×

সাময়িকী

আমার সময় গো ক্ষুরের মতো বিভাজিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:১০ পিএম

আমার সময় গো ক্ষুরের মতো বিভাজিত

রেজাউদ্দিন স্টালিন

রেজাউদ্দিন স্টালিন আমার অনুজ। তার সাথে ব্যবধান দুই দশকের। আশির দশকে আবির্ভূত হয়ে রেজাউদ্দিন স্টালিন তার কাব্যশক্তির প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমি তার কবিতার একজন অনুরক্ত পাঠক হিসেবে প্রতিযোগিতা বোধ করি। ইতোমধ্যে রেজাউদ্দিন স্টালিন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশেও খ্যাতির শিখা বিকিরণ করছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও তার পাঠক আছে দেখে আনন্দ বোধ করি। রেজাউদ্দিন স্টালিনকে বুঝতে হলে তার কবিতা পাঠ করতে হবে। পাঠের ভেতর দিয়ে তার কবিতার সারাৎসার যেমন উপলব্ধি করবো তেমনি শক্তিময়তাকেও স্বীকৃতি দিতে অকুণ্ঠ হবো। নানা মত ও দলের বিভক্তি পাঠককুলকে অস্থির করে রেখেছে। বলে নেয়া ভালো, রেজাউদ্দিন স্টালিনের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮২ সালে। যশোর সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত কবি সম্মেলনের মাধ্যমে। এত বড় সাহিত্য সম্মেলন আমি ঢাকার বাইরে খুব কমই দেখেছি। ওই সম্মেলনে কবি আজীজুল হক উপস্থিত ছিলেন। যতদূর জানি কবি আজীজুল হক রেজাউদ্দিন স্টালিনের গুরুতুল্য। কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদসহ দেশের স্বনামখ্যাত কবিদের উপস্থিতি যশোর সাহিত্য সম্মেলনকে আলোকিত করেছিল। ওই সম্মেলনে পরিচয় হয় যশোরের আরো কয়েকজন সাহিত্যকর্মীর সঙ্গে। তাদের মধ্যে সৈয়দ রানা মুস্তফী, কবীর হোসেন তাপস, আব্দুর রব ও দারা মাহমুদের নাম স্মরণ করতে পারি। সাহিত্যের জন্য বিশেষ করে কবিতার জন্য এরা নিবেদিত প্রাণ। ভেবে শ্লাঘা বোধ করি, যে ১৯৮৭ সালে আমিও যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার লাভ করেছিলাম। আজকের রেজাউদ্দিন স্টালিন ওই সময়ের তরুণতুর্কী। কী কবিতা পাঠে, কী সাংগঠনিক শক্তিতে, কী কবিতা রচনায় সবার প্রীতিভাজন, যা এখনো অক্ষুণ্ন আছে অনেকের কাছে, বিশেষ করে আমার কাছে। সর্বোপরি রেজাউদ্দিন স্টালিন তার কবিতার মতোই সুদর্শন ও স্মার্ট। আপনারা জানেন অনেক অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব তার কবিতা সম্পর্কে লিখিত স্বীকৃতিজ্ঞাপন করেছেন। বেশকিছু পুরস্কারও তার অর্জিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার সে অল্প বয়সেই লাভ করেছে। অগ্রজ হিসেবে চাই, বাংলা কবিতাকে সে যেন নতুন দরজার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার যে কবিতাটি সম্প্রতি আমাকে স্পর্শ করেছে তার নাম ‘ডেমোক্লিসের তরবারী’। ঐতিহাসিক চরিত্রের সমর্থনে মিথের প্রয়োগে এই কবিতাটি অনবদ্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের সবারই প্রথম দিকের কবিতা চর্চায় কিছু প্রভাব থাকে- সে প্রভাব দূষণীয় নয়। প্রকাশিত প্রায় ৪০টি গ্রন্থে স্টালিন অপর ছায়া অতিক্রম করে স্বকীয় কাব্য ভাষা বিনির্মাণে সক্ষম হয়েছে। যে কথাটি বলি- পাঠ করতে হবে এবং পাঠের ভেতর দিয়েই কবিকে আবিষ্কার করতে হবে- এর কোনো বিকল্প নেই। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার ধারাবাহিক পাঠক আমি। আর এ জন্য আমি তার কাব্যকুশলতার প্রশংসা করার অধিকার রাখি। ইদানীং লক্ষ করি, দেশের কবিতা পাঠ না করে, তাদের কীর্তিকে যথাযথ সম্মান না দিয়ে আমরা বাইরের যে কোনো লেখককে স্বীকৃতি দিই, বড় করে দেখি। এটি এক ধরনের হীনমন্যতা, যা ক্ষতিকর; সুতরাং বলবো সবার এ বিষয়ে সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। আমি অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, যাঁর কবিতা আমাকে নাড়িয়ে দেয়। শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি, তাঁদেরও আমি সমানভাবে বিবেচনায় আনতে চাই। কবিতা বিবেচনার প্রথম শর্ত পাঠ এবং উপলব্ধি। পৃথিবীর বড় বড় কবিদের বেলায়ও আমি একই সত্যবচন উল্লেখ করবো। অনেকে বলেন কবিতা দিয়ে কী হয়? আমি সবসময় কবিতাকে সমাজ বদলের হাতিয়ার না বলে হৃদয় বদলের জিয়নকাঠি বলে মনে করি। যদি নিজের দেশ মাটি ও মানুষ সমুপস্থিত না থাকে তবে কবিতা বৈশি^ক হবে না। কবিতা ভাষান্তরের পরও যদি তাতে দেশের মাটির গন্ধ অবশিষ্ট না থাকে তবে তাকে আমি মহৎ কবিতার তালিকাভুক্ত করতে রাজি নই। জীবনানন্দের কথাই ধরুন, তাঁর কবিতা অনুবাদের পরও বাংলাদেশ থাকে- শিশিরের শব্দ শোনা যায়। সে কারণে বলতে বাধ্য হই, তিনি শুধু আধুনিক নন বরং তিরিশের কবিদের মধ্যে তিনিই এখন অগ্রগণ্য ও প্রাসঙ্গিক। আমি নির্দ্বিধায় বলবো রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় যা থাকে তা শুধু বাংলাদেশের মানুষ এবং দেশ নয় বরং বৈশি^ক পুরাণের প্রাসঙ্গিক ব্যবহার এবং নবতর বক্তব্য যা কাব্য বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। ‘তিথোনাসের কান্না’ সম্ভবত তার প্রথম দিককার কবিতা। এই কবিতায় তিথোনাসের বেদনাকে আমরা বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সমানুপাতিক হতে দেখি। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে একটি নতুন চরিত্র গঠিত হয়ে তিথোনাস পাশ্চাত্যের হয়েও প্রাচ্যে অবস্থান করে। রেজাউদ্দিন স্টালিন শুধুমাত্র কবি নন, তিনি তার সাংগঠনিক শক্তিরও পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্ন কবিতা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ততা দিয়ে। রেজাউদ্দিন স্টালিন মিডিয়াতে আছেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে। একজন উপস্থাপক হিসেবে তিনি সফল। এ কথাগুলো বলছি এ কারণেই যে, রেজাউদ্দিন স্টালিন একজন আধুনিক মানুষ। কবি হওয়ার ভান তিনি করেন না বরং তার লেখাই বলে দেয় তিনি কবি। তার কবিতার যে দিকটি আমাকে নাড়া দেয় সেটি হচ্ছে তার সামাজিক চিন্তা। স্লোগান অনেক সময় কবিতার মর্যাদা নিয়ে মুখে মুখে ঘোরে। তৃতীয় বিশে^র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামশীল এবং অন্য দেশের মানুষের তুলনায় বেশিমাত্রায় রাজনৈতিক স্লোগানের মতো কবিতা উচ্চারণ তাই পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে। আনন্দের যে, রেজাউদ্দিন স্টালিনের সামাজিক চিন্তা কখনো রাজনৈতিক স্লোগানে রূপ নেয়নি বরং তার মধ্যে কাব্যিক নান্দনিকতাই লক্ষণীয়। কবিতা দর্শন নয় কিন্তু দর্শনের সমার্থক। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় যে ভাবদর্শন তা প্রাতিষ্ঠানিক দর্শনের যুক্তিতর্ক নয় বরং চিরায়ত সত্যের সপ্রকাশ সংবাদ। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় তার প্রতিভাস দেখি। উদাহরণ হিসেবে- ‘সারা রাত বৃক্ষ হননের শব্দ বনস্থলী ভূমিশয্যা নেয় আমার সুপ্রিয় সেই সব পবিত্র গাছেরা যাদের আমি ভালোবেসে ছুঁয়েছি কতবার তাদের আর্তনাদ শুনে- আমাকে সারারাত কাঁদতে হলো বধ্যভূমে।’ ‘পূর্ণপ্রাণ যাবো’ ঐ কবিতাটিতে শুধু কি বৃক্ষ বিনাশের বেদনা? তা কিন্তু নয়, সমগ্র মানবজাতির বিনাশের চিহ্ন যেন ফুটে উঠেছে। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার নতুন নতুন পাঠ আগামী সময়ের পাঠককে জানতে উদ্বুদ্ধ করবে যে, বিশ ও একুশ শতকে সমাজ ও মানুষ কেমন ছিল? এবং এখন এই বর্তমানতায় আমরা নিশ্চয় উপলব্ধি করি রেজাউদ্দিন স্টালিন তার সময়ের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি। ‘আমার সময় গো ক্ষুরের মতো বিভাজিত/ মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা’। সময়ের এই ব্যবচ্ছেদ আমাকে বিস্মিত করে। স্টালিন সমাজের নেতিকে তুলে আনে আর আমাদের সাবধান করে দেয় অশৈল্পিক অমার্জিত অমানবিকতার বিরুদ্ধে। সর্ব বিবেচনায় রেজাউদ্দিন স্টালিন এই সময়ের একজন শক্তিমান কবি। আজ তার ৫৭তম জন্মদিন। জন্মদিনে শুভেচ্ছা রইল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App