×

মুক্তচিন্তা

বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি কোথায়?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম

‘বিকল্প’ শক্তি গড়ে তোলার জন্য বামপন্থিদের নিরলস ও নিরন্তর প্রয়াসের বাস্তব ফলাফল এখনো সেভাবে দৃশ্যমান করে তোলা যায়নি। তা রাতারাতি হওয়ার কথাও নয়। এর কারণ হলো যে ‘রুগ্ণ রাজনীতি’ চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে, তার ফলে সৃষ্ট দূষিত পরিবেশে সুস্থধারার রাজনীতি অগ্রসর করা শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, সময়সাপেক্ষও বটে। এমন হওয়াটি খুবই স্বাভাবিক।

আমাদের দেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল আছে। রাজনৈতিক দলের নাম এবং সংখ্যা আসলে কত সেটা বলা খুব কঠিন। যারা রাজনীতি করেন, রাজনীতি চর্চা করেন, রাজনীতি নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, তারাও বলতে পারবেন না দেশে সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় প্রকৃত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কত! নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যাই হয়তো ডজন চারেক। এর বাইরে অনিবন্ধিত দলও আছে। শতাধিক রাজনৈতিক দলের নাম মনে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও দেশের রাজনীতি মূলত চলে দুই ধারায়। মোটা দাগে এর একটি হলো আওয়ামী লীগ ধারা, অন্যটি হলো আওয়ামী লীগবিরোধী ধারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি পেয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছরেও আওয়ামী বড় দলের শিরোপা ধরে রাখতে পেরেছে, এটা কম কথা নয়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিল, একচেটিয়া ভোট পেয়েছিল। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আওয়ামী লীগবিরোধীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আসন না পেলেও মুসলিম লীগ, জামায়াত এবং আওয়ামী লীগবিরোধী অন্যরা কিন্তু ভোট পেয়েছিল। ৩০ শতাংশের মতো ভোট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগবিরোধী মানুষের সংখ্যা আরো কিছু বেড়ে গিয়েছিল। কারণ যারা সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন, তারা সবাই পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে ছিলেন না। সব বাঙালি স্বাধীনতার পক্ষে বলে আমরা একটি ভুল ধারণা দীর্ঘদিন ধরেই পোষণ করে আসছি। স্বাধীনতা না চাওয়ার পক্ষেও অনেকেই ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা ধরনের উত্থান-পতন হয়েছে। স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার যে মূল আকাঙ্ক্ষা- গণতন্ত্র এবং সামাজিক বৈষম্যহীনতা- সেখান থেকে দেশ সরে এসেছে। পাকিস্তানের মতো স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক শাসন জেঁকে বসেছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের বড় ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করলেও স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা রাজনীতির একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে হয়েই থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশের রাজনীতি বিযুক্ত থাকতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপকেই মনে করা হতো। কিন্তু সেটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য। আওয়ামী লীগ থেকে কিছু নেতাকর্মী বেরিয়ে গিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করলে রাজনৈতিক সিনারিও বা চালচিত্র দ্রুত বদলে যায়। তীব্র মুজিববিরোধিতার কারণে জাসদ দ্রুতই আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। মুজিব হত্যার পর রাজনীতির যে উল্টোযাত্রা শুরু হয় তার অভিঘাতে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য বদলে যায়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগবিরোধী নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। বিএনপি এই শক্তির নেতৃত্বে। সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতি ধাবিত হয় নীতিহীনতার দিকে। রাজনীতি আর মানবকল্যাণের ব্রত না থেকে স্বার্থ হাসিলের বাহনে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে কোন পক্ষ বেশি শক্তিশালী সেটা এখন এক বড় রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়।

আওয়ামী লীগের যে রাজনীতি তার পক্ষে কিছু রাজনৈতিক দল আছে। আবার আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিও এক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অনেক দল এবং দলে দলে দলাদলি। ক্ষমতা এবং ভোটের হিসাব মাথায় রেখে শুরু হয়েছে জোটের রাজনীতি। এখানেও এক জোটের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, আরেক জোটের নেতৃত্বে বিএনপি। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতির মূল দুই শক্তি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এই দুই দল কিংবা দুই দলের নেতৃত্বাধীন জোট এরশাদ পতনের পর থেকে পালাক্রমে সরকার গঠন করে আসছে। এরশাদ ক্ষমতা দখল করেও একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন। এরশাদের দল জাতীয় পার্টিও কিছুদিন বড় দল হিসেবেই ছিল। তবে এখন জাতীয় পার্টি আর বড় দল নেই। আমাদের রাজনীতির এক নষ্ট চরিত্র এরশাদও জীবিত নেই। জাতীয় পার্টি এখন আওয়ামী লীগের ক্ষমতার রাজনীতির পিলার হয়ে টিকে আছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকবে বলে যে ধারণা মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, এখন সম্ভবত তা কাটতে শুরু হয়েছে। গত তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আছে। কেমন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরছে সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও চরম বাস্তবতা এটাই যে, ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে মিত্রহীন, একা করার জন্য বিএনপি কম চেষ্টা করেনি। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যও বিএনপি সম্ভব-অসম্ভব সব চেষ্টাই করেছে। সফল হয়নি। বিএনপির এখন বড় দুঃসময়, বড় দুর্দিন। রাজনীতির কৌশলের খেলায় বিএনপি আওয়ামী লীগের কাছে পরাজিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা কমবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির রাজনৈতিকভাবে কাছাকাছি আসার সুযোগ কম। কতগুলো মূল বিষয়ে ফয়সালা বা সমঝোতা না হলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বিরোধ অব্যাহতই থাকবে।

দেশে এখন এমন অনেক মানুষ আছেন যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটি নতুন বা এই দুই দলের বিকল্প একটি রাজনৈতিক দল বা শক্তির উত্থান কামনা করেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার কথাও বহু বছর থেকেই শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির রাজনীতিকে অপরাজনীতি বা রুগ্ণ রাজনীতি আখ্যা দিয়ে সুস্থ ধারার রাজনীতির স্লোগান দিয়ে ড. কামাল হোসেন গণফোরাম নামে একটি দল গঠন করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দাঁড়াতে পারেননি। সুস্থ রাজনীতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার পরিবর্তে কামাল হোসেন এখন রুগ্ণ রাজনীতির সহযোগী হয়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি হুঙ্কার দেন, আর বাকি সময় কীভাবে কাটান, বলা মুশকিল।

এটা ঠিক, মানুষের সঙ্গে কথা বললে বড় দুই রাজনৈতিক দল সম্পর্কে নেতিবাচক কথাই বেশি শোনা যায়। এদের দিয়ে ভালো কিছু হবে না বলেও কিন্তু এই দুই দলের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেন না। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি নয়- যারা এই কথা বলেন তারাও শেষ পর্যন্ত ভোট এলে ভাগ হয়ে পড়েন এই দুই দলের মধ্যেই। যারা ভারতবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক তাদের বিএনপির পক্ষ নিতে সমস্যা হয় না। কিন্তু যারা একটু উদার, গণতন্ত্রমনা তাদের পক্ষ বাছতে সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়েন কিংবা ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকেন। বিরত থাকা বা নিষ্ক্রিয় থাকা কিন্তু কার্যত অপরাজনীতিকেই টিকিয়ে রাখার নামান্তর।

এক সময় বামপন্থি রাজনীতির একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বামপন্থিদের একটি অংশ সিপিবি দৃশ্যমান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় তথা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পর বামপন্থি রাজনীতিরও শক্তিক্ষয় হতে হতে এখন তা আর চোখে না পড়ার অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তারা ছোট থেকে ছোট হচ্ছে কিন্তু তাত্ত্বিক বিতর্কে বিভক্তি কমছে না। কে প্রকৃত বাম আর কে নকল বাম তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝে ওঠা সহজকাম্য নয়। এক সময় চীনা বামরা নিজের আসল এবং মস্কো বামদের ‘ঝুটা’ বলে দাবি করত। এখন হয়েছে উল্টোটা। যাহোক, সিপিবির তরফ থেকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে ‘আপদ’ এবং ‘বিপদ’ আখ্যা দিয়ে একটি প্রকৃত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির স্লোগান তুলে মাঠে নামতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেই বাম বিকল্প প্রায় তিন দশকেও ‘শিশু কাল’ অতিক্রম করতে পারেনি। বিকল্প শক্তি তো দূরের কথা সব বাম দলই এক হতে পারে না। বামদের ঐক্য আলোচনা শুরু হলে বুঝতে হবে তাদের কোনো অংশ আবার ভাঙনের দিকে যাবে। সিপিবি-বাসদের ঐক্য হতে গিয়ে বাসদ ভেঙেছে। তবে এটা ঠিক, বামপন্থিরা অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে সুদিনের অপেক্ষা করছে। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সম্প্রতি একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, “নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তথাকথিত ‘মূলধারা’র বাইরে নিজেদের স্বাধীন অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে নীতিনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদসহ বামপন্থি দলগুলো। তারা ‘বাম গণতান্ত্রিক জেট’ গঠন করে সেই ‘মূলধারা’র আগ্রাসী আধিপত্যকে খর্ব করে দেশে একটি ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প’ গড়ে তোলার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। বহুমাত্রিক ও প্রবল প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে বিকল্প গড়ার লক্ষ্যে ‘চলতি হাওয়া’র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। ‘বিকল্প’ শক্তি গড়ে তোলার জন্য বামপন্থিদের নিরলস ও নিরন্তর প্রয়াসের বাস্তব ফলাফল এখনো সেভাবে দৃশ্যমান করে তোলা যায়নি। তা রাতারাতি হওয়ার কথাও নয়। এর কারণ হলো যে ‘রুগ্ণ রাজনীতি’ চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে, তার ফলে সৃষ্ট দূষিত পরিবেশে সুস্থধারার রাজনীতি অগ্রসর করা শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, সময়সাপেক্ষও বটে। এমন হওয়াটি খুবই স্বাভাবিক। কারণ কথিত ‘মূলধারা’র সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ভাটির টানে পথ এগোনো সহজ হলেও স্রোতের উজানে এগিয়ে যাওয়া কিংবা এমনকি সেই অবস্থায় একই জায়গায় টিকে থাকতে পারাটাও শতগুণ বেশি কষ্টসাধ্য।”

প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা সেলিমের বক্তব্য থেকেই এটা স্পষ্ট যে, তাদের বিকল্প রাজনৈতিক ধারা দৃশ্যমান হওয়ার আশু কোনো সম্ভাবনা নেই। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখেই হয়তো অনেককে আরো বহুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।

বিভুরঞ্জন সরকার: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App