×

সাহিত্য

কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনকে শেষ শ্রদ্ধা (ভিডিওসহ)

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০১৯, ০২:৩৫ পিএম

অগ্রহায়ণের সকাল। রোদের তাপে পুড়ে যাচ্ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। তারই একপাশে শিরিষ গাছের নীচে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন। তাকে ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ত করছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। কারো কারো চোখের কোন ভিজে উঠতে দেখা গেছে এই কৃতি কবির জন্য।

বুধবার (২৭ নভেম্বর) সকাল ১০টায় কবি রবিউল হুসাইনের মরদেহ শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হলে সেখানে এমন দৃশ্য দেখা যায়। একুশে পদকজয়ী এই কবি ও স্থপতিকে ১২টা পর্যন্ত শ্রদ্ধার ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছেন তার শুভানুধ্যায়ীরাসহ সর্বসাধারণ।

তার মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলা একাডেমি, শিশু কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, সেন্টার ফর স্টাডিজ, ঝিনাইদহ জেলা সমিতি, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতি, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, আনন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ চারু শিল্পী সংসদ, শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আজীবন সদস্য কনক কান্তি বড়ুয়া, বুয়েট এলামনাই এসোসিয়েশন, সাংবাদিক আশিষুর রহমান শুভ সহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান তার বিশেষ সহকারি বিপ্লব বড়ুয়া ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ। এরপর জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, রবিউল হুসাইন কবি হিসেবে বিশিষ্টজন ছিলেন, তার নিজের যে বিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা, সেখানেও তার একটা ভূমিকা ছিল। তিনি সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে চলেছেন। কয়েকদিন আগেও এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে একসাথে ছিলাম। তিনি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবেন ভাবতেই পারিনি।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, রবিউলসহ আমরা ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ নামে একটা সংগঠন করেছিলাম। যে সংগঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে এর সদস্যরা মৃত্যুর পর দেহ দান করে দেবে। যেখানে স্থপতি মোবাশ্বের, দুইজন ডাক্তারও ছিলেন। সাগর লোহানী সদস্য সচিব ছিলেন, আমি ছিলাম আহবায়ক। রবিউলের শেষ ইচ্ছে ছিল দেহ দান করে দেয়া। কবির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা হতো তার শেষ ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানানো। তার পরিবারের পক্ষ থেকে তার সে ইচ্ছা পুরণ করা হলো না! এটা আমাকে ব্যথিত করেছে।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, স্থপতি রবিউল হুসাইন দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে ছিলেন; সবসময় তাদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। আমরা তাকে অসময়ে হারালাম।

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, রবিউল হুসাইন বহুমাত্রিক ও নিরহংকারী মানুষ ছিলেন। তিনি তার বহুমুখী কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে পরিচিত হয়ে থাকবেন। তিনি আমাদের সাথে সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন।

জাতীয় জাদুঘরের সভাপতি শামসুজ্জামান খান বলেন, এতো গভীরভাবে দেশকে ভালোবাসার মানুষ বাংলাদেশে আর পাওয়া যাবে না। ১৯৭৮ সালে তিনি আমার বাড়ির নকশা করেছিলেন। কিন্তু নকশার সম্মানী তিনি নেননি। তার মতো এমন নির্লোভ সচরাচর দেখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। এর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্টি ডা. সারোয়ার আলী বলেন, তার বড়ো পরিচয় তিনি উচ্চ মানের কবি ও স্থপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে তার ছিল গভীর আগ্রহ। তিনি ছিলেন অজাতশত্রু।

সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমুন্নত রাখার জন্য তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন। এছাড়া তিনি সব ধরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে থেকে প্রেরণা জুগিয়েছেন আমাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, রবিউল হুসাইন বাংলাদেশে সত্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষণের সকল উদ্যোগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তার মৃত্যুতে এদেশের প্রগতিশীল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এক অপূরণীয় শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। অসাধারণ স্থাপত্য ও সাহিত্য কর্মের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি লেখক মফিদুল হক বলেন, রবি ভাই ডাকের মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হতো। যেখানে যেতেন তার উপস্থিতিতে অন্যরকম প্রেরণার সঞ্চার করতো। তিনি সবার মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু সবার থেকে একটু আলাদা। তিনি রেখে গেছেন বিপুল সম্ভার। তার হাতের কাজের স্পর্শ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। তার ‘না’ সাহিত্য আন্দোলন এমন তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছিল, যা সমাজের প্রচলিত ধারা, শাসন শোষন এবং পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে।

চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, রবিউল চলে যাওয়ার পর আমি ভীষণ শকট। তিনি মানুষ হিসেবে বিরাট মাপের ছিল। তার একটি বিরাট গুণ ছিল- তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই একটি শান্তির ছায়া নেমে আসত। তিনি রসিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু কখনোই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন নাই।

পরিবারের পক্ষ থেকে রবিউল হুসাইনের অনুজ টি আই এম তারিক হুসাইন বলেন, বড় ভাই থাকাতে আমরা কোনোদিন বাবার অভাব অনুভব করিনি। তিনি সবসময় আমাদের উৎসাহিত করতেন। তার সাথে সব ধরণের কথা বলতে পারতাম। মাঝখানে কোনো দেয়াল ছিল না।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারন সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, রবিউল ভাই ছিলেন নিরহংকারী একজন গুণী মানুষ। এ জাতির অন্যতম সূর্যসন্তান। তিনি ছিলেন আমাদের নির্ভরতার প্রতীক। তার শূণ্যতা পূরণ হবার নয়।

সব শেষে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি’ গানের মধ্য দিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের ইতি টানা হয়। এরপর রবিউল হুসাইনের মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজার জন্য নেওয়া হয়। পরে তার কফিন নেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সেখান থেকে মাটি ও মানুষের কবিকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

  দেখুন ভিডিও:

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App