সার্কের স্বার্থেই রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার করতে হবে
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০১৯, ০৪:৪৯ পিএম
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থা সার্কের স্বার্থের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। আঞ্চলিক স্বার্থ তথা সার্কের স্বার্থের জন্য রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার করতে হবে। সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা যদি আন্তর্জাতিকভাবে সমাধান না হয় তাহলে এ অঞ্চলে শিগগিরই বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক জঙ্গি, মৌলবাদী কর্মকাণ্ড শুরু হবে। যা থেকে ভারত, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ বাদ পড়বে না।
শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সকালে রাজধানীতে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ১৯৭১-এর গণহত্যা, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে সামনে রেখে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার আন্তর্জাতিক সমাধান করতে হবে। না হলে বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশগুলো আক্রান্ত হবে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ দ্বারা। এছাড়া দেশে একাত্তরের মৌলবাদ যে এখনও বিদ্যমান, তা বোঝা যায় সম্প্রতি হলি আর্টিজনের হামলার মধ্য দিয়ে। একাত্তরের গণতহ্যা, হলি আর্টিজন এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার সবগুলোই যেন একই সূত্রে গাঁথা।
‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী পর্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ভারতের সাংবাদিক ও লেখক হিরন্ময় কার্লেকার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চলনা করেন কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক। স্বাগত বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক শিল্পী হাশেম খান।
দুইদিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনারে ভারত, ইতালি, তুরস্ক, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, যুক্তরাজ্য থেকে ৫০ জন বিশেষজ্ঞ গবেষক যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া সারাদেশ এসেছেন শতাধিক গবেষক।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কে এম খালিদ বলেন, একাত্তরে খুব কাছ থেকে গণহত্যা দেখেছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় একটি মাত্র উপজেলার ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭টি বধ্যভূমি রয়েছে। একটি বধ্যভূমিতে ১৬৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের নাম ঠিকানা আমাদের কাছে রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের সুন্দরী ডোবায় শত শত মৃতদেহ আটকে থাকতো।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, সার্কের স্বার্থেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার আন্তর্জাতিকভাবে সমাধান না হলে এ অঞ্চলে শিগগিরই বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক জঙ্গি, মৌলবাদীদের কার্যক্রম শুরু হবে। যা থেকে ভারত, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ বাদ পড়বে না।
মুনতাসীর মামুন আরো বলেন, এই সম্মেলনে আমরা আশা করবো রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে। যদি আমরা পাকিস্তানিদের বিচার করতে পারতাম তাহলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এ কাজ করার সাহস পেতো না। সেজন্য আমরা মনে করি ঘাতক খুনিদের বিচার হওয়া উচিত। আজ বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ পাকিস্তানিদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে গেলে আমরা পাকিস্তানিদের বিচার করতে পারবো।
এই ইতিহাসবিদ আরো বলেন, একাত্তরে এ রাষ্ট্র গড়ে উঠার পথে কত মানুষের কান্না, কত মানুষের জীবন দিতে হয়েছে। বহু পথ পেরিয়ে আমরা ঘাতকদের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি। এটি এখনও চলছে। তবে একটি দুঃখ আছে আমরা এখনও পাকিস্তানি বাহিনীর বিচার শুরু করতে পারিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখে যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে উল্লেখ করে মুনতাসির মামুন বলেন, আমাদের বিজয়ের ইতিহাসের পাশাপাশি গণহত্যার ইতিহাস বলতে হবে। খালেদা-নিজামী ক্ষমতায় থেকে নতুন প্রজন্মকে সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমরা সব সময়ই গণহত্যাকারীদের বিচার চেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে সেই বিচার কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে।
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, বিশ্বজুড়ে যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে তার বিরুদ্ধে মানুষ সচেতন হবে। তরুণ প্রজন্ম গণহত্যাকারীদের রুখে দিতে শক্তি সঞ্চয় করবে। একই সঙ্গে তরুণরা গণহত্যার সহযোগী ও সহায়তাকারীদের প্রত্যাখ্যান করার সাহস পাবেন।
কর্ম অধিবেশন -১ এর সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ না হলে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বেশিদিন বাংলাদেশে অবস্থান করলে তাদের জঙ্গি সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ শুধু বৃদ্ধি পাবে। পাকিস্তানের আইএসআই, আল-কায়দা ও আইএস এই অঞ্চলে জিহাদের ক্ষেত্র প্রসারিত করবে। যার অভিঘাত থেকে বাংলাদেশ, বার্মা, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, রাশিয়া, কেউই মুক্ত থাকবে না। তার মতে, নিজেদের বিপদ বুঝতে পারলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও সক্রিয় হবে।
ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক হিরন্ময় কালেকার বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে সঙ্গে নিয়ে দেশ পুনর্গঠন করতে চাইলেও সেটি পারেননি। বরং তাকেই স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। যার ধারাবাহিকতায় একই গোষ্ঠী গুলশানে হোলি আর্টিজানে ১০ জন নারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। যার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এ জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতির হ্মেত্রে উন্নয়ন করে ওই গোষ্ঠীর মনোজগতে পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
মিয়ানমারের মানবাধিকারকর্মী খিন জ উইন বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ সমস্যা মোকবেলা করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপরে এ ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এই সমস্যা বেশিদিন জিইয়ে রাখা ঠিক হবে না।
প্রথম দিনের ৬টি অধিবেশনে ২৮ জন গবেষক তাদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেমিনারে আরো বক্তব্য দেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ভারতের জওহরলাল বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক ড. জয়তি শ্রীবাস্তব, তুরস্কের লেখক, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ফেরহাত আতিক।