×

ফিচার

বর্ধমানের সেই ছেলেটি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০১৯, ০২:২৫ পিএম

বর্ধমানের সেই ছেলেটি

ইমরানকে এভাবেই ফুল দিয়ে বরণ করা হয়

চলতি বছরের মার্চে নিজের উচ্চ শিক্ষা বিষয়ক কাজে গিয়েছিলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজবাড়ির প্রাচীন প্রশাসনিক ক্যাম্পাস ও নানা জাতের বৃক্ষ শোভিত গোলাপবাগের আধুনিক বিশাল একাডেমিক ক্যাম্পাস দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভালো লেগেছিল সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আর শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা দেখে। বিশেষ করে যমজ দুবোন (গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার ছাত্রী) অয়ন্তিকা ও অন্বেষার সহযোগিতার কথা কখনোই ভোলার নয়। ওদের স্মার্টফোন দিয়ে আমাকে নিয়ে ওরা ক্যাম্পাসে অনেক ছবি তুলেছিল। দেশে ফেরার পরে এ দুবোন আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়ে যায়। যোগাযোগ চলতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের এমএ শিক্ষার্থী (বর্তমানে ৩য় সেমিস্টার) শেখ ইমরান বর্ধমান বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমার বন্ধুদের বন্ধু। এক পর্যায়ে সেও আমার বন্ধু হয়ে যায়। মাঝেমাধ্যে যোগাযোগ হতে থাকে। জানতে পারি ওর বাড়ি পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ থানার দামোদর নদের দক্ষিণে খোরকোল গ্রামে। ওরা দুভাই। মা-বাবা আছেন। ইমরান জীবনে প্রথমবার বাংলাদেশে আসার ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। ওর পাসপোর্ট করতে দেয়ার কথাও জানায়। আমি ওকে আসার আহ্বান জানাই। কিছুদিন আগে ও জানায় পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা। সর্বশেষ ইমরান জানায় ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশে আসবে ও। ওর সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে ফেসবুকে কথা চলতে থাকে। সর্বশেষ ২৫ অক্টোবর রাতে ইমরানের সঙ্গে চ‚ড়ান্ত কথা হয় ও মানিকগঞ্জে আসবে। দুই/তিন দিন আমাদের বাড়িতে থাকবে।

২৬ অক্টোবর সকাল ৮টার একটু পরে বেনাপোল সীমান্ত হতে একটি ফোনকল পাই। একজন যাত্রী জানান, ইমরানকে ঈগল পরিবহনে তুলে দিলাম। এরপর আমি আর ইমরান উভয়মুখী যোগাযোগ রাখতে থাকি। সারাদিনের অপেক্ষা শেষে ঠিক সন্ধ্যায় (৫:৩০) ইমরান মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নামলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বাগতম জানাই। একটু দাঁড়িয়ে দুজনে আমাদের বাড়িতে চলে আসি। রজনীগন্ধা-গোলাপ দিয়ে ওকে বরণ করি। তারপর ফ্রেশ হতে বলি। ও দ্রুত স্নান করে। এরপরই ওকে গরম ভাত ও টুকটাক আয়োজন দিয়ে আপ্যায়নের চেষ্টা করি। ইমরান বলে, আমি কিছুই খাব না। আমি বলি, এমন কি হয়?

অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই যেন ইমরান সামান্য দুটি ভাত ও এক চিলতে ডাল খায়। ও নাকি অন্য কিছুই খায় না। এমনকি সবজিও না। খাবার পরই ইমরান ইন্টারনেটে কথা বলতে থাকে।

আমি বলি, আমার ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ও ভীষণ অস্থির হয়ে যায়। এলোমেলো কথা বলতে থাকে। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। আমি বলি তোমার কথামতো তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ডসদের জানিয়ে দিয়েছি। ওরা তোমার পরিবারকে জানিয়ে দেবে। ও বলে, ওরা তা পারবে না।

ছেলে সুপ্রিয়র সহযোগিতায় আমার স্মার্টফোন দিয়ে ওর স্মার্টফোনের ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করতে গিয়ে ব্যর্থ হই। এ পর্যায়ে ইমরান বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বাইরে গিয়ে অন্য মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে চায়। আমি বলি, চলো। ও ব্যাগ নিয়ে যেতে চায়। আমি বলি, ব্যাগ কেন?

ইমরান বলে, আমি ঢাকা চলে যাব। সেখানে আমার আত্মীয় আছে (অথচ আসার আগে বলেছিল ওর বাংলাদেশে পরিচিত কেউ নেই)। আমি বলি, একি বলছ? এখন রাত। তুমি ঢাকা চেন? একা কীভাবে যাবে? তোমার ভয় কিসের? আমাদের পরিবারের সদস্যরা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ও কাঁদতে থাকে। আমার পা জড়িয়ে ধরতে আসে। মাটিতে পড়ে যেতে চায়। বলতে থাকে, আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে যেতে দিন।

আমি দিশাহারা হয়ে পড়ি। ওর চিৎকারের শব্দে প্রতিবেশীরা চলে আসেন। উনারাও ওকে বোঝাতে পারেন না। শেষমেশ ঢাকার সেই আত্মীয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলি। তারই পরামর্শে অসহায় ফাঁসির আসামির মতো আমার কিশোর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ওকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ঢাকার উদ্দেশে পদ্মা লাইন পরিবহনে তুলে দেই (সন্ধ্যা ৭:৩০)।

বাস ইমরানকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে চলে যায়। বিধ্বস্ত মনে বাপ-ব্যাটা রিকশায় নিশ্চুপ বাড়ি ফিরে আসি। বেদনার অশ্রু কোনোভাবেই থামাতে পারিনি। ভাবতে থাকি, এ-কী হলো? পড়শিদের আলোচনা চলতে থাকে। আমাদের মতো প্রতিবেশীরাও ইমরানের নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কায় থাকেন। রাত সাড়ে ১০টায় মোবাইল ফোনে ইমরানের ঢাকা পৌঁছানো নিশ্চিত হই।

এদিকে মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ইমরানকে নিয়ে আমার যাবতীয় পরিকল্পনা। আমার পরিকল্পনা মতে, আজ (যখন আমি বেদনার কাব্য লিখছি) আমার ইমরানকে নিয়ে ঢাকায় কাটানোর কথা। ওকে ওর কাক্সিক্ষত বাংলাবাজার দেখাব। দেখাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আসতে-যেতে দেখাব আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জে ফিরে আসব। আরো দুযেক জায়গায় যাব। এজন্য কলেজে তিন দিনের ছুটির জন্য আগেই বলে রেখেছিলাম। আমাকে আর ছুটি নিতে হলো না!

অবশ্য আমার এসব ভাবনার কথা সাক্ষাতে ইমরানকে বলার সুযোগও পাইনি। ইমরানের জন্য আমার লেখা কয়েকটি বই ও অন্যান্য কিছু প্রকাশনা গুছিয়ে রেখেছিলাম। সেগুলো ওকে দেয়া হলো না। বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের জেলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি ও ট্রেজারারকে ডেকে ওকে লেখক সংঘের পক্ষ থেকে অভিনন্দিত করতে চেয়েছিলাম। তাও করা হলো না।

ইমরান সাংবাদিকতা বিষয়ের ছাত্র। তাই ওকে নিয়ে মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবে একটি সন্ধ্যা কাটাতে চেয়েছিলাম। মানিকগঞ্জের শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালীগঙ্গা নদীর ধারের আন্ধারমানিক গ্রামের শতবর্ষী পাখির অভয়ারণ্য ইমরানকে দেখাতে চেয়েছিলাম। ওর সঙ্গে ক্যাম্পাসভিত্তিক আলোচনা করে ভারত-বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে তুলনামূলক একটি প্রবন্ধ লিখব বলে ভেবেছিলাম। নিজ পাড়ায় ওকে নিয়ে ঘুরতে চেয়েছিলাম। কিছু বাজার করেছিলাম ওকে খাওয়ানোর জন্য। তা খাওয়ানো হলো না।

বিদায় বেলায় ইমরানকে কিছু উপহার দিতে চেয়েছিলাম। তাও পারলাম না। ওকে নিয়ে মিলনসহ বেতিলার ঐতিহ্যবাহী রাসের মেলা ও জমিদার বাড়িতে বেড়ানো হলো না। আমার ইচ্ছেগুলো অপূর্ণই রয়ে গেল। জানতেও পারল না আমার ইচ্ছেগুলোর কথা। হয়তোবা এখনো নিরাপদে ওর আত্মীয়ের কাছে ঢাকায় আছে। হয়তো আজ রাতে নয়তো কাল বর্ধমানে চলে যাবে। হয়তো এক সময় বাংলাদেশের ছোট্ট শহরের একজন নগণ্য মানুষের কথা জীবনের ব্যস্ততায় ভুলেও যাবে। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশীরাও হয়তো একদিন এ কথা ভুলে যাবেন।

কিন্তু আমি কি ভুলতে পারব- ওকে জিজ্ঞাসা করা সে কথা, ইমরান তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি কি টেরোরিস্ট? আমাকে দেখ। ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, আমার দিকে তাকাও। আমার ওপর ভরসা রাখ। তোমার দেশ, তোমার জেলা, তোমার বিশ^বিদ্যালয়, তোমার বিভাগ এ কথা জানলে কি বলবে? তুমি-আমি দুটি দেশের প্রতিনিধি। সবাই বলবে ছি! ছি!

তবুও আমার বন্ধু আমার ছাত্রসম ইমরান আমাকে বুঝল না। ও চলেই গেল। মাত্র দুঘণ্টায় সব তছনছ হয়ে গেল। গত দুরাতে সামান্য ঘুমিয়েছি। অল্প খেয়েছি। কিছুতেই ভুলতে পারছি না- ইমরানের অসহায় ক্রন্দন, আমার কাছ থেকে মুক্তি চাওয়ার দুর্বিষহ দৃশ্য। এ ট্রমা থেকে এ জীবনে আদৌ বের হতে পারব কিনা জানি না। তবুও চাই, যে ইমরানকে আমি চিনতাম সে ইমরান নিরাপদে স্বদেশের স্বজনদের কাছে ফিরে যাক। দামোদর নদের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াক। ও ভালো থাকুক। নির্ভয়ে থাকুক। নিরাপদে থাকুক।

আহবায়ক, ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম, মানিকগঞ্জ

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App