ক্ষমতার রাজনীতি ও কাশ্মির সংকট
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৩২ পিএম
কিাশ্মিরের রাজনৈতিক নেতাদের থেকে শুরু করে সচেতন নাগরিকদের ঢালাও গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন-নিপীড়ন হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। বেছে বেছে যুবকদের ধরে নিয়ে নির্জন স্থানে নির্যাতন ও হত্যার নানা সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতার দোহাই দিয়ে জাতি-আন্দোলনগুলোকে কঠোর হস্তে দমন করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের শাসক দল বিজেপি জোট সংসদে একক সংখ্যাধিক্যের দাপটে সংবিধান পরিবর্তন করে কাশ্মির রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত এবং কাশ্মিরি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার হরণ করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করেছে। অনিবার্যরূপে এটিকে সেনাশাসনই বলা যায়। কাশ্মিরের রাজনৈতিক নেতাদের থেকে শুরু করে সচেতন নাগরিকদের ঢালাও গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন-নিপীড়ন হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। বেছে বেছে যুবকদের ধরে নিয়ে নির্জন স্থানে নির্যাতন ও হত্যার নানা সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। কাশ্মিরের সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। হিন্দু-মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, ব্রাহ্ম, পারসিসহ অসংখ্য ধর্মাবলম্বীর বাস ছিল ভারতবর্ষে। তেমনি ছিল এবং আছে অসংখ্য জাতি। যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ সম্পন্ন হয়েছিল সেটি জাতি-পরিচয় আখ্যায়িত করা হলেও সেটা ছিল সংখ্যাধিক্য হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের বিভাজনে দেশভাগ। জাতি প্রশ্নের মীমাংসা ভারতীয় নেতারা অতীতেও করেনি, আজো নয়। জাতি প্রশ্নের অমীমাংসার কারণেই জাতি-বিদ্বেষ, জাতি সমস্যা রয়েই গেছে। সে কারণে জাতি ধ্বংসের নানা অঘটন পাকিস্তানে এবং ভারতে ক্রমাগত ঘটেই চলেছে। বিচ্ছিন্নতার দোহাই দিয়ে জাতি-আন্দোলনগুলোকে কঠোর হস্তে দমন করা হচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে কুলাবে না বলেই সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিজেপি সরকার ভারতের সরকারি ভাষা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। যার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভাষার মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রদর্শনে নেমে পড়েছে। সন্দেহ নেই ভারতের অপরাপর আঞ্চলিক ভাষার মতো হিন্দিও আঞ্চলিক ভাষাই। অনেক রাজ্যে আবার জাতি-আন্দোলনকে উসকে দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী ফায়দা হাতানোর নানা কৌশল প্রয়োগ করে এসেছে। কেন্দ্রীয় শাসনকে সুসংহত এবং নিরবচ্ছিন্ন রাখার অভিপ্রায়ে রাজ্য সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টিতে কেন্দ্রীয় সরকার একদিকে জাতি-বিদ্বেষকে উসকে দিচ্ছে আবার বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে কঠোর হস্তে দমন-পীড়নও করে এসেছে। রাজ্য সরকারগুলোকে অনুগত এবং আজ্ঞাবহ রাখার অভিপ্রায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা কুশলী পদক্ষেপ নতুন কিছু নয়। কেন্দ্রীয় শাসক দল যেসব রাজ্যে ক্ষমতাসীন নয় সেসব রাজ্যেই নানা সংকট সৃষ্টি করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নানা অপকীর্তি করে চলেছে। ভারতীয় সংবিধান কেন্দ্রীয় সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করেছে। রাজ্যগুলোর ওপর প্রায় সর্বাধিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য ভারতীয় সংবিধানই কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়েছে। সেই সাংবিধানিক আধিপত্য এ যাবৎকালের সব কেন্দ্রীয় সরকারই সময়-সুযোগে প্রয়োগ করে এসেছে। আসামে বসবাসরত বাঙালিদের সংকট বহুকালের। ১৯০৪ সালে মওলানা ভাসানী আসামে আসেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৭ সাল অবধি আসামের অধিকার বঞ্চিত বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি যুক্ত থেকেছেন। জমিদার-ভূস্বামীরা যখন ইচ্ছা তখন অভিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত। মওলানা ভাসানী আসামের ভাসানচরে আসাম-বাংলা প্রজা সম্মেলনের মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে হলেও সাধারণ অভিবাসী প্রজাদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ১৯২০ সালে আসাম সরকারের প্রবর্তিত লাইন প্রথার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। আসামের বঞ্চিত বাঙালিদের সংগঠিত করে গঠন করেন ‘আসাম চাষি মজুর সমিতি’। এই সমিতির মাধ্যমে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন সংঘটিত করেন। ১৯৩৭ সালে সর্বপ্রথম আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার মওলানা ভাসানী সদস্য নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে কুখ্যাত লাইন প্রথাবিরোধী বিল উত্থাপন করেন। ওই বছরই লাইন প্রথার বিরুদ্ধে কংগ্রেস সরকারের নির্লিপ্ত ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন। ১৯৪২ সালের ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা আসাম প্রজা সম্মেলনে তিনি কঠোরভাবে সরকারকে জানিয়ে দেন, ৩১ মার্চের মধ্যে ‘লাইন প্রথা’ বিলুপ্ত না করা হলে এপ্রিল মাস থেকে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। সরকার বিপদ বুঝতে পেরে এক বছরের জন্য মওলানা ভাসানীর সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু আইন জারি করেও তাকে দমন করা সম্ভব হয়নি। মওলানা ভাসানীর চাপে ১৯৪৩ সালের ২৪ আগস্ট ‘লাইন প্রথা’কে কিছুটা শিথিল করে সরকারি নির্দেশ জারি করা হয়। ১৯৮৫ সালে কংগ্রেস সরকারের শাসনামলে স্বাক্ষরিত আসাম চুক্তিতেই আসামে (এনআরসি) জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির কথা উল্লেখ ছিল। সেই মতে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ রাত ১২টার পূর্বে যারা রাজ্যে বসবাসের প্রমাণ দিতে পারবেন, তাদেরই ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে। পরবর্তী সময়ে অসমীয়দের এই দাবির পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়ার কারণেই বিজেপির আসামে জনরায়ে রাজ্যে সরকার গঠন করা সহজ হয়েছিল। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত চুক্তির ওই ধারাকে বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রদান করেন। ওদিকে কেন্দ্রের শাসক দল হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সারা ভারতে নাগরিকপঞ্জি তৈরি ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। নাগরিকত্ব বিলে সংশোধন আনতে বদ্ধপরিকর কেন্দ্রীয় সরকার। তারা বলছে এবং চাইছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে। অপরদিকে মুসলিম অবৈধ অভিবাসীদের ভারত থেকে বিতাড়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চূড়ান্ত এনআরসি তালিকায় আসামে বসবাসকারী ১৯ লাখ মানুষের নাম নেই। এই ১৯ লাখের মধ্যে ১২ লাখই হিন্দু, বাকিরা মুসলমান। চূড়ান্ত তালিকাই বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকপঞ্জি বাস্তবায়নে খোদ বিজেপিতেই এখন অনীহা-শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দলটির ভেতরেই বিভক্তি-বিভাজন ক্রমাগত প্রকাশ পাচ্ছে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহসহ বিজেপি নেতারা বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে ক্রমাগত বলতেন, অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। সম্প্রতি গৌহাটি সফরে অমিত শাহ কিন্তু একবারো বলেননি অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার কূটনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি যাতে না হয় সেই অভিপ্রায়ে তিনি কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মাসে দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে একাধিকবার জানিয়েছে, আসামের এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করও ঢাকা সফরে এসে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।’ বিজেপির অনেক নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ না করে বরং বলছেন ওটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বক্তব্য। দল ও সরকারের বক্তব্য স্পষ্ট যে, ভারতের সব রাজ্যে এনআরসির মাধ্যমে অবৈধ অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। গত ১২ আগস্ট কলকাতায় এক জনসভায় অমিত শাহ বলেছেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা বিপদ, না বিপদ নয়? ভারতজুড়ে সন্ত্রাসের মূলেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা। বোমা ফাটিয়ে ভারতের শান্তি-স্থিতি বিনাশে তৎপর এসব অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানোই উচিত।’ অমিত শাহ বারবার বলে এসেছেন, ‘কোনো হিন্দুকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হবে না’। স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা সব হিন্দুকে ভারতের নাগরিকত্ব দেবেন। এর বাইরে যারা আছে অর্থাৎ মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক তাদের অবশ্যই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।’ আসামসহ ভারত থেকে কিন্তু হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো হবে না। বিজেপি সরকারের এই ঘোষণায় আসাম থেকে ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলনকারী অসমীয়রা ভীষণভাবে রুষ্ট। তারা বলছে, বিজেপির এই বক্তব্য আসাম চুক্তির চরম লঙ্ঘন। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের অভিবাসী প্রসঙ্গে কট্টর অবস্থানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বহু বিতর্কিত ট্রাম্পের বক্তব্যের অমিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা তো সত্য যে মানব সভ্যতার বিকাশ ওই অভিবাসীদের আগমনের মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিল। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন না ঘটলে ভারতের সভ্যতার বিকাশ এ পর্যায়ে ঘটা সম্ভব হতো না। তুর্কি, মোগলদের আগমনও ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে নিশ্চয় অগুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কাজেই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যতই স্বপ্ন দেখুক না কেন বাস্তবে সেটা সম্ভব হবে না। কেননা ভারত যেমন এক জাতির দেশ নয়, তেমনি একক সম্প্রদায়েরও নয়। ভোট এবং ক্ষমতার রাজনীতি এক রাষ্ট্রাধীন ভারতকে বিভক্তির পর্যায়ে নিয়ে যায় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।