×

সাময়িকী

অগ্রগণ্য শিল্পীর প্রতিকৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৩৫ পিএম

অগ্রগণ্য শিল্পীর প্রতিকৃতি
অগ্রগণ্য শিল্পীর প্রতিকৃতি

বাংলাদেশের অগ্রগণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। অসাধারণ রসবোধ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সঙ্গে সমাজসচেতনতা ও নান্দনিক বোধের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয়ে আমাদের চিত্রকলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তিনি। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ ‘টোকাই’। তাঁর জল রং, তেল রং, রেখালেখ্য ও কাঠখোদাই হয়ে উঠেছে এ দেশের শিল্পের পথযাত্রায় বিশেষ গুণে অনন্য সৃষ্টি। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। গতকাল ছিল তাঁর ৭৬তম জন্মদিন। শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আপনার প্রতি।

সব মানুষেরই পক্ষপাতিত্ব আছে। বিশেষ মত, মতবাদ, দল ও মানুষের জন্য আছে অযৌক্তিক মন উপচানো প্রীতি। কিন্তু প্রীতি ও নীতি দুই বিমুখ প্রান্তরের অভিধা। মানুষের বিবেক এক নিরপেক্ষ রূঢ় প্রান্তরের ভাষ্যকার। এই ভাষ্যকার কারো জন্য বিশেষ মমতা প্রকাশ করে না। কিন্তু তাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে। সব সুনাগরিকের মনে একটা আকুল আকাঙ্ক্ষা কখন আসবে সেই নীতিবান নিরপেক্ষ ভাষ্যকার। আমরা সত্যের অমল আলোয় স্নাত হতে চাই। যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে দেশটা আর সুবিচার পাচ্ছে না। জননী মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। স্বৈরতার বিচিত্র আঘাতে জন্মভূমি আজ ক্ষতবিক্ষত। এসব অনুভব করে এক শিশু। এক শিশু মানে আমাদের বুকের তলে লুকানো কোনো অপাপবিদ্ধ প্রতীক শিশু- প্রতিনিয়ত যে কোনো রাখঢাক না করে, চারপাশে গ্রাহ্য না করে, আলটপকা সত্য কথা ফাঁস করে দিচ্ছে। এই শিশুর নাম ‘টোকাই’। শিল্পী রফিকুন নবীর ক্যারিকেচার শিল্পের চরিত্রের এই নাম। ইঁচড়ে পাকা, ঠোঁট কাটা এসব সুবচন বাংলা ভাষার একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন। সব আবিষ্কারই প্রয়োজনে হয়। টোকাইও আবির্ভূত হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। রফিকুন নবী ওরফে রনবী গেল শতকের সত্তরের দশকে টোকাই আবিষ্কার করেন। তিনি একজন সাহসী মুখপাত্রের তালাশ করছিলেন তখন। দেশটার রাজনীতি তখন বোঝা যাচ্ছিল না। একটা স্বাধীন দেশ। কয়েক বছরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আবার আহত-বিক্ষত হতে থাকল। সবাই ফিসফাস করে। কেউ গলা উঁচিয়ে স্বাধীনভাবে স্বাধীন দেশে কথা বলতে পারছে না। কিন্তু কথার অনেক শক্তি। কথার শক্তি মানে মানুষের শক্তি। কোনো না কোনোভাবে তো কথা বলতেই হবে। আভাসে, ইঙ্গিতে কথা বললে বিপদের ঝুঁকি কম। বিবেককে তো আর ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় না। যে সময় অসহনীয় তাকে চাবুকপেটা করতে হবে। সরাসরি না পারা গেলেও কৌশলে খোঁচাতে হবে সময়ের দস্যুদের। বিবেক যখন গেরিলা হয়ে যায় তখন তা বিদ্রুপের ভাষায় অতর্কিতে হামলা করে। রফিকুন নবীর সেই গেরিলা-চৈতন্যের সৃষ্টি টোকাই।

আপাতদৃষ্টিতে টোকাই ছিন্নমূল। ও পথের পাশে অষ্টপ্রহর যাপন করে। কখনো ও ক্ষ্যাপা গোঁয়ার। কখনো বিমর্ষ। কিন্তু ক্ষুরধার তার কথা কখনো বন্ধ হয় না। তার মনের মধ্যে তাল তাল রসবোধ। কখনো শব্দের অভাব হয় না। মোক্ষম বাক্যটা সে সময়মতো ছুড়ে দিতে পারে ভণ্ড সমাজের দিকে, নষ্ট রাষ্ট্রের নষ্ট কর্তাব্যক্তিদের মুখে।

আমরা দাঁত কিড়মিড় করি। প্রলাপ বকি। অক্ষম আস্ফালন করি। ওই নষ্ট মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। প্রতিশোধ নিতে চাই; কিন্তু ব্যর্থ হয়ে রাগে-দুঃখে ফিরে আসি। চোখের কাছে ঘটতে থাকা অবিচার দেখতে দেখতে সুশীলজনের স্নায়ু অবশ হয়ে আসে। দেহ শিথিল হলেও নীতিবোধ তো আর শিথিল হয়ে আসে না। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষরা শেষ মুহূর্তে একটা রূঢ় সংলাপ শুনিয়ে যায়। টোকাই এমনই সব কথা শোনাচ্ছে। দেশের মুখোশ পরা তথাকথিত ভদ্র মানুষগুলোর আসল রূপ ফুটে ওঠে ওর মন্তব্যে। টোকাই মানুষে আস্থা রাখতে পারে না। মানুষ তার কাছে আগন্তুক। বিশেষ করে এই ঝলমলে মহানগরের দরদালানের মানুষ শিশু টোকাইয়ের কাছে বিস্ময়, যেমন আলাভোলা সরল চাষির কাছেও। ডাস্টবিনের পাশের কুকুর, বেড়াল আর কাকেরা তার বন্ধু। তাদের সঙ্গে ওর কথা হয়। মানুষের পদাঘাতে পদাঘাতে কোণঠাসা হয়ে টোকাইরা আজ কোথায় পৌঁছছে তা সুখীগৃহী মানুষ জানে না। টোকাইয়ের সঙ্গে কুকুরের কথা হয়। ‘কুকুর বলে, মানুষের আমার খুব ডর...।’ টোকাই উত্তর দেয়- ‘আমারও।’ একটি শব্দে এমন অম্লমধুর মন্তব্য কার্টুনেই সম্ভব, রনবী তা করেছেন হাজার হাজার।

রনবীর ছবিতে জলরঙের বিবিধ পর্দা বিশেষ দ্রষ্টব্য। তার ছবি মূলত দ্বিমাত্রিকশৈলীর অনুগামী। অবশ্য হালকা-পলকা নানারকম বর্ণ পর্দার কারণে স্পেসে গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ স্পেস পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেনি। এ ধরনের বর্ণ পর্দার স্পেসের কারণে টোকাইয়ের ছোট শরীরটা আরো বেশি আগন্তুক উপস্থিতি পেয়েছে। কাঁটাতারের বেদনাসিক্ত করে ওই ব্যারিকেডের পাশে পড়ে আছে মিছিলের মানুষের ফেলে যাওয়া স্যান্ডেল এবং রঙের দাগ। অনেক ধস্তাধস্তি, রক্তারক্তির পর এ শহরে কার্ফ্যু-নীরবতায় দেখা যায় এই দৃশ্য।

পার্কের বেঞ্চে বসে আছে টোকাই ও এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের কথা, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তো... তাই চিন্তায় আছি। তোর চিন্তাভাবনা কী? টোকাইয়ের উত্তর, নিজেরই দাম নাই। ভাবুম কেমনে...।’

এই যে এত লেখালেখি কিন্তু তাতে কী হয়! মানুষ কি তা শোনে? সমাজ কি তাতে পাল্টায়? আইনের দণ্ড কি স্বাধীনভাবে বিদ্ধ করে অপরাধীকে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতাজুড়ে কত না আহাজারি, সুপরামর্শ, জনহিতকর প্রস্তাব। কিন্তু কে আজ গ্রাহ্য করে এসব। বাক্যবাগীশ বুদ্ধিজীবীরা শুধু সেমিনার মাতায়। কয়েকটা লোক কথার খই ফোটায় আর কয়েকটা লোক তালি বাজায়- এই সার্কাসি আয়োজনে সমাজের কি বিশেষ কোনো লাভ হয়? টোকাইকে প্রশ্ন করা হয়, এবার শিশু দিবসে কী করলি? উত্তর, অনেক কথা খাইয়া ফেলাইছি। এক সময়ের দেশের সবচেয়ে দামি সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক বন্ধুবর শাহাদাত চৌধুরীর সঙ্গে কথাবার্তা চালাচালি করতে করতে টোকাই চরিত্রের সৃষ্টি করেন রফিকুন নবী। সত্তরের দশকের শেষ থেকে শুরু করে এই নবীন শতকের কুড়ি বছর প্রায় সময় পাড়ি দিল টোকাই। ক্যারিকেচার বা কার্টুন শুধু টোকাই হয়ে উঠেছে পেইন্টিংয়ের চরিত্র। এই শিশুকে প্রধান প্রতিমা করে শিল্পীর জলরঙের দক্ষতা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে।

এ দেশের চারুশিল্পের ইতিহাসে রফিকুন নবীর এ প্রদর্শনী লক্ষ্য করে আঁকা ছবিগুলো নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জয়নুলের শিল্পভাষার অনুগামী হয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করতে করতে শিল্পী এক বিশেষ পরিশ্রুতি অর্জন করেছেন। এক নতুন শিল্পীসত্তার আবির্ভাব ঘটেছে এবারের কাজে। টোকাই-ভাবনা ও জলরং ভাবনা তিনি একসূত্রে গেঁথেছেন। সুদীর্ঘকাল তার চেতনার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এক নিরাশ্রয়ী অনাদর-অবহেলার শিশু। সভ্যতার এক দুঃসহ বিরোধাভাস এই দেশ। একই রাস্তার ফুটপাত ধরে ফিটফাট শিশুরা মা-বাবার আঙুল ধরে পরম পুলকে স্কুলে যায়, শিশুপার্কে যায় আর অন্য শিশু ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খায়। ধোপদুরস্ত নগরবাসী নির্বিকার। এই বৈষম্য সংবেদি মনকে পোড়ায়। নবীর হৃদয় একটু বেশি পোড়ে, মমতার তুলিতে টোকাইকে তিনি অনেকভাবে এঁকেছেন। ধারালো কথার সম্পাদকীয় লিখে, ধারালোতর উপসম্পাদকীয় রচনা করে এবং ধারালোতম কার্টুন এঁকেই কি আর শেষমেশ কিছু হয়? এ দেশে হলো কই? অনেক রাজনীতি হলো, অনেক আওয়ামী লীগ, বিএনপি হলো, অনেক কথার অভিশাপ দেয়া হলো সামরিক ও ছদ্ম-সামরিক শাসনকে তবু স্বাধীন দেশ স্বাধীনতার স্বাদ পেল না। এমনই যখন অবস্থা তখন বিবশ মানবসত্তা, শিল্পীসত্তা কী ভাববে? দশকের পর দশক এই মানসিক লড়াইয়ের পর টোকাইরূপী রনবীসত্তা বেদনার্ত। তার টোকাই এখন তার বেদনার শিশু, নতুন বোধের জাতক। এই নতুন ভাবনা উজিয়ে শিল্পী এবার জলরঙে ছাপিয়েছেন।

ছবিতে কার্টুনের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ নেই। আছে গ্রহণ বিষাদ। টোকাই নিঃসঙ্গ, মৌন। শুয়ে আছে বেঞ্চে একা। চারদিক নিসর্গের রং, স্পষ্ট ও অস্পষ্ট লতাপাতা। একটা ছোট্ট মানুষী দেহ নিসর্গের বিশাল পরিধির মধ্যে যেন শূন্য, নিরালম্ব কখনো দেয়ালের উপরে বসে আছে ও। দেয়ালের গায়ে লেখা ‘বাঁচার মতো বাঁচতে চাই’। কিন্তু এ লেখার সঙ্গে প্রতিবাদী টোকাইয়ের সম্পর্ক নেই। একদিকে প্রতিবাদের হাজার স্লোগান লেখা দেয়াল, অন্যদিকে একটি শিশু শুয়ে আছে অনিকেত। এ দুয়ের মধ্যে মিল হয়নি কোনোদিন।

রনবীর ছবিতে জলরঙের বিবিধ পর্দা বিশেষ দ্রষ্টব্য। তার ছবি মূলত দ্বিমাত্রিকশৈলীর অনুগামী। অবশ্য হালকা-পলকা নানারকম বর্ণ পর্দার কারণে স্পেসে গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ স্পেস পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেনি। এ ধরনের বর্ণ পর্দার স্পেসের কারণে টোকাইয়ের ছোট শরীরটা আরো বেশি আগন্তুক উপস্থিতি পেয়েছে। কাঁটাতারের বেদনাসিক্ত করে ওই ব্যারিকেডের পাশে পড়ে আছে মিছিলের মানুষের ফেলে যাওয়া স্যান্ডেল এবং রঙের দাগ। অনেক ধস্তাধস্তি, রক্তারক্তির পর এ শহরে কার্ফ্যু-নীরবতায় দেখা যায় এই দৃশ্য। মারাত্মক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নির্ভীক, নিশ্চাপ টোকাই- এই রক্তাক্ত রাজপথের মঞ্চে এসে হাজির হয়েছে বিপুল বিস্ময় ও বেদনা নিয়ে। কার্টুনের টোকাই বাক্যবাগীশ, ছবির টোকাই নির্বাক, নীরবতায় মগ্ন কিংবা বিস্ময়ে শিহরিত। এবার রনবী শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়েও অনেকখানি ভেবেছেন। দেয়ালে-দরজায়, জানালায় অনেক আলতো হাতে অক্ষর অ, আ বা অপটু হাতের লেখাজোখা তার ছবির বিশেষ উপাদান হয়েছে।

এ শহরে উপর থেকে দেখার অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। আকাশছোঁয়া দালানের উপরে উঠে নিচে তাকানোর অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে মানুষের। উপর থেকে দূরে মাঠের বেঞ্চিতে বসে থাকা টোকাই দেখেছেন রনবী। এভাবে অতল স্পেসে তার ছবির প্রধান প্রতিমা টোকাই তলিয়ে যাচ্ছে। দূরত্ব দেখার এই দৃষ্টিকোণের কারণে নতুন করে একাকী উঠে এসেছে শিল্পীর ছবিতে। যতই দালান উঠছে ততই মানুষ থেকে টোকাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আগে সে দেয়ালের পাশেই মানুষের উপস্থিতি নির্মাণ করে দিয়েছে। যে পথশিশু সামান্য একটা একতলা বা দোতলা বাড়ির পাশে তার দৈহিক আয়তনটা চোখগ্রাহ্য একটা ভারসাম্য ধরে রাখত তা আর এখন হচ্ছে না। বিরাট বিরাট দালানের পাশে ও এই এতটুকু হয়ে গেছে। আরো বেশি ওকে অচেনা বানিয়ে দিয়েছে সুরম্য সুউচ্চ দালান। ওই বিশাল দালানের ভেতর কী আছে, কারা থাকে, দেখে যেতে চাই- এই শিশুর এই চিরকালের আকুতি নিয়েও রনবী অনেকগুলো ছবি এঁকেছেন। এই বিষয়বোধ চিত্রিত করে শিল্পী শিশুর সব অনুধাবন করতে চেয়েছেন। হরষে বিষাদ অথবা প্রবচন উল্টে দিয়ে বিষাদে হরষের মতো নিষ্ঠুর কৌতুক জমিয়েছেন শিল্পী রফিকুন নবী। পরত পরত নির্মল জলরঙের পাশে টোকাই এই দেশের বাস্তবতা। দেশের প্রকৃতি এখনো সুন্দর, শাশ^ত সুন্দরের পাশে ঘটনার সমকাল বড়ই বিসদৃশ ঠেকে। টোকাই শাশ্বত ও আশাবাদী, কখনো খিলখিল হেসে মানুষের সভ্যতাকেও পরিহাস করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App