×

মুক্তচিন্তা

এদের শাস্তি হবে না কেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৭ পিএম

মজুতদার, অস্বাভাবিক মুনাফাবাজরা কি অপরাধী নয়, সমাজবিরোধী, পণ্যবিরোধী তৎপরতার জন্য কি এদের বিচার হওয়া উচিত নয়? একটি বড়সড় বিচার বিভাগীয় পেঁয়াজ তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত নয় সরকারের? শেষ কথা হলো, ঘটনায় মুনাফাবাজির প্রমাণ মিললেও এক লাফে মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে আমদানি সত্ত্বেও এক লাফে দাম কমছে না। কেন, আমরা কি রহস্য জানতে পারি?

সমাজের একটা অলিখিত রীতিনীতি, নিয়মকানুন আছে যার মাধ্যমে তার স্থিতিশীলতা রক্ষিত হয়। লেনদেনে বড় কথা সততা, যৌক্তিকতা। সেটা সমাজের সব শ্রেণির জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, অবশ্য পালনীয়। ব্যবসার ক্ষেত্রটিও ভিন্ন নয়। ব্যবসায়ী কেনাবেচায় লাভ করবে, এটা স্বাভাবিক। তবে কখনো স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে না। বৃহৎ ব্যবসায়ী, আমদানিকারক থেকে খুচরা ব্যবসায়ী যার যার স্তরে পণ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সে নিয়ন্ত্রণেরও পূর্বোক্ত রীতিনীতি আছে। সেখানে কয়েকটি শব্দ সমাজ বিরোধিতা, দেশ বিরোধিতার শামিল। যেমন মজুতদারি, মুনাফাবাজি, কালোবাজারি, চোরাকারবার ইত্যাদি। সামাজিক নিয়মে দেশের প্রচলিত আইনেও এগুলো অন্যায় ও অপরাধ। এগুলো যে অপরিসীম লোভ-লাভের মুনাফাবাজি থেকে জন্ম নেয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যবসায় লাভ বা মুনাফা শব্দটি যুক্তিগ্রাহ্য হলেও তা অসততায় যুক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তাকে বলা হয় মুনাফাবাজ, যা লভ্যাংশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কাজেই পূর্বোক্ত মজুতদারি, মুনাফাবাজি কিংবা কালোবাজারিতে বাজার অস্থির করে শুধু ভোক্তাদের আর্থিক স্বার্থই নষ্ট করা হয় না, শাসনযন্ত্রের জন্য বিব্রতকর অবস্থা ও অস্থিরতার অবস্থা সৃষ্টি করা হয়। কোনো পণ্যের দাম যদি অযৌক্তিকভাবে আকাশছোঁয়া অবস্থায় পৌঁছে, তবে তার যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সমাজে, ব্যক্তিমানসে তৈরি হয় তা যেমন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, তেমনি শাসনযন্ত্র তথা সরকারের বিরুদ্ধেও যায়, যা কোনো সরকারের কাম্য নয়, কারোরই কাম্য নয়। বিষয়টা খাদ্যপণ্য হলে তা আরো স্পর্শকাতর।

দুই. এবার পেঁয়াজ নিয়ে দুম করে মূল্যবৃদ্ধির যে ঘটনা ঘটেছে তা শুধু সংবাদপত্রমহলই নয়, ভোক্তামাত্রেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমনকি তার অবাঞ্ছিত ঢেউ লেগেছে শাসনযন্ত্রেও। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বার কয় এ বিষয়ে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। প্রথমবারের কথা- আমার রান্নাঘরে পেঁয়াজ নিষিদ্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু তাতে হুঁশ হয়নি মুনাফাবাজ সিন্ডিকেটের। পেঁয়াজের দাম কয়েক দফায় বেড়েছে কয়েকশ শতাংশ, অবিশ্বাস্য ঘটনা। হিসাব নিতে গেলে সে ইতিহাসের চিত্রটা ভয়ানকভাবে আপত্তিকর ও যুক্তিহীন, বাজারের স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির নিয়মবহির্ভূত। যেমন বাজারের সুস্থির অবস্থায় পেঁয়াজের দাম ছিল খুচরায় কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা বাজারভেদে। হঠাৎ তা কী জাদুমন্ত্রে বেড়ে ৮০ টাকায় পৌঁছে গেল। সেখান থেকে প্রথমে ১০০ টাকা, তারপর কয়েক দিনের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি দেড়শ-দুশ থেকে আড়াইশতে পৌঁছে গেল। ব্যবসায়ীদের প্রতি আমাদের প্রশ্ন- এটা বাজারের স্বাভাবিক চেহারা, না অন্য কিছু? এমনটা ঘটতে পারে, একমাত্র মুনাফাবাজির পরিকল্পনাতেই। বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য, লেখালেখি, বিশ্লেষণ কম হয়নি। কোনোটাই ব্যবসায়ীদের পক্ষে যায়নি। পেঁয়াজের এই অবিশ্বাস্য আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির দায় সব বিচারেই ব্যবসায়ীদের কারসাজি বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ অভিযোগের পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। সেই কারণ বিশ্লেষণ বা উল্লেখের আগে আমরা কৃষিপণ্যের উৎপাদন, হ্রাসবৃদ্ধি, বাজার ও প্রভাব সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলে নিতে চাই। সেই সংশ্লিষ্টদের দায় ও কর্তব্য সম্পর্কে। দেশের আবহাওয়া, খরা-বন্যার মতো বহুবিধ কারণে বিশেষ পণ্যের উৎপাদনে যদি চাহিদার অনুপাতে ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সরকার থেকে বৃহৎ ব্যবসায়ী তথা আমদানিকারক প্রত্যেকের দায়িত্ব অগ্রিম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অর্থাৎ যথাসম্ভব স্বাভাবিক মূল্যে ওই ঘাটতি পণ্যের দ্রুত আমদানির ব্যবস্থা করা। মূল দায়টা সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হলেও সামাজিক দায়বদ্ধতার রীতিনীতি মাফিক সে দায় কিছুটা হলেও দেশের আমদানিকারকদের ওপর বর্তায়। পেঁয়াজের ব্যাপারে সে দায় কে কতটা পালন করেছেন, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তিন. পেঁয়াজ প্রসঙ্গে সম্ভবত অমনোযোগিতা সব পক্ষেই ছিল। তবে প্রথম দফায় হঠাৎ পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠার পর বাণিজ্য সচিব বলেছিলেন, ‘এখনো দুই মাস চলার মতো পেঁয়াজের মজুত আছে। আমদানির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’ আমাদের প্রথম প্রশ্ন- দুই মাসের মজুত থাকা সত্ত্বেও পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়বে কেন? এ মূল্যবৃদ্ধি ন্যায়সঙ্গত নয়, তা কৃত্রিম। অর্থাৎ মুনাফাবাজির উদ্দেশ্যে। উপলক্ষও পাওয়া গেল। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানিবিষয়ক বিরূপ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে উঠে মগডালে চড়ে গেল। আমরা আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি দুই মাসের মতো পেঁয়াজ মজুতের কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীকুল মজুতদারিতে অভ্যস্ত- মুনাফাবাজির উন্মাদনায় মেতে উঠল। পেঁয়াজের দাম তুলে দিল ২৫০ টাকায় (কেজিপ্রতি)। এ সময় অনেকটা সমাজবিরোধী, অন্যান্য ঘটনার সংবাদ কাগজে ছাপা হয়েছিল। স্মরণ থেকে উদ্ধৃত করছি। যেমন- খাতুনগঞ্জে গুদামখালি, পেঁয়াজ উধাও ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা- পেঁয়াজ বিমানে উঠেছে, শিগগিরই বাজারে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ দাম কমে যাবে, এমনটাই সবার মনে হয়েছিল। কিন্তু দাম কমেনি। দাম কমানো হয়নি। এবার আমরা সংবাদপত্রের কয়েকটি মন্তব্য ও খবরের উদ্ধৃতি তুলে ধরব আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে। একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় মতামত- ‘নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম’/‘ভোক্তাদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই’। এটা অবশ্য সব পণ্য নিয়ে সাধারণ মন্তব্য ‘মুনাফাবাজি’র বিরুদ্ধে। একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম- ‘পেঁয়াজ নিয়ে তুঘলকিকাণ্ড’। লেখক একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক। আরেকটি দৈনিকে ছোট খবর- ‘পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি’। ‘সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’ আমরা এসব প্রতিবেদনের বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না, শুধু শিরোনাম মন্তব্যই তুলে ধরছি। তাতেই অনেক কিছু ধরা পড়বে, বোঝা যাবে। অন্য একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম- ‘পেঁয়াজ ৩০ টাকায় কিনে ২৫০ টাকায় বিক্রি’। এ তথ্য পুরোপুরি সঠিক হলে এ জাতীয় মুনাফাবাজি কি সমাজবিরোধী ঘটনা তথা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? নয় কি ব্যবসার সাধারণ নিয়মনীতি-রীতিনীতি লঙ্ঘন? এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, আমদানি করা আড়াই লাখ টনের মধ্যে ভারত থেকেই এসেছে ২ লাখ ৩২ হাজার টন। সিন্ডিকেটের কারসাজির অভিযোগ অস্বীকার। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বৈঠকে বসছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। এ প্রসঙ্গেই বুঝতে কষ্ট হয় না, এত পেঁয়াজ আমদানির পরও বাজারে মূল্য তাৎক্ষণিকভাবে স্থিতিশীল হবে না কেন, দাম কমবে না কেন? কী জবাব সিন্ডিকেটের? অভিযোগ অস্বীকার করলেই কি তথ্য মিথ্যা হয়ে যায়? স্বভাবতই উত্তপ্ত সংসদ পেঁয়াজের ঝাঁজে। ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী। এই মূল্যবৃদ্ধিতে সম্ভবত কয়েক হাজার কোটি টাকার মুনাফা লুটে নেয়া গেল। কোনোদিক থেকে বাধা আসেনি। স্বভাবতই একজন অর্থনীতিবিদ বিশ্লেষকের নিবন্ধের শিরোনাম- ‘পেঁয়াজের এই দামের কোনোই কারণ নেই।’ তার মতে, ‘এরা এখন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। বস্তুত তাদের অনেকেই ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যবসা করে উপরে উঠেছে। নীতি ও নৈতিকতার স্থান এখানে কম।’ আমরা উল্লিখিত মন্তব্যের সঙ্গে একমত। সেই পূর্বোক্ত তথ্য মতের সঙ্গেও যে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মুনাফাবাজির কারসাজি বৈ কিছু নয়। আমরা কি জানতে পারি, এনবিআর চেয়ারম্যান অভিযোগ খতিয়ে দেখে কী সত্য আবিষ্কার করেছেন। পেঁয়াজের কারণে মানুষের যে আর্থিক দুর্ভোগ তাতে এ তথ্য জানার অধিকার দেশবাসীর আছে। দয়া করে আমাদের তা জানান। দিনকয় আগে দেশবাসীর উদ্দেশে আমরা লিখেছিলাম, কিছুদিন পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ রাখুন, পেঁয়াজের ঝাঁজ আপনে আপ কমে আসবে, গুদাম খালি হবে। অনুমান ভুল হয়নি। থলে থেকে এমনিতেই বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। খাতুনগঞ্জে এত পেঁয়াজই গুদামজাত করেছিল যে শেষ পর্যন্ত গুদাম থেকে পচা পেঁয়াজ বাজারে বেরিয়ে এসেছে। খাওয়ার অযোগ্য। ক্ষতি আপাতত ব্যবসায়ীর এবং সেই সঙ্গে দেশের এবং সাধারণ মানুষের। এসব মজুতদার, অস্বাভাবিক মুনাফাবাজরা কি অপরাধী নয়, সমাজবিরোধী, পণ্যবিরোধী তৎপরতার জন্য কি এদের বিচার হওয়া উচিত নয়? একটি বড়সড় বিচার বিভাগীয় পেঁয়াজ তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত নয় সরকারের? শেষ কথা হলো, ঘটনায় মুনাফাবাজির প্রমাণ মিললেও এক লাফে মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে আমদানি সত্ত্বেও এক লাফে দাম কমছে না। কেন, আমরা কি রহস্য জানতে পারি?

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App