×

ফিচার

বাতিঘরের ঘোর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০১৯, ০১:২০ পিএম

বাতিঘরের ঘোর

তখন আমাদের ‘ভাঙা তরী-ছেঁড়া পাল’। তখন আমরা মাঝ দরিয়ায়। ঝড়ের ঝাপটায়, ঢেউয়ের তোড়ে- দিশাহারা। তবুও আশায় বুক বেঁধে পরিত্রাণ চাওয়া। এরই মাঝে নবীন মাঝি ত্রাতার ভূমিকায়। দিগি¦দিক পথ চাওয়া মাঝিমাল্লা আবার বাতিঘরের আলোয় খুঁজে নিলো সঠিক পথের দিশা। ভাঙা তরী সারাই হলো। ছেঁড়া পাল জোড়া লাগল সৃজনশীল সীবন কর্মে। তারপর ‘পাল উড়াইয়া নৌকা গেল বাতাসে সরসর’। এমন সুন্দরের গল্পইতো আমাদের এই ফোরাম। পাঠক ফোরাম। এখানে ‘বাতিঘর’ সঞ্জীব চৌধুরী। বাকিটা আমাদের পাফোর ইতিহাস দেখে মিলিয়ে নিই। তবেই আমরা পাবো হাল ধরা মাঝিকে। পাবো নিজেকেও; গুণ টানা মাল্লাদের সারিতে। এমনই উজান বাওয়ার গল্প আমাদের এই পথচলার।

১৯৯৮-এ চেনা হলো পাফোর কালো হরফের জমিন। ’৯৯-এ লেখা শুরু। সেই সূত্রে সাংগঠনিক আড্ডায় ঢিপঢিপ বুকে মীরসরাই থেকে হাজির হই সীতাকুণ্ড গণপাঠাগারে; পাফোর আড্ডায়। মফস্বলের একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণকে দেখে সাহস দেই নিজেকে। উপত্যকায় দাঁড়িয়ে পাহাড়চ‚ড়ায় ধ্যানমগ্ন মনীষীকে প্রণাম জানাতে কী ব্যাকুলতা! তারপর কিশোর আমি যুবা হতে হতে পা রাখি ঢাকায়। পাফোর ডেরা ৫০ ময়মনসিংহ রোড (৮ লিংক রোড) বাংলামোটরে। চেনা হয় বিভাগীয় সম্পাদক (বি.স.) আরিফ জেবতিককে। দেখা হলো ছাপার হরফে চেনাজানা অনেক অনেক লেখক, সংগঠক পাফোসকে। আরিফ ভাই সেবার বিদায় দেয়ার কালে নিয়ে গেলেন ফিচার সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরীর টেবিলে। হাত বাড়িয়ে দিলেন দাদা। বি.স. আরিফ জেবতিক দাদাকে জানালেন- মীরসরাইয়ের বোরহান লিখতে শুরু করেছে পাফোয়। কাজ করতে চায় সংগঠনে। দাদা বললেন- পড়তে, লিখতে আর ফাঁকে ফাঁকে সংগঠন গড়তে। আপনি সম্বোধন করে যে দু-চার কথা বললেন তাতেই আমি তার প্রতি ভালোবাসায় আপ্লুত, শ্রদ্ধায় নত।

পরেরবার দাদার সঙ্গে দেখা হয় পাফো চট্টগ্রাম পরিবারের সতীর্থ আড্ডায়। সেখানে আমি বছরের সেরা ফিচার লিখিয়ে হিসেবে পাফো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। কী আবেগ ঢেলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলাম মনের কথা। শিল্পকলার স্টেজে আমি কথা বলছিলাম আর শেষ মাথায় পূর্বদিকের দরজায় চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাদা শুনছিলেন আমার কথা। আর দিন শেষে সতীর্থ আড্ডার সার্টিফিকেটের উল্টোপাশে অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম সঞ্জীবদার, আরিফ জেবতিক, শবনম ফেরদৌসী, আবিদা নাসরিন কলি আর অমিত হাবিবের মতো বড় মাপের মানুষদের। সেখানে দাদা লিখেছিলেন- ‘এত ভালোবাসা কোথায় রাখি?’ এতদিন বাদে যখনই সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলি, তীব্র হাহাকারে বুকটা ভার হয়ে আসে।

সহস্রাব্দ পার হয়ে আমরা ব্যস্ত হই ভিন্ন আঙ্গিকে। এক দুই তিন করে পার হয় বছর। এক সময় দাদাও ছেড়ে যান ভোকা। ততদিনে তার দেখানো পথে প্রিন্ট মিডিয়াগুলো (কী জাতীয় কী আঞ্চলিক সব নামি-দামি দৈনিক, সপ্তাহিক) পাঠকের পাতা, পাঠক সংগঠন তৈরিতে ব্যস্ত। দাদা তখন অন্য স্বপ্নের পিঠে সওয়ার। পরশপাথর সঞ্জীব চৌধুরী রাঙিয়ে গেছেন অন্য আলোয়। আমাদের মতো অভাজনের কাছে দাদার মতো মহারথীদের খবর থাকতো না। শাপলু দাকে (জয়দীপ দে শাপলু) পেলেই খবর নিতাম- দাদা কোথায় কী করছেন, কী হাল হকিকত। দিনশেষে বোহেমিয়ান স্বভাবের সঞ্জীব চৌধুরী রয়ে গেলেন দলছুটই।

এর মাঝে সাগরদার (জালালউদ্দিন সাগর) প্ররোচনায় সক্রিয় হই খেলাঘরে। কাপ্তাইয়ের কেপিএমে চম্পা কুঁড়ি খেলাঘর আসর তখনো সাড়া জাগানো সংগঠন। চম্পা কুঁড়ি খেলাঘর সম্মেলনে গুণীজন সম্মাননা দেয়ার বিষয়ে উঠে এলো সঞ্জীব চৌধুরী-বাপ্পা মজুমদারের নাম। সংকলনের লেখা প্রস্তুত করতে আমিও হাত লাগাই। সঞ্জীব চৌধুরী-বাপ্পা মজুমদারের সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি আর সম্মাননার প্রেক্ষাপট লেখার ভার পড়ল আমার ওপরই। সানন্দে রাজি হলাম। বাপ্পা মজুমদারকে সহজে ম্যানেজ করা গেলেও দাদাকে বাগে পাওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই। শেষমেশ ডেটলাইনের শেষ দিনে মধ্যরাত অবধি ফোনে কথা বলে অনুলিখন করে তবেই শেষ করা গিয়েছিল কাজটা। সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কেন সঞ্জীব দা অন্যদের চেয়ে আলাদা। কী অসীম চাপ নিয়ে তার অনুসারীরা লিখে গেছেন কিংবা লেখক হয়েছেন, সাংবাদিক হয়েছেন!

দাদার শেষ যাত্রার আগে ক’টা দিন কী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আমাদের! ততক্ষণে আমাদের কিছুই করার নেই। শুধু আবেগ নিয়ে অন্তরাত্মার মিনতি সৃষ্টিকর্তার কাছে- দাদা যেন ফিরে আসেন। না, তা হয়নি। জীবনের অমোঘ চক্র মেনে ফিরে গেলেন সঞ্জীব চৌধুরী। পেছনে রয়ে গেল তার সৃষ্টিকর্ম। সঞ্জীব দার চলে যাওয়ার একযুগ পরে তার লেখক-সাংবাদিক তৈরির কারিগর পরিচয়ের চেয়ে আজ গায়ক পরিচয়টাই অনেকে বড় করে দেখেন। অথচ এই পরিচয় অতটা স্বকীয়তা বহন করে না। এটা স্বয়ংসিদ্ধ শিল্পও নয় যতটা স্বয়ংসিদ্ধ লেখালেখি। পাঠক ফোরাম উৎকর্ষই তাকে বাঁচিয়ে রাখুক। তার যথাযথ মূল্যায়ন হোক এই উৎসে। সঞ্জীব দার সঙ্গে সামান্য স্মৃতি নিয়ে যা লিখলাম, তা বড় আস্পর্ধার কাজ হয়ে গেল। একটু দুঃসাহস না দেখালে আমরা যে বড় প্রবঞ্চক হয়ে যাই। সঞ্জীব চৌধুরী বেঁচে থাকুন যুগ-যুগান্তর।

সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা পরিবার

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App