×

জাতীয়

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত শুধু কাগজ কলমেই!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ১১:০৯ এএম

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত শুধু কাগজ কলমেই!

রাজধানীতে চিহ্নিত কয়েক হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। ঝুঁকির মধ্যেই চলছে বসবাস ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম। কার্যকর হয়নি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্নের সিদ্ধান্ত। বাতিল হয়নি হোল্ডিং নম্বর। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাজধানী এবং আশপাশে ৩৯টি ভবনে টাঙানো ‘অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ডও খুলে গেছে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এ নিয়ে রশি টানাটানির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত শুধু কাগজ কলমেই। অবৈধ অংশ বা ভবন অপসারণে কারো তৎপরতা না থাকায় অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের ঝুঁকি রয়েই গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠকে রাজধানীর অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবন অপসারণ করতে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনগুলোর বর্তমান পরিস্থিতির একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সাত কার্যদিবসের মধ্যে জমা দিতে রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং বাড়ির হোল্ডিং নম্বর বাতিলসহ মোট ১২টি সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে ওই বছরের ১৮ মে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়। এর অনুলিপি রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা দপ্তর প্রধানদের দেয়া হয়। চিঠিতে ভবনগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সেগুলো ভেঙে ফেলে অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি ভবনগুলোর হোল্ডিং নম্ব^র বাতিল করতে বলা হয়। কিন্তু তা শুধু কাগজে কলমে। বাস্তবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

এদিকে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকার অগ্নি ঝুঁকিতে থাকা সব ভবন, মার্কেটগুলোকে চিহ্নিত অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর ধারাবাহিকতায় গত ১ এপ্রিল থেকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ভবন মালিক ও সাধারণ জনগণকে সতর্ক করতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয়। ব্যানারে লেখা হয় ‘ভবনটি অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ’। ঢাকা মহানগরী ও আশপাশে এলাকার ৩৯টি ভবনে এ ধরনের ব্যানার টাঙানো হয়।

ফায়ার সার্ভিস যেসব ভবনে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যানার টাঙিয়েছিল সেগুলো হচ্ছে- মিরপুরের ২০তলা আবাসিক ভবন ‘সুকন্যা টাওয়ার’, এলিফ্যান্ট রোডের ‘গোল্ডেন টাওয়ার’, ‘নূর ম্যানশন গাউছিয়া মার্কেট’, সিদ্দিকবাজারের ‘হাজী মিলন টাওয়ার’, গুলিস্তানের ‘বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স’, ওয়ারীর ‘সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতাল’, মগবাজারের ‘রাজ্জাক শপিং কমপ্লেক্স,’ ‘গুলফিশান ও আড়ং কমপ্লেক্স,’ সাতরাস্তার ‘ছায়ানীড় আবাসিক ভবন’, ‘নয়ামাটি মার্কেট’, পাটুয়াটুলী রোডের ‘রহমতউল্লাহ ম্যানশন’, ইসলামপুর রোডের ‘খাঁন প্লাজা’, ‘লায়ন টাওয়ার’, চিত্তরঞ্জন রোডের ‘ইস্ট বেঙ্গল মার্কেট’ এবং ‘মায়াকাটারা মার্কেট।’

সাভারের ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত ভবনগুলো হলো- বাসস্ট্যান্ড এলাকার জাতীয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সংস্থা শপিং কমপ্লেক্স, চৌরাঙ্গী সুপার মার্কেট, হেমায়েতপুর সুপার মার্কেট, সাভার সিটি টাওয়ার ও বিসমিল্লাহ টাওয়ার। গাজীপুরের অগ্নি ঝুঁকিতে থাকার ভবনগুলো হচ্ছে- ভোগড়ার ওয়াসিফ নিট কম্পোজিট লিমিটেড, চান্দনা চৌরাস্তার সাসটেক্স বিডি লিমিটেড, মে ফ্যাশন লিমিটেড, শাপলা ম্যানশন, রহমান শপিংমল, টঙ্গী বাজারের সোনালি অর্কিট ও হাজী মার্কেট। নারায়ণগঞ্জের অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় রয়েছে- ডিআইটি বঙ্গবন্ধু রোডের নয়ামাটি মার্কেট, রূপগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেট, দেওভোগ মার্কেট, উকিল পাড়ার হোঁশিয়ারি মার্কেট, টান বাজারের আল জয়নাল প্লাজা, রিভারভিউ কমপ্লেক্স, নয়ামাটি এলাকার টর্কিড প্লাজা, সিরাজউদ্দৌলা এলাকার দেলোয়ার টাওয়ার, জাকির টাওয়ার, পুলিশ লাইনের হাজি নূরউদ্দিন টাওয়ার, চাষাঢ়ার আল হাকিম টাওয়ার ও মার্ক টাওয়ার।

এদিকে রাজউক গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দুই লাখ ৪ হাজার ভবনের ওপর জরিপ চালায়। এই ভবনগুলো ৩তলা বা তার বেশি উচ্চতার। ওই জরিপ অনুযায়ী, প্রতি ১০টি ভবনের ৯টিই অনুমোদন ও নকশার বাইরে তৈরি করা হয়েছে। ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬টি ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৫টি ভবন নিয়ম ভঙ্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে। শতকরা হিসেবে এটা ৬৬ দশমিক ১১ ভাগ। ২০১২ সালে ফায়ার সার্ভিস, ডেসা, ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন দেয়া ১১২টি ভবনে বুয়েটের করা গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র দুটি ভবন তাদের সব নির্মাণ নীতিমালা মেনেছেন। বাকিরা কোনো না কোনো নিয়ম এড়িয়ে গেছেন।

অবশ্য গত সোমবার রাজউকের জোন-৪ এর আওতাধীন নিকেতনে ৬নং রোডে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ১৫ নম্ব^র হোল্ডিংয়ের কার-পার্কিংয়ের স্থলে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত একটি অফিস উচ্ছেদ করা হয়। এ ছাড়া ২১ নম্ব^র হোল্ডিংয়ের মালিককে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই রোডের ১ নম্ব^র হোল্ডিংয়ে রাজউকের অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় করে অবৈধভাবে ক্যান্টিলিভার বর্ধিত করে নির্মাণরত ১০তলা ভবনের মালিককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

ড্যাপের ২০১৬ সালের জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে ৭ তলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবন আছে ১৬ হাজার ৯৩০টি। স্বাভাবিক নগরায়ন ও উন্নয়নের কারণে গত দুই বছরে এর সংখ্যা আরো ১০-১৫ ভাগ বেড়েছে। আইন অনুযায়ী এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ঢাকাসহ সারাদেশে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ হাজার ২৪টি ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশের বেশি বহুতল ভবনের ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেই। গত বছর ফায়ার সার্ভিস ৫ হাজারেরও বেশি ভবনকে নোটিস দেয়। কারণ তাদের ফায়ার সিস্টেম নেই বা কার্যকর নয়।

এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, প্রতিমাসে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি জানতে চাওয়া যায়। প্রাপ্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পরবর্তী নির্দেশনা দেয়া হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে রাজউককে দেয়া হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের একটি অ্যাকশন টিম রয়েছে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে অনেক ভবনে ব্যবসা ও বসবাস চলছে। এর মধ্যে মালিটোলা, নিউমার্কেট, শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারের অনেক ভবন উল্লেখযোগ্য।

রাজউক চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ বলেছেন, অনেক ভবন মালিককে নোটিস করা হয়েছে। অনেক স্থানে উচ্ছেদ অভিযান চলছে। তবে নিয়ম না মেনে তৈরি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ সবই সুউচ্চ ভবন। বিশেষ করে ভবনগুলো ১০তলার উপরে। এসব ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেছেন, ফায়ার সার্ভিসের কোনো বিচারিক ক্ষমতা নেই। এ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করলেও কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না।

প্রসঙ্গত, গত ২৮ মার্চ দুপুরে বনানীর এফ আর টাওয়ারের ২২তলা ভবনের ৮তলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। পুড়ে অঙ্গার হয় ২৬ প্রাণ। এরপর ঢাকার অনুমোদনহীন ভবন চিহ্নিত নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App