×

সাময়িকী

যে রাতে আমার স্ত্রী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:১৪ পিএম

যে রাতে আমার স্ত্রী
পর্ব- ১

যে রাতে আমার স্ত্রী/সাবেক স্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন ডিভোর্স চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সাবেক স্ত্রী বলা ঠিক হবে না, তাই কি লিখব বুঝতে পারছিলাম না। শবনমকে স্ত্রী বলারও সুযোগ নেই, বলতে চাচ্ছিও না। ডিভোর্স নোটিশের পর নব্বই দিন পার হতে আরো তিন দিন বাকি। আমরা না-স্বামী না-স্ত্রী এমন একটা ট্র্যানজিশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। শবনমই বলেছে, এর চেয়ে ডিভোর্সই কি ভালো নয়? আমিও বলেছি, অবশ্যই। যথেষ্ট হয়েছে। শবনমের ব্যস্ততা এতোটাই বেশি যে তালাক চূড়ান্ত হতে যে মাত্র তিনটি দিন বাকি সম্ভবত এ খেয়ালও তার নেই।

সরকার শপথ নিয়েছে এক বছর সাত মাস একুশ দিন আগে। সবাই বলেছে ভালো সরকার হয়েছে, বুড়ো ও তরুণের একটি চমৎকার ব্যালেন্স করা হয়েছে; চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ তুলনামূলকভাবে কম। সরকার কেমন হয়েছে এ প্রশ্নে বিরোধী দলও মিনমিন করে বলেছে ভালোই বলতে হবে। দেখা যাক কেমন সার্ভিস ডেলিভারি দেয়। দু’একজন আনকোরা রাজনীতিবিদকেও মন্ত্রী করা হবে এমন একটা গুঞ্জন ছিল। সিএনএনকে দেওয়া খুব সংক্ষিপ্ত একটি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি তার কেবিনেটে ‘ফ্রেশ ব্লাড ইনফিউজ’ করবেন। আরো বলেছেন, নারীর প্রতিনিধিত্বও বাড়াবেন। গুঞ্জন শুরু হয়েছিল শবনব মেহনাজ চিশতিকে নিয়ে। অন্তত দু’টি দৈনিক ও তিনটি ট্যাবলেয়েড সম্ভাব্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে শবনমের নাম আছে। শবনম নিজেও ভেবেছে, ব্যাপারটা ঘটতেও তো পারে। শবনব বেশ কড়া স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, স্যুটটা বানাতে তোমাকে অন্তত সাতবার বলেছি। কাপড়টা এখনো আলমারিতে পড়ে আছে। আমি বলি শীতকাল এগিয়ে আসুক, তখন না হয় বানাবো। অবশ্য আজকাল তো তেমন শীতও নামে না। স্যুট পরে গরম লাগে, অস্বস্তিও। শবনব বলল, বড় আপু কী ভাববে? সেলাইর পাঁচ হাজার টাকাও তো আমার হাতে গুঁজে দিয়ে গেছে। স্যুট পিস দিয়েছে লায়লা তাবাসসুম চিশতি, শবনমের বড় আপু। সুইডেন থেকে ফেরার পথে দুবাই-এ ট্র্যানজিট নেয়, কাপড়টা দুবাই থেকে কেনা। শবনব বলল, তোমার পুরোনো স্যুটটাই লন্ড্রিতে দিয়ে এসো। স্যুটের কী দরকার? যদি বঙ্গভবনে যাবার ডাক পড়ে তোমাকে যেতে হবে না! আমি যে শপথ নিয়েছি তোমাকে তার চাক্ষুষ সাক্ষী হতে হবে না? চাক্ষুষ সাক্ষী মানে কি? শবনমকে জিজ্ঞেস করি। যে সাক্ষী নিজের চোখে দেখেছে। আমি বললাম, চাক্ষুষ সাক্ষী কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৭২-এর সাক্ষ্য আইন পড়োনি? নোটবই কেটে এলএলবি পাস করেছি। আইনের বই খুলে দেখিনি। তাছাড়া উকিল কিংবা হাকিম হবো এটাও কখনো ভাবিনি। অনেকেই এলএলবি পরীক্ষা দেয়, আমিও দিয়েছি। এলএলবি’র কারণেই শবনম আমাকে আইনের কথা শোনায়। আমি বললাম তার মানে আমি যদি চাক্ষুষ চাক্ষী না হই তা হলে প্রেসিডেন্ট তোমাকে শপথ পাঠ করাতে রাজি হবেন না- তুমি কি এ রকম একটা কিছুই বোঝাতে চাইছো? শবনব বলল, তোমাকে তা বোঝাতে যাব কেন? আমি অন্তত তিনজন মহিলার নাম বলতে পারি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার সময় যারা বিধবা ছিলেন। আর একজন তো বিয়েই করেননি। কই, কোনো প্রেসিডেন্ট তো বলেননি, আপনার হাজব্যান্ড নেই, আমি দুঃখিত। বাট আই অ্যাম আনডান। বঙ্গভভনে হাজব্যান্ডসহ না এলে আমি শপথ পাঠ করাতে পারব না। আমি বললাম, তার মানে তোমার কথাতে স্পষ্ট হাজব্যান্ড কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। তাছাড়া থাই এয়ারের কাঠমান্ডু ক্রাশে আমার তো বাঁচার কোনো কথাই ছিল না। ক্রু আর প্যাসেঞ্জার ৯৩ জনের ৮৯ জনই যেখানে নিহত, আমার তো তাদেরই একজন হবার কথা ছিল। এটাই মিরাকল যে আমি ৪ জনের একজন। শবনব ফোঁস করে উঠল, তুমি ৮৯ জনের একজন হলেই ভালো হতো। তুমি দিলে তো আমার মেজাজটা খারাপ করিয়ে। প্লেন ক্র্যাশে তুমি মরলে আমি স্ট্রেইট প্রেসিডেন্ট স্যারকে বলতে পারতাম, সরি স্যার, আমি উইডো। আমি বললাম, দেখো শবনম, যেদিন তোমাদের দলের সরকার শপথ নেবেন প্রেসিডেন্ট সাহেব এসব খেজুরে আলাপ করার সময়ই পাবেন না। এটা ঠিক প্রেসিডেন্টের কাজকর্ম তো প্রধানমন্ত্রীর কাজের মতো এতো বিশাল নয়। তবুও সেদিন তো ব্যস্ত থাকবেন। তুমি চিন্তা করো না। আবদুর খালেক যদি তোমার শপথ গ্রহণের চাক্ষুষ সাক্ষী না হয় তাতে তোমার শপথ নেওয়া ঠেকে থাকবে না। সাক্ষ্য আইনের কথা বলছ, তুমি আমার মতো নোট বইয়ের পাতাকাটা এলএলবি নও, ঢাকা ইউনির্ভাসিটির এলএলবি অনার্স, এলএলএম সেটা তো আমার জানাই আছে। তবুও স্ত্রীর শপথে স্বামীর চাক্ষুষ সাক্ষ্যের গুরুত্ব দিয়ে কোথাও একটি শব্দও লেখা নেই। আমি পাইনি। তুমি পেয়ে থাকতে পারো। শবনব বলল, তার মানে তুমি বঙ্গভবনে যাবে না? আমি জানতাম তুমি তাই করবে। তাহলে সাধাসাধি করছো কেন? শবনব বলল, ইতর! ছোটলোক! আমি মন্ত্রী হয়ে আমাকে তোমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে, এটা তোমার সহ্য হচ্ছে না। সহ্য হবে না কেন? একশ বার হবে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হলেও হবে। মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী হবার পর ডেনিস থেচার কি তা সহ্য করেননি, অবশ্যই করেছেন। শবনব, সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, সাবধান। আর একটা কথাও বলবে না, এক্ষণি আমার মাইগ্রেনের পেইন শুরু হবে। আমি আর একটি কথাও বলব না। আমি চাই না শবনব মাইগ্রেনের ব্যথায় ভুগুক। আমার মাইগ্রেন নেই, তবুও আমি জানি, ব্যথাটা ভয়ঙ্কর। শবনমের বেলায় বমিও হয়, চোখে ঝাপসা দেখে। আর যাতে কথা বলতে না হয় আমি বিনা প্রয়োজনে বাথরুমে ঢুকে পড়ি। শবনব এখন বেরিয়ে যাবে। অনেক ব্যস্ততা তার। এর মধ্যে নিগোসিয়েটর হিসেবে শবনব দলীয় প্রধানের আস্থা অর্জন করেছে। মহিলা দলের ভেতর পুরোনো দলীয় কর্মী এবং কয়েকটি রজানৈতিক দলের সাথে আসা কর্মীদের বিরোধ সাময়িকভাবে হলেও শবনবই মিটিয়েছে। আইনের মেধাবী ছাত্রী শবনব কথার প্যাঁচে ফেলে বিদ্রোহী কর্মীদের দমন করে। পার্টি নিয়ে তার আঠার ঘণ্টার ব্যস্ততা। তার কোনো ডে অফ নেই। দু’একদিন না দেখলেই দলের প্রধান জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার হাওয়া হয়ে গেলে নাকি? আমার দিনের কাজ শুরু হয় দশটায়। শবনমের আরো আগে। বেরোবার সময় প্রতিদিন আমাকে ভালোমন্দ দু’কথা বলে যায়। ভালো কথাই বেশি। দু’একটা ভালো কথার উদাহরণ দিই : ১. তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, কুড়ি টাকা বাঁচানোর জন্য এই গরমে হেঁটে অফিসে যাবে না। রিকশা নিল, হুড উঠিয়ে রেখো। মুখটা তো পুড়িয়ে ফেলেছ। একবার আয়নার সামনে দাঁড়াও না কেন? এক কথা ক’দিন বলব? ২. অনন্তীকে দেখে আমি জেলাস হয়ে উঠছি। মুখ দিয়ে লালা আর নাক দিয়ে অবিরাম সর্দিঝরা চার বছরের মেয়েটা এগার বছর পর কী যে সুন্দর হয়েছে। এবার আমি মেয়েটাকে পালমোলিভ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নামাবোই। ৩. ঘুমের মধ্যে এমন ঘো ঘো শব্দ করো কেন? আমি প্রফেসর সাব্বিরকে তোমার কথা বলেছি। সিরিয়াল লাগবে না। শুধু আমার কার্ডটা ভেতরে পাঠালেই তোমাকে ডেকে নেবেন। প্রথম বা তৃতয়টি আমাকে যতোটা সন্তুষ্ট করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে দ্বিতীয়টি। আমি খুব আশ্বস্ত বোধ করেছি। অবন্তী আমার মেয়ে। একা আমার হয়, আমার ও ঋতুর। সুন্দরের যদি কোনো শক্তি থেকে থাকে তাহলে মানতেই হবে ঋতু শবনমের চেয়ে ফের বেশি শক্তিশালী আর বুদ্ধিমত্তার যে শক্তি তাতে ঋতু শবনমের কাছ মার খাবে। অবন্তীর বয়স যখন চার বছর এক মাস আমি ঋতুকে হারাই। সৎ মা এলে মেয়েটাকে উপেক্ষা করতে পারে, বিভিন্ন ছুতোয় মারধর করতে পারে, মেজাজ বেশি খারাপ হলে গলা টিপে দমটা বের করে নিষ্প্রাণ বাচ্চাটাকে ময়লা ফেলার কালো পলিথিনে ভরে সিটি কর্পোরেশনের গাটেজ ভ্যানে তুলে দিতে পারে। আমি তাই তার জন্য সৎ মা আনার কথা ভাবিনি।

কাছাকাছি থাকলে, দেখাসাক্ষাৎ হলে, টুকটাক কথাবার্তা বললে একটা সময় নিজেদের ব্যাপারে কিছু কথা এমনিতেই জানাজানি হয়ে যায়। শবনব আমার স্ত্রীহীন জীবনের কথা জেনেছে এবং নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে কিছুটা সহানুভূতিপ্রবণ হয়ে উঠেছে। শবনব সরাসরিই বলল, আপনার কি একজন স্ত্রী চাই? চাইলে বলুন, নাদেরা আপনাকে একটু টোকা দিয়ে দেখি। রাজি হতে পারেন। অবশ্য আপনি রাজি কিনা সেটাও তো একটা ব্যাপার। আমি বলি, শুনুন শবনম, যদিও নাদেরা নামটা বড্ড সেকেলে, আমার এই আবদুল খালেক নামটা তার একটুও পছন্দ নয়। তার বাবার একজন কুঁজো ভৃত্য ছিল- আবদুল খালেক নাম। আমার নামটা শুনলে কিংবা আমাকে দেখলেই সেই কুঁজো আব্দুর খালেকের কথা তার মনে হয়। কোনো সন্দেহ নেই নাদেরা খুবই ভালো, কিন্তু টোকা দিয়ে লাভ নেই। আমিও নিজের ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাই না। কেন, নাদেরা আপার হয়ে কেউ আপনাকে এর মধ্যেই প্রস্তাব দিয়েছে নাকি? না কেউ দেয়নি। আমি নিজ থেকেই ভেবেছিলাম। তাই নাকি? যে-ই হোক আমার অবন্তীর ব্যাপারে ফিলিংসটা কেমন, মানে একটা পজেটিভ এটা না বোঝা পর্যন্ত কারো ব্যাপারেই সিদ্ধান্তে পৌঁছা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শবনম বলল, আবদুর খালেক নাম আর মেয়ে অবন্তী- এই তো সমস্যা? অবন্তীর বয়স কতো বলুন তো? এখস চার বছর দশ মাস। পুরো নয় মাসের মা-ছাড়া জীবন। শবনব বলল, ভাবতে দিন, একটা না একটা সলুশন বেরিয়ে আসবে। আমাকে তিন দিন মানে তিন চব্বিশে বাহাত্তর ঘণ্টা সময় মঞ্জুর করুন। আমি বলি, সমাধান বের করতে বাড়তি চাপ নিতে যাবে না। আমি আবারও সংসার করার কথা ভাবিনি এমন নয়। অবন্তী আর একটু বড় হোক, আর একটু বুঝতে শিখুক। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমাদের এসব কথা হয় প্রোলেতারিয়েত একাডেমির চা-ঘরে। এটারই নাম চা-ঘর। চায়ের সাথে ডালপুরি হয়। আদা পেঁয়াজ সর্ষের তেলে মুড়ি বানিয়েওে দেওয়া হয়। এক চিলতে জায়গাতে চা-ঘর। একটা টেবিল আর চারটে চেয়ার। শবনমের সাথে এবং নাদেরার সাথেও এখানেই আমার দেখা, পরিচয় কথাবার্তা। দু’জনেরই বড় গুণ তারাও পালা করে সপ্তাহে একদিন বাসা থেকে পিঠা, নুডুলস, পায়েশ এবং ফালুদাও নিয়ে আসেন, আমরা খাই, ধন্যবাদ দিই। শবনমই বলেন, নাদেরা আপার বাবা যে প্রোপার্টি রেখে গেছেন তাতে কয়েক জীবন পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারতেন। নাদেরা বলেন শবনমেরই বা কম কি? আমার তো কেবল বাড়ি ভাড়া, দোকান ভাড়া। শবনম পাচ্ছে ব্যবসায়ের লাভ। শবনমের আবার কিসের ব্যবসা? ভিক্টোরিয়া পার্কে দক্ষিণে টায়ার টিউবের বড় দোকান। চাইনিজ টায়ারের ডিলার চিশতি সাহেব। চিশতি এন্টারপ্রাইজ। শুধু টাকা আর টাকা।

 

(চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App