×

মুক্তচিন্তা

বায়ুদূষণ: ধ্বংসের পদধ্বনি শুনি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৯ পিএম

বায়ুদূষণ: ধ্বংসের পদধ্বনি শুনি!

আমরা যদি এ শহরকে বাসযোগ্য করতে চাই তবে এখনই সরকার ও নীতিনির্ধারণী মহলকে সচেতনভাবে মৌলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বায়ুদূষণে আমরা প্রথম স্থান অর্জন করেছি। দিল্লিকে হারিয়ে এখন আমরা প্রথম। কী ভয়াবহ! কী জঘন্য! কী আতঙ্কজনক! তবুও আমাদের কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চুপ। এখনো জরুরি অবস্থা ঢাকা হয়নি পরিবেশ নিয়ে। একটি হুলস্থুল পড়ে গেছে। গত সোমবার একটা মিটিং হয়েছে কিন্তু সেখানে ৭ জন মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা আসতে পারেননি। এটিই আমাদের কঠিন বাস্তবতা। নিশ্চয়ই সব ইস্যুর মতোই প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে আসতে হবে। বলতে হবে। তারপরও কিছু হবে কিনা জানি না।

সকালে অফিসে আসার সময় হিসাব কষি প্রায় ৫০টি বিল্ডিং ভাঙা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে আবৃত করা হয়নি। চারদিকে ধুলাবালি ছড়াচ্ছে। আদাবরে আমার বাসার সামনের বাস্তায় ইট, বালি, সিমেন্ট ফেলে কাজ হচ্ছে প্রায় রাস্তা বন্ধ করে। এমন কাজ চলছে সারা ঢাকা শহর জুড়েই। এগুলো দেখার কেউ নেই। গতকাল বস্তি এলাকায় দেখলাম ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম চলছে। ফগার মেশিন থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে, সামনে এসে দেখলাম ময়লার স্তূপের থেকে ধোঁয়া উঠছে, গাড়ির ধোঁয়া, বাসায় কয়েল বা রাস্তায় কত কত ধোঁয়া আর কেমিক্যাল পোড়ানো হচ্ছে। এই ধুলাগুলো কোথায় গিয়ে জমা হচ্ছে। সেগুলো বায়ুতে কি কি যুক্ত করছে আর আমরা আমাদের শরীরে।

সারা বছরই ঢাকা শহরে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হয়। তাই খোঁড়াখুঁড়ি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। খোঁড়াখুঁড়ির মাটি ও অন্যান্য আবর্জনা দ্রুত অপসারণের জন্য পৃথক খাতে খরচ হয়। কিন্তু বিধি মোতাবেক কাজটি হয় না। এ ছাড়াও ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা রাস্তার দুপাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় ধুলাবালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে শীতে ধুলাদূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বায়ুদূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ দূষণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। পড়ছে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব।

শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে বায়ুদূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। এই মৌসুমেই হাজার হাজার ইটভাটায় ইট প্রস্তুত ও পোড়ানোর পাশাপাশি মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ বেড়ে যায়। মেট্রোরেলসহ অন্যান্য মেগাপ্রকল্পের জন্য রাস্তা ও আশপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে খোঁড়াখুড়ি, গ্যাস-পানি, বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের সময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মাটি, বালি, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী আচ্ছাদনহীন ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিষ্কার করে রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা, দোকানপাট ও গৃহস্থালির আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, পুরনো ভবন ভাঙা, মেশিনে ইট ভাঙা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া ইত্যাদি বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস।

ঘরবাড়ি, আসবাবপত্রসহ কাপড়-চোপড়ে ধুলা জমে যেভাবে প্রতিদিন নগর জীবনকে নোংরা করছে, তা পরিচ্ছন্ন রাখতেও নগরবাসীকে নষ্ট করতে হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা ও বিপুল পরিমাণ পানি এবং ডিটারজেন্ট। আর এসব ডিটারজেন্টের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে নদী, লেক, জলাধারসমূহ। যা জলজ প্রাণীসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্যও ক্ষতিকর। কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করতেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। অতিরিক্ত পানি, বিদ্যুৎ ও ডিটারজেন্ট ব্যবহারের ফলে পারিবারিকভাবে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধুলাদূষণের কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ধুলাদূষণের কারণে বৃক্ষের সালোকসংশ্লেষণে বাধার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও ধুলাদূষণের ফলে মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ইমারত, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন স্থাপনায় মরিচা পড়ে সেগুলোর আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে। এই সর্বগ্রাসী ধুলাদূষণে নগরবাসী অতিষ্ঠ, জনদুর্ভোগ চরম সীমায়।

বায়ুদূষণের এ পরিস্থিতির কারণে মানুষ ভয়াবহ আতঙ্কিত। এ মেগাসিটি ঢাকা আজ পরিণত হয়েছে সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর নগরীর তালিকায়। আমরা যদি এ শহরকে বাসযোগ্য করতে চাই তবে এখনই সরকার ও নীতিনির্ধারণী মহলকে সচেতনভাবে মৌলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর সেই সিদ্ধান্ত হতে হবে সমন্বিত সিদ্ধান্ত। সরকারের উন্নয়নকাজে যুক্ত সব মহলকে নিয়ে এ পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। উন্নয়নের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মতোই পরিবেশ উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়ার বিকল্প নেই। কারণ একদিনে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি আর একদিনে তা সমাধান করা সম্ভব না। তবে এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের ভূমিকাও নির্ধারণ করে দিতে হবে। নিশ্চয়ই আমরা দূষণ ও পরিবেশ বিপর্যয়ে এক নম্বর থাকতে চাই না।

সম্পাদক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App