×

অর্থনীতি

২২ নামে ঋণ নিয়ে ১৮টিই অস্বীকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩৭ এএম

২২ নামে ঋণ নিয়ে ১৮টিই অস্বীকার

নামে বেনামে ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়েছে অ্যাননটেক্স গ্রুপ। সব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। আর এরপরই বোল পাল্টেছে অ্যাননটেক্স। ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ১৮টিই অস্বীকার করেছেন অ্যাননটেক্স গ্রুপের কর্ণধার মো. ইউনুস (বাদল)। তিনি বলেছেন, তার মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ নিয়ে তিনি আদালত পর্যন্ত গিয়েছেন। কিন্তু হাইকোর্ট তার ‘আবদার’ রক্ষা করেনি। ২২টি প্রতিষ্ঠানই অ্যাননটেক্সের বলে জানিয়েছেন আদালত। এরপরও ঋণ পরিশোধে আগ্রহী নন বাদল। বিতর্কিত অ্যাননটেক্স গ্রুপকে ঋণ সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক এখন নিজেই সংকটে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও জনতা ব্যাংক অ্যাননটেক্সকে ঋণখেলাপি করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, সার্বিক তথ্য বিশ্লেষণে অ্যাননটেক্সের কর্ণধার ইউনুছ বাদলের নেয়া ঋণের অধিকাংশই গুণগত মানে শ্রেণিকরণযোগ্য। তবে একবারে বিপুল অঙ্কের ঋণখেলাপি করলে ব্যাংকের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। যে কারণে আপাতত বস্তুগত মাপকাঠিতে ২ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার ঋণখেলাপি করতে হবে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাতুরির মাধ্যমে প্রকল্প মূল্যায়ন, এক প্রকল্প থেকে তহবিল অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর, প্রকল্পগুলো একই গ্রুপভুক্ত এবং মূল কর্ণধার একজন হলেও নতুন নতুন কোম্পানি সৃষ্টির মাধ্যমে অনেক বেশি ঋণ পুঞ্জীভ‚ত করা হয়েছে। জনতা ব্যাংকও প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি তদারকি না করায় এবং কিছু প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিনেও শেষ না হওয়ায় তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া অ্যাননটেক্সের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং পর্ষদের অনুমোদন ও তদারকিতেও দুর্বলতা ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা যায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনে অ্যাননটেক্সের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানির জন্য বিভিন্ন সময়ে এলসি খোলা হয়। এসব এলসির বিপরীতে সৃষ্ট দেনা গ্রাহকের পরিশোধ করার কথা। অথচ ব্যাংক টাকা আদায় না করে গ্রাহকের নামে ‘ফোর্স লোন’ সৃষ্টি করেছে। এমনকি মঞ্জুরিপত্রের শর্তের আলোকে গ্রাহকের কাছ থেকে এলসি মার্জিনও নেয়নি। এভাবে সৃষ্ট অনেক ফোর্স লোন খেলাপি হলেও তা আমলে না নিয়ে নতুন করে এলসি খোলা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে এই প্রবণতা দেখা গেলেও পরবর্তীতে ঋণ আদায়ের উদ্যোগ না নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ থেকে বারবার পুনঃতফসিল করে ফোর্স ঋণকে মেয়াদিঋণে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমানে শুধু ফোর্স লোনের বিপরীতে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা।

এদিকে, অ্যাননটেক্সকে অবৈধভাবে ঋণ সুবিধা দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকরা জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং পরিচালনা পর্ষদকে দায়ী করেছেন। এই দায়ে জনতা ব্যাংকের দুই পরিচালককে অপসারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে একজন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মানিক চন্দ্র দে ও অপরজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল হক।

সূত্র জানায়, অ্যাননটেক্সকে ঋণসুবিধা দিতে উদারতা দেখিয়েছেন জনতা ব্যাংকের বর্তমান এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ ও সাবেক এমডি এস এম আমিনুর রহমান। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বেশ কয়েকজন সদস্যের বিশেষ ভ‚মিকা ছিল ওই সময়। জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা, পূর্ববর্তী উৎপাদন ও বিক্রয় দক্ষতা বিবেচনা না করে শুধু প্রাক্কলিত আর্থিক বিবরণী ও কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে অ্যাননটেক্সের নতুন নতুন প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এমওইউ অনুযায়ী, জনতা ব্যাংক তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ফান্ডেড ঋণ দিতে পারে। এই নিয়মে চার হাজার ২৩৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে অ্যাননটেক্সকে সর্বোচ্চ ৪২৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার সুযোগ ছিল। অথচ দেয়া হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ।

সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে জনতা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখা থেকে প্রথম ঋণ নেয় অ্যাননটেক্স গ্রুপের জুভেনিল সোয়েটার। তখন প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ছিল এক কোটি টাকার সামান্য বেশি। পরে তৎকালীন ডিএমডি মো. গোলাম সারোয়ারের পরামর্শে ২০০৮ সালে জনতা ভবন করপোরেট শাখায় ঋণটি স্থানান্তর করা হয়। ২০১০ সাল থেকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণসুবিধা নেয়া শুরু হয়। জনতা ব্যাংক করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) হিসেবে ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন আবদুছ ছালাম আজাদ। ঋণের বড় অংশই তার সময়ে সৃষ্ট।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউনুছ বাদলের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে গ্যালাক্সি সোয়েটার্স এন্ড ইয়ার্ন ডাইং, সপ্রভ কম্পোজিট নিট, সিমরান কম্পোজিট এবং লামিসা স্পিনিংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকের পাওনা ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় বাদলের বাবা, স্ত্রী, ভাই, ভাবীসহ পরিবারের অন্যদের নাম রয়েছে। যদিও সব প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী ইউনুছ বাদল।

২২ প্রতিষ্ঠানই অ্যাননটেক্সের : বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের ওপর অ্যাননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনুছ বাদলের করা রিটটি চলতি মাসের ৭ নভেম্বর খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এর ফলে ২২টি প্রতিষ্ঠানকে অ্যাননটেক্স গ্রুপভুক্ত হিসেবে বিবেচনার নির্দেশ দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বহাল থাকল। শুধু চার প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের দাবি করে অ্যাননটেক্স গ্রুপ ওই রিটটি দাখিল করেছিল।

নথিপত্র পর্যালোচনায় জানা যায়, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর মেসার্স গ্যালাক্সি সোয়েটার এন্ড ইয়ার্ন ডায়িং-এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ২২ প্রতিষ্ঠানকে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ হিসেবে বিবেচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য জনতা ব্যাংককে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে ২২ প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি অ্যাননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনুছ বাদল এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। গত ২৬ মার্চ আদালত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত এক মাসের জন্য স্থগিত করেন। এরপর ১৯ আগস্ট উক্ত রিট শুনানির জন্য ২ সপ্তাহ সময় দেয়া হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App