×

সাময়িকী

গ্যাম্বলার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৫২ পিএম

গ্যাম্বলার

সন্ধ্যে মেলানোর সাথে সাথেই আলো ফিকে হতে শুরু করে। বিকেলের রোদ নরম হতে থাকে, নরম আলো ফিকে হতে থাকে। এই দৃশ্যটুকু সবচেয়ে ভালো উপভোগ করা যায় সমুদ্রের ধারে। আমি এখন এমনই এক সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটিও। লাল কার্ডিগান পরা ভাবলেশহীন চেহারা। চুলগুলো উড়ছিল তার। সূর্যের শেষ কিরণটুকু চুলে পড়তেই কেঁপে উঠলো মেয়েটি। আহা! সন্ধ্যা নেমে আসুক দ্রুত। সবার জীবনে সোনালি বিকেলের গল্প থাকে না, কেউ কেউ একাকী প্রতিটি সন্ধ্যার গল্প মধ্যরাতের জন্য জমিয়ে রাখে। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউগুলো পায়ের পাতা ভিজিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষায় আছি সূর্যটার ডুবে যাওয়ার। এইতো আরেকটু সময়...

‘হ্যালো, মাই চাইল্ড! গল্প শুনতে চাও?’ কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করা আগন্তুকটির দিকে চমকে তাকালাম। নীল চোখের এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স আশির কাছাকাছি। শুভ্র চুলগুলো উড়ছিল। অদ্ভুত শান্ত চোখ তার। মৃদু হেসে সম্বোধনের ভঙ্গিতে বললেন আবারও, ‘তুমি আমাকে আন্ট মার্টিনি বলে ডাকতে পারো। আমি এই দ্বীপের সব গল্প জানি। তুমি চাইলেই শুনতে পারো, মাই চাইল্ড!’ স্প্যানিশ ভাষায় বলে গেলেন তিনি। বোঝাই যাচ্ছে স্প্যানিশে তেমন দক্ষ নন। অবশ্য আমিও খুব একটা ভালো নই স্প্যানিশে। ইংরেজিতেই কথা বলে কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি বেশিরভাগ সময়। কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন অনেক আগন্তুকই ঘুরে বেড়ায় চারদিকে দ্বীপগুলোয়। তারা গল্প শোনায়, গল্পের বিনিময়ে কিছু ডলার বা ইউরো নিয়ে কেটে পড়ে। আজকাল গল্প কেউ শোনে না। সমুদ্রের তীরে এলে গল্পেরাও হারায় কোথায় যেন। সমুদ্র মানেই অদ্ভুত শূন্যতা। পকেট থেকে ফাইভ ইউরো বের করে নিঃশব্দে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে দিলাম। হাঁটতে শুরু করলাম সমুদ্রের দিকে আবারও। বৃদ্ধা খুব সহজভাবে নিলো ব্যাপারটা। যেন অনেকেই এর আগে এরকম করেছে, টাকা দিয়েও গল্প না শুনে চলে গেছে। মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। এখানেই তো ছিল। লাল কার্ডিগানটাই মনে আছে শুধু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। সূর্যের শেষ কিরণ নেই আর। সন্ধ্যে নেমে গেছে। আকাশে এখন শুধু বেঁচে আছে কিছু আলোর রেখা, মনে হয় রঙের পোচ মেরে দিয়েছে কেউ। সময় হয়ে এসেছে ফিরে যাবার। আন্ট মার্টিনিকে আর কোথাও দেখলাম না। দেখতে পেলে জিজ্ঞেস করতাম সে সমুদ্রের কোনো গল্প জানে কিনা। তাহলে তার মুখের ভাব কেমন হতো? সমুদ্রের কি আদৌ কোনো গল্প হয়? সমুদ্র থেকে ফেরার পথে বীচের এক কোনায় জুয়া খেলারত এডওয়ার্ডকে দেখতে পেলাম। বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ মিলে ভালোই আসর বসিয়েছে। তার বয়স ষাট পেরিয়ে সত্তরের ঘর ছুঁয়েছে এক দশক আগেই। কিন্তু সমুদ্র আর জুয়া তাকে প্রাণবন্ত রেখেছে ভালোভাবেই। সস্তা মদের বোতলে চুমুক দিতে দিতে চিৎকার করে ডাকলেন তিনি, ‘নীতু, গ্যাম্বলিং-এ আজ ভাগ্যটাকেই বাজি রেখেছি। এই বীচে এমন কোনো বাস্টার্ড এখনো জন্মায়নি যে এডওয়ার্ডকে গ্যাম্বলিং-এ হারায়! লিটল ডগস, রোল দ্য ডাইস!’ মদ্যপ এডওয়ার্ডের প্রলাপ শুনে হাসি পায় আমার। পাগল বুড়োটা রোজ হারে। আর ফলস্বরূপ তার বাজি রাখা শেষ সম্বল মদের বোতলটাও নিয়ে চলে যায় তারা। বেচারাকে তখন নিঃস্বভাবে ধূসর চোখে বসে থাকতে দেখা যায়। তবুও রোজ খেলে সে। জীবনকে যে একবার খুঁজে নিতে শেখে যেখানে, সেখানেই রোজ আশ্রয় খোঁজে। সে জানে, জুয়াই তার জীবন এখন। শেষ বয়সে হয়তো জীবন আর ঠিক ভুলের হিসাব রাখতে চায় না। হাতে রাখা বিয়ারের অর্ধেক ক্যানটা নীরবে ওর পাশে রেখে চলে এলাম ওকে পাশ কাটিয়ে। যার জীবনে হারাবার কিছুই নেই আর, তাকে বোধহয় খুব সহজেই একটা সামান্য মদ বা বিয়ারের বোতলে কিনে নেয়া যায়। এডওয়ার্ড বুড়োটার সাথে আমার মোটামুটি পরিচয় থাকলেও তার অতীত সম্পর্কে আমি জানি না। হয়তো আর দশটা ভবঘুরে বুড়োর মতোই হবে তার গল্পটা। আচ্ছা, আন্ট মার্টিনি কি জানেন এদের গল্প? এরা কি এই দ্বীপ, এই সমুদ্রের অংশ নয়? কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো সুদর্শন স্প্যানিশ যুবক দিয়েগোর সাথে। গিটারে কি একটা সুর তোলার চেষ্টা করছে। ট্যুরিস্টদের কেউ কেউ তার গান শুনে সামনে রাখা টুপিটাতে অবহেলায় ইউরো ফেলে যায়। সন্ধ্যে মেলানোর পর দিয়েগোকে সেই ইউরোগুলো গুনতে দেখা যায়। এক হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তখন ওর চোখ দুটো। গিটারে আর কত সুর তুললে অসুস্থ ছোট বোনের হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করানো যাবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। অথচ, ছোটবেলায় গানকে কতই না ভালোবাসতো ছেলেটা। বাবার কাছে কান্নাকাটি করে গিটারের জন্য জেদ ধরেছিল। স্কুল থেকে ফিরে রোজ বাবার চোখে চোখ রেখে উত্তর খুঁজত সে। সামনের ক্রিসমাসে তার বাবা সেই স্বপ্নটুকু পূরণ করে দেন ঠিকই, কিন্তু কিছুদিন পর বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে সেই স্বপ্নটুকু পেশায় বদলাতে বেশি সময় নিলো না। জীবনে আপন বলতে সেই এক ছোট বোনই। হয়তো কোনো এক হসপিটালে পাঞ্জা লড়ছে মেয়েটি মৃত্যুর সাথে। একে একে ট্যুরিস্ট কমতে শুরু করে দিয়েছে। রাত নামার সাথে সাথে নির্জনতা ভর করতে থাকে। সমুদ্রের গর্জন আরো জোরালো হয় তখন। বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট তখন ক্লাবে গিয়ে পাড়ি জমায়, মেতে ওঠে বারবনিতাদের সাথে। উদ্যম পোল ডান্সে মদের গ্লাস হাতে তারা তখন যৌনতা খুঁজে বেড়ায়, আর্ট না। আজ ক্লাবে শোরগোল একটু বেশিই। কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম সেই লাল কার্ডিগান পরা মেয়েটিকে এখানে দেখে। হাতে মদের গ্লাস নিয়ে আনমনে বসে আছে বারের টেবিলে। চোখ দুটো মায়ায় আচ্ছন্ন। তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে হাতে ধরে রাখা গ্লাসটির দিকে। ওইটুকু গ্লাসে নিজের প্রতিফলন কতটুকু ফুটে ওঠে আর! কোথায় যেন দুটো বারবনিতা ঝগড়া বাঁধিয়েছে এক ব্রিটিশ যুবকের সাথে। হয়তো দামে বনছে না তাদের। বারের স্টেজে তখন স্প্যানিশ গায়করা অতি প্রাকৃত এক লুলবিজে গেয়ে চলেছে। মন দিয়ে গানের কথাগুলো ধরার চেষ্টা করলাম। ‘মিয়ে নিনা তিয়েনে সুইনঁ বেনদিতো সিইয়া, বেনদিতো সিইয়া।’ লাল কার্ডিগান পরা মেয়েটি হাসার চেষ্টা করলো। সুরে সুর মিলিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করলো গুনগুনিয়ে, ‘বেনদিতো সিইয়া, বেনদিতো সিইয়া’ তন্ময় হয়ে গান শুনছিলাম। সম্বিৎ ফিরলো তীব্র চিৎকারে। মুহূর্তেই শোরগোল থেমে গেল। মাটিতে লুটিয়ে আছে মেয়েটি, লাল কার্ডিগানে এলোমেলো শরীরটা। হাতে গুঁজে রাখা একটি কাগজের টুকরো। মেয়েটির নাড়ি পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন যে অ্যাডভিল ২০০ মিলিগ্রাম ওভারডোজ নেয়ার কারণে এই আকস্মিক মৃত্যু মেয়েটির। এক প্রকারের ড্রাগ বলা হয় একে। মেয়েটির মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এখন। তাকে দেখলে এই মুহূর্তে মনে হবে মৃত্যু খুবই সুন্দর কিছু। মেয়েটির হাতে রাখা কাগজটি নিয়ে আমি আমার ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। পুলিশ এসে তার ডেডবডি সরিয়ে ফেললো ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই। সিম্পল! আত্মহত্যার কেইস এটা। নো সাসপেক্টস! ধীরে ধীরে ক্লাবের পরিবেশ ফিরতে শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটি যেখানে পড়ে ছিল সেখানে একদল ছেলে এখন একজন বার ড্যান্সারকে ঘিরে নাচছে। ঘড়িতে সময় এগারোটা সাতচল্লিশ। সমুদ্র এখন শান্ত আগের চেয়ে। দূর-দূরান্তের হোটেলগুলোয় আলো জ্বলছে। তবুও এই সমুদ্র এখন আঁধার। এডওয়ার্ড বুড়োটা বসে আছে এক কোণে নীরবে। আনমনে বিয়ারের খালি ক্যান নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মদের বোতলটি নেই কাছে আর। ধূসর চোখ দুটো হেরে যাওয়ার গল্প বলে যায়। দিয়েগো সমুদ্রের কিছু দূরে গিটার হাতে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে আছে। সেও কি হেরে যাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে? সমুদ্রের গর্জনও সেই নীরবতার প্রহরের কাছে হেরে যায়। সমুদ্রে পা রাখতেই একটা ছোট ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিলো। অদূরে ক্যাথলিক চার্চের ঘড়িতে ঘণ্টা বাজিয়ে বারোটা বাজার সংকেত দিচ্ছে। সমুদ্রের গর্জন আর ঘড়ির ঘণ্টা মিলে অদ্ভুত রহস্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এই মুহূর্তটাকে। আন্ট মার্টিনিকেও দেখতে পেলাম। নীরবে বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে গেলাম। শুভ্র চুলগুলো উড়ছিল তার সমুদ্রের মাঝে। তার পাশে বসে রইলাম। এডওয়ার্ড ঘুমিয়ে পড়েছে বালিতেই। ছেঁড়া কম্বল গায়ে জড়িয়ে, দোমড়ানো হ্যাটটা মাথায় দিয়েই স্বপ্নের জগতে পাড়ি জমিয়েছে পাগলাটে বুড়োটা। দিয়েগোকেও দেখতে পাচ্ছি না আর বীচে। আন্ট মার্টিনি চুপচাপ বসে আছেন সমুদ্রের তীরে। আকাশে চাঁদটা বিশাল আজ। জোছনার আগুন লেগেছে গোটা দ্বীপে। আমি জানি, মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর আসবে আবার। দিয়েগো আবারও গিটারে সুর তুলে বীচে ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করবে। এডওয়ার্ডকেও দেখা যাবে চুরি করা কোন এক মদের বোতল বাজি লাগিয়ে গ্যাম্বলিং করতে করতে হো হো করে হাসতে। আন্ট মার্টিনিও হয়তো গল্পশ্রোতাদের খুঁজে বেড়াবেন ধীর পায়ে। যদি সমুদ্রেরও নিজস্ব জীবন থাকতো, তবে সেই জীবনের অধিবাসী হতো এরা। পকেট থেকে মেয়েটির হাতে গুঁজে রাখা কাগজটি বের করলাম। জোছনার অস্পষ্ট আলোয় গোটা গোটা অক্ষরে কাউকে একটা ছোট চিঠি লেখা সেখানে। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার কয়েকটি লাইন, To my loved one, ‘I often see flowers from a passing car, That are gone before I can tell what they are.’ -‘Valentina’ মধ্যরাত ক্রমে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমুদ্রের গর্জনও। চিঠিটি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। জলে মিশে গেল কাগজের টুকরোগুলো। ভ্যালেন্টিনা নামক মেয়েটির কথাটি হয়তো অজানা সেই প্রাপক কোনোদিনও জানতে পারবে না। মৃদু হেসে আন্ট মার্টিনির দিকে তাকালাম, ইংরেজিতে বললাম- ‘এই মধ্যরাতে আপনাকে একটি গল্প শোনাবো, শুনবেন?’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App