপ’, চোখের সূচনায় আঁখি’, নাকের ভাঁজে ‘নাক’ এবং তার ভেতর ‘নোলক’ ব্যবহার করে চিত্রকর্ম এঁকেছেন। শিল্পকর্ম থেকে কবিতাটি বের করে স্বাভাবিক রূপ দিলাম।

বন্ধুরা, সূচিপত্রের প্রচ্ছদের শিল্পকর্মের সাথে মিলিয়ে দেখুন সেই কবিতাটি :

........................... কাঁচপোকার টিপ খুলে উড়ে গেলো পাখি নোলক পরা গোলক ধাঁধা সরল বৃত্তের কেন্দ্র ভূমি ভর দুপুরে উল্টে যাওয়া চন্দ্র খানি হারিয়ে গেলো নরম হীরের নাক ছবি অলস নদীর ঢেউগুলি অন্ধকারের সূদন জমি তামানিশার তস্য গলি ভ্রমর পাতায় নৌকা দিয়ে ওপার হলি কে তুই বিশ্বস্ত প্রেমিকা খুঁজতে দালালের দুচোখ হাতড়িয়ে ক্লান্ত হলি আঁখি কোণে জলছবি সমুদ্র সমুদ্র তোর চোখের দিকে তাকালেই নৌকার মতো যোনি দেখে ফেলি তখনই তোকে মনবাসি

নক্সি কবিতা, রবিউল হুসাইন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App