×

সাময়িকী

আমার অলস মা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৬:১৩ পিএম

আমার অলস মা

কত মানুষের কত কিছু নিয়ে দুঃখ আর আমার দুঃখ আমার নাম নিয়ে। মাগরিব ওয়াক্ত শেষে এশার ওয়াক্তে আমার জন্ম হয় তাই মা আমার নাম রাখেন এশা। স্কুলে বন্ধুরা আমাকে ডাকত মশা নামে। স্কুল থেকে ফিরে মাকে কত বকা দিতাম কেন এমন নাম রেখেছে। মা বলত নামে কি যায় আসে? নাম যেমনি হোক একে সুন্দর করতে হয় কাম দিয়ে। আমি এত কিছু বুঝতাম না শুধু রাগ করতাম। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাকে আরো বেশি অপছন্দ করা শুরু করলাম। কারণ তার সব কাজের মধ্যে আমাকে প্রচ্ছন্ন অবহেলার উপস্থিতি টের পেতাম।

দাদা বেঁচে থাকা অবধি আমরা দাদা বাড়িতে সবার সাথে থাকতাম। আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গী ছিল চাচাতো ভাই শামীম। ও আমার চেয়ে আট মাসের বড়। চাচি শামীম ভাইকে এমনভাবে আদর করত যে মা ছাড়া সকলে খুব তৃপ্তির দৃষ্টিতে দেখতো চাচিকে। আমি ছোট হলেও বুঝতাম আমি আর শামীম একই বয়সের হলেও আমাকে মা অবহেলা না করলেও শামীমের মতো যত্ন নেয় না। আমি মাঝেমাঝেই আমাদের ঘরের বারান্দা থেকে ক্ষুধার্ত চোখে শামীম ভাইকে দেখতাম। আর আমার কেন এমন মা হলো এজন্য আল্লাহকে বিচার দিতাম। দাদি বলতো তোর মা’র ছেলে বাচ্চা বেশি পছন্দ। তুই মেয়ে তাই তোর মা তোকে ভালোবাসে না।

জ্যৈষ্ঠের কড়া রোদে স্কুল ছুটি হলে চাচি ছাতা হাতে, পানির বোতল নিয়ে শামীম ভাইয়ের জন্য স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো। কি যত্ন করে রোদ বাঁচিয়ে চাচি শামীমের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নিয়ে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরতো। চাচি বলতো, কিরে এশা তোর মা এ সময় ঘুমায় কেন? তোকে নিতে এলেই তো পারে? তাইতো মা কেন আসে না? একগলা অভিমান নিয়ে বাড়িতে যেয়ে মা কে বলতাম তুমি চাচির মতো আমার জন্য ছাতা নিয়ে স্কুলে যাও না কেন? মা বলত ‘আমার এত আহ্লাদ নাই। রোদে পোড়ার এই তো সময়। পুইড়া খাঁটি হ। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস তাই ননীর পুতুল হবি নাকি?’

সে বয়সে আমার মধ্যে ভেজালের কী ছিল যে রোদে পুড়ে খাঁটি হতে হবে? আমি জানি না তবে মায়ের আদর আর একটু বেশি যত্ন পাবার জন্য খুব অপেক্ষায় থাকতাম। শামীমকে আমার খুব হিংসা হতো। ওর মা ওকে কত আদর করে। স্কুল থেকে ফিরলে মা ভাত বেড়ে দিত কিন্তু বারান্দা থেকে দেখতাম চাচি কি সুন্দর করে শামীমকে কাঁটা বেছে খাইয়ে দিত। পানিটা পর্যন্ত হাঁদারাম শামীম নিজে ঢেলে খেত না।

মাকে সেই সময় বিরক্ত লাগলেও বেশ কিছু কাজে খুব ভালোও লাগতো। কারণ আমার পছন্দের কাজগুলো মা অনায়াসে করার অনুমতি দিত। যেমন ভর দুপুরে সবাই ঘুমালেও মা বসে বই পড়ত আমি বাইরে যেতে চাইলে কোথায় যাবো জানতে চাইতো কিন্তু কখনো মা মানা করতো না। ইচ্ছে মতো বাড়ির পাশে পুকুরে গা এলিয়ে গোসল করতাম যতক্ষণ মন চায়। অথচ শামীমের তখনো পুকুরঘাটের আশপাশে আসা বারণ ছিল। শামীমের প্রতি এমন যত্নের কারণে সবাই চাচির বেশ প্রশংসা করত। খুব যত্নবান মা হিসেবে তার একটা নাম ছিল পাড়া প্রতিবেশীর কাছে। আর আমার প্রতি মায়ের উদাসীনতার কারণে সবাই কথা শুনাতো মাকে। সবাই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত। সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল চাচি।

তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। একদিন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খুব মজা করে খেলছিলাম। কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে টের পাইনি। বাড়ি ফিরে দেখি উঠোনে মা অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আর বাবা, দাদা, চাচা বকা দিচ্ছে মাকে। কেন মা চাচির মতো নয়, কেন একটা মেয়ের যত্ন নিতে পারে না। শামীমকে যেমন চাচি যত্ন করে আঁচলের তলায় রেখে মানুষ করছে আমার মা কেন তেমন নয়? মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে সেদিন জবাব দিয়েছে, ‘এতটুকু মেয়ের আবার ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু কি? আর কিছুদিন পর তো মেয়েটা খেলতে যেতেও পারবে না। এখন যতটুকু ইচ্ছা খেলুক।’ সবাই সেদিন মাকে ছি ছি করেছে তার বোকামির জন্য। আমার জীবন নষ্ট করবে আমার মা এই ভবিষ্যদ্বাণী সেদিন দাদা করে দিয়েছিল। নিজের কাছে নিজেকে সেদিন ভীষণ অপরাধী লাগছিল আমার জন্য মাকে বকা খেতে হলো। রাতে শুয়ে হঠাৎ পিঠে মায়ের হাতের স্পর্শ। চমকে তাকাই মায়ের চোখে। যেন জ্বলছে চোখ দুটো। মা খুব আস্তে করে বললো, তোর দাদুর কথায় ভয় পেয়েছিস? ভয় পাবি না। তুই আমার কাছে মেয়ে না, তুই মানুষ। তোকে আমি মেয়ে মানুষের মতো করে মানুষ করিনি। তোকে তোর ইচ্ছার মতো করে মানুষ করেছি। অনেক দূর যেতে হবে তোকে। সেদিন মেয়ে বলে থেমে যেন না যাস তাই আমি কখনো তোকে থামাইনি।

আমার সে রাতের সব কথা মনে নেই। সে রাতে আমি সব কথার মানে বুঝিনি। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম আমাকে অনেকদূর যেতে হবে। মায়ের চোখ দুটো সেদিন অন্য কথা বলছিল।

সবাই ভাবতো আমার মা খুব আরাম প্রিয়, অলস, কারো সাথে মিশে না। তাই তো কাজ শেষে ঘরে পড়ে ঘুমায়। কিন্তু আমি জানি মা ঘরে বসে আছে মহাশ্বেতা দেবীর বই নিয়ে। কখনোবা ফেলুদার রহস্য বই অথবা কখনো দেখতাম সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণ গল্প পড়তে পড়তে বই বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুকিছু বই আমি মায়ের অনুরোধে স্কুল লাইব্রেরি থেকে এনে দিতাম। মাঝেমাঝে রাতে সেগুলো গল্প করত আমাকে, তুই যখন এ দেশে ঘুরতে যাবি আমাকে ওখানে নিয়ে যাস। আমরা মা মেয়ে ওই নদীর পারে ঘুরব। এমনভাবে বলতো যেন মা জানে আমি সত্যি সত্যি বইয়ে পড়া ও দেশগুলো ঘুরতে যাব।

মায়ের দুনার্মের সাথে বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমিও কিছু দুর্নামের ভাগি হলাম। যেমন আমি স্কুলে খেলার সাথী হিসেবে মেয়ের চেয়ে ছেলে বন্ধুকে বেশি পছন্দ করি। বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে পুরস্কার আনলে একমাত্র বাবা-মার চোখ চকচক করত। ভীষণ খুশি হতো মা। আর সবাই বলতো মায়ের কারণে আমি ছেলেদের চারিত্রিক গুণ পাচ্ছি। আমার অবশ্য এসবে তেমন কোনো খারাপ লাগতো না।

আমি ক্লাস নাইনে ওঠার পর বাড়ি থেকে বেশ দূরে এক স্কুলে ভর্তি হলাম। আমার সাথে শামীমও ভর্তি হয়। কিন্তু প্রতিদিন এত দূরে হেঁটে স্কুল করা, একব্যাগ বই কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়া শামীমের জন্য অসম্ভব। চাচি তাই শামীমের স্কুলে যাওয়া কমিয়ে দিলেন। বাড়ির আর সবাই আমাকেও নিয়মিত স্কুলে যেতে নিষেধ করল। মা ব্যাপারটাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিল না। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাড়ির বারান্দায় একটা সাইকেল। আমার জন্য মা কিনে আনিয়েছে। তার জমানো টাকা থেকে সাইকেল কিনেছে। এ জন্য মাকে অনেকের কাছেই খুব প্রত্যাশিত কটু কথা শুনতে হয়। কোনো কথার প্রতিবাদ না করে আমাকে আস্তে করে বলেছে কারো কথায় কান দিস না। উত্তর না দিয়েও অনেক উত্তর দেয়া যায়। কয়েকদিনে আমি সাইকেল চালানো শিখে গেলাম। শুরু হলো আমার নতুন জীবন। আমি যখন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম রাস্তার সব মানুষ আমাকে দেখত। কারণ আমার সাইকেলের পিছনে শামীম বসে যেত স্কুলে। চাচিই বলে দিয়েছিল শামীম সাইকেল চালাতে পারে না। আর ব্যস্ত রাস্তায় ছেলেকে সাইকেল দিয়ে পাঠাতে চাচির সাহসে কুলায় না।

মায়ের প্রতি একটু একটু করে আমার ধারণা পাল্টাতে শুরু করল। কেন আমার মা অলস, কেন শামীমের মতো যত্ন নেয় না তখন আমি প্রতিদিন একটু একটু করে বুঝতে পারতাম। আর প্রতিদিন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হতো। এ কাজগুলো দিয়ে আমি আমার মাকে নতুন করে চিনতে পারি। তাকে বুঝবার মতো যোগ্যতা আমার এতদিন ছিল না। আমি বুঝতে পারি সবাই মা হতে পারে না। মা তার কাজের মধ্য দিয়ে যেভাবে আমার জগৎকে মজবুত একরূপ দিয়েছে, আমাকে প্রতিদিন সে তৈরি করেছে বাস্তবতার সাথে লড়তে। আমিও লড়ে গেছি। বাধা এসেছে। কিন্তু আমরা মা-মেয়ে থেমে থাকিনি।

সন্ধ্যায় পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতে বাধা না দিয়ে মা আমাকে শিখিয়েছে অন্ধকার খারাপ না যদি সেখানে কোনো খারাপ চিন্তা না থাকে। ঘরে বন্দি না থেকে স্কুলে গেছি সাইকেল চালিয়ে সেদিনই আমার রক্ত জেনে গেছে রাস্তা যেমনি হোক পথে নামতে হবে। একা।

আমার সে ভাই শামীম গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে শহরে যেতে সাহস করেনি। চাচি শামীমের আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়ার আগেই নষ্ট করে দিয়েছে। শামীম কখনো নিজের সিদ্ধান্ত নিতে শিখেনি। মা মানেই সন্তানের সমস্ত জগতের মালিক সে নয় এ সত্য খুব কম মা সময় থাকতে বোঝে। আজো সবাই ভাবে আমার মা আমাকে এতটা খারাপ বানিয়েছে, তার যত্নের অভাবে আমি বেয়াড়া হয়ে গেছি। দেশে বেড়াতে গেলে কোনো না কোনো ফাঁকে চাচি একবার বলবেই তোর মা বলেই পারে মেয়েকে বিদেশে ফেলে রেখে শান্তিতে থাকতে।

আজ আমি দেশের চেয়ে বিদেশে থাকি বেশি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করি। মাও আমার সাথে থাকে। মাঝেমাঝে দেশে যায় বেড়াতে। সুযোগ পেলেই মা মেয়ে ঘুরে বেড়াই। সেদিন লন্ডনের টেমস নদীর সামনে বসে মাকে বলেছিলাম মা তোমাকে আমি ছোটবেলায় খুব অপছন্দ করতাম। তুমি আমাকে স্কুলে ছাতা হাতে আনতে যেতে না বলে। আমরা মা-মেয়ে অনেক হেসেছি। মা জানতে চাইছিল এখন পছন্দ করিস?

আমি সত্য কথা বলতে পারিনি। আমি বলতে পারিনি একটা সাইকেল কিনে দিয়ে তুমি আমার স্কুলে যাওয়ার পথ শুধু সহজ করোনি মা তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে কখনো থেমে যেতে নেই। কোনো না কোনোভাবে মেয়েদের চলতে হবেই। সে পথ নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App