×

অর্থনীতি

কারসাজিতে ৩৩২ প্রতিষ্ঠান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩৯ এএম

দেশের বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে একটি মুনাফাখোর চক্র। বাজারকে অস্থিতিশীল করে এই চক্র কামিয়ে নেয় শত শত কোটি টাকা। আর এই সংকটকে পুঁজি করে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানিও করা হয়। কমদামে আমদানি করে তা বিক্রি করা হয় চড়া দামে। এসব কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় পেঁয়াজের বাজার। বিপাকে পড়েন দেশের সাধারণ মানুষ। এই চক্রের কারণে এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি বাজার। চলমান পেঁয়াজ সংকটের উৎস সন্ধানে ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা ইউনিট শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ৩৩২ আমদানিকারকের আমদানি তথ্য যাচাই করছে। এরই অংশ হিসেবে আজ সোমবার ও আগামীকাল মঙ্গলবার ৪০ আমদানিকারককে তলব করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে মূলত নিয়ন্ত্রণহীন পেঁয়াজের বাজার। এরাই মুনাফার লোভে বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। শুল্ক গোয়েন্দা আমদানিকৃত পেঁয়াজ ও বাজারে সরবরাহ প্রভৃতি তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখা শুরু করেছে। দেশের স্থলবন্দর বাংলাবন্ধা, বেনাপোল, ভোমরা, হিলি, সাত মসজিদ, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা কাস্টম হাউজ দিয়ে চলতি বছরের আগস্ট থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১৬৭ হাজার ৮০৬ দশমিক ৪৭ টন। তারপরও দামের লাগাম টেনে ধরা যায়নি। এরইমধ্যে পেঁয়াজের এই সঙ্কটের প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য ৪০ আমদানিকারককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। এদের মধ্যে ১৩ আমদানিকারককে ২৫ নভেম্বর সোমবার ও ২৭ আমদানিকারকে ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট পেঁয়াজ মজুত ছিল। কোনোভাবেই পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের গুদামে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আটকা পড়ে থাকায় বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। অতি মুনাফার লোভে অনেক ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। আবার কয়েকজন আমদানিকারক নিজেরা বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। গুদামে পেঁয়াজ পচে গেলেও তারা বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নেননি। ফলে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাজার স্বাভাবিক করতে চড়া মূল্যে বিমানের কার্গোতে করে তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। তারপরও দামে প্রভাব পড়েনি। নতুন পেঁয়াজ উঠলেও বাজার স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিক্রি বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থা আগের চেয়ে ১৫টি স্থান বাড়িয়ে এখন শুধু রাজধানীর ৫০টি স্থানে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে পেঁয়াজ বিক্রির কার্যক্রম জোরদার করেছে। সাধারণ মানুষের জন্য এই পেঁয়াজ ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও গত বছরের একই সময়ে দাম আরো কম ছিল। সূত্র আরো জানায়, শুল্ক গোয়েন্দা আমদানিকারকদের তলব করা চিঠিতে বলছে, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমদানিকৃত পেঁয়াজ অবৈধভাবে মজুত করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে মানি লন্ডারিংয়েরও অভিযোগ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছক মোতাবেক আমদানিকৃত পেঁয়াজের বিস্তারিত তথ্যসহ উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন, যারা বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে আমরা মূলত তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। এখনই কারো নাম উল্লেখ করার মতো সময় হয়নি। তথ্য-উপাত্ত ও আমদানিকারকদের বক্তব্য নিতে পারলে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। প্রমাণ পেলেই দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুল্ক গোয়েন্দার শনাক্ত করা ৪০ আমদানিকারক গত তিন মাসে ৯০০ টন থেকে ৯ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে। মূলত শুল্ক গোয়েন্দার চোখ থাকবে তাদের দিকেই। আমদানিকারকের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন মেসার্স আরএম এগ্রো, মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স দিপা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স বিএইচ ট্রেডিং এন্ড কোং, জগদিশ চন্দ্র রায়, মেসার্স সাজ্জাদ এন্টারপ্রাইজ, একতা শস্যভাণ্ডার, মেসার্স ফুল মোহাম্মদ ট্রেডার্স, মেসার্স ফারাহ ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ, হামিদ এন্টারপ্রাইজ, আলি রাইস মিল, নাচোল, খান টেডার্স, এসএম করপোরেশন, মেসার্স গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স রায়হান এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সোহা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মরিয়াম এন্টারপ্রাইজ, নুর এন্টারপ্রাইজ, শামিম এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স খান ট্রেডার্স, মেসার্স এমআর ট্রেডার্স, ডিএ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স টাটা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স হুদা এন্টারপ্রাইজ, আরডি এন্টারপ্রাইজ, জনী এন্টাপ্রাইজ, মাহি এন্ড ব্রাদার্স, মেসার্স মুক্তা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স রায়হান ট্রেডার্স, মেসার্স সাইফুল এন্টারপ্রাইজ, রিজু-রিতু এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স জাবেদ এন্ড ব্রাদার্স, মেসার্স আলম এন্ড সন্স, নিউ বড়বাজার শপিং মল, মেসার্স রচনা ট্রেডার্স, এসএস ট্রেডিং ছোট হাজি মার্কেট, সুপ্তি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ব্রাদার্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আল মদিনা স্টোর, লামাবাজার, বি কে ট্রেডার্স, ধ্রæব ফারিয়া ট্রেডার্স, মেসার্স সালাহ ট্রেডার্স, মেসার্স ফিরোজ এন্টারপ্রাইজ, সাদ ট্রেডার্স, আলিফ এন্টারপ্রাইজ প্রমুখ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের অন্যতম গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, পেঁয়াজের এই সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত বাজারের সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়টিতে। এসব সঙ্কটে যারা মুনাফাভোগী থাকেন তাদের সরকার একটি ম্যাসেজ দিতে পারে। যেহতু বিষয়টির আইনি কাঠামো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম করলে তারা খতিয়ে দেখতে পারে। এ ছাড়া, বাজার মনিটরিং কমিটি, প্রতিযোগিতা কমিশনও এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে বলে অভিমত এই গবেষকের। প্রসঙ্গত, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধান মাত্র দুই লাখ টন। বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২৩ লাখ টনের ওপরে। আর চাহিদা রয়েছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টনের। তারপরও শুধু নষ্ট হওয়ার কারণে বছরে পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে প্রায় আট থেকে দশ লাখ টন। কারণ দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩৫-৪০ শতাংশ সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর নষ্ট হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App