×

সাময়িকী

অক্লান্ত, অপ্রতিরোধ্য শাহরিয়ার কবির

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৫৪ পিএম

অক্লান্ত, অপ্রতিরোধ্য শাহরিয়ার কবির

জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে জড়ো হয়েছেন এই প্রবন্ধ লেখক মুনতাসীর মামুন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও শাহরিয়ার কবির।

দেশ ও সমাজের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে শাহরিয়ার কবিরের সাহসী অবস্থান সর্বজনবিদিত। সেই অবস্থানে ভয় পেয়ে তিনি পথচ্যুত হয়েছেন, কিংবা লালিত অবস্থানের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন- এমনটা শোনা যায়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রশক্তির কোপানলে পড়তে হয়েছে তাঁকে, নির্যাতিত হতে হয়েছে বারবার।

শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে প্রথম দেখা বা পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে যখন তিনি দৈনিক বাংলা ছেড়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রার অন্যতম শীর্ষ কর্ণধার। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকায় ফিরে আমি যোগ দেই তখনকার ক্ষুদ্রায়তন সংবাদ সংস্থা পিপিআই-এ, তারপর রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাসস-এ। সে বহু বছর আগের কথা; বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত আজ। এবং কৃতী সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্রকার শাহরিয়ার কবির, সময়ের ব্যবধানে আজ বহুলালোচিত মানবাধিকার কর্মী। বিগত চার দশকে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সব অঘটন বা দুর্ঘটনার সৎ ও সাহসী প্রতিক্রিয়া দানকারীদের অন্যতম প্রধান শাহরিয়ার কবির, যা একদিকে তাঁকে খ্যাতি দান করেছে, দেশ ও বিদেশে, একই সঙ্গে ধর্মান্ধ বা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর কাছে করেছে প্রবল সমালোচিত।

শাহরিয়ারের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ হয় না আমার, যদিও স্বাধীনতাবিরোধীদের লাগাতার অপতৎপরতা বা ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিরুদ্ধে কয়েক যুগের যে প্রতিরোধ মিছিল, তাতে বারবারই দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে। কাজেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লড়াইয়ে এই লড়াকু সৈনিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় না, এমনটাও সত্যি নয়।

বলা বাহুল্য, ১৯৭৫-এর ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত পালাবদলের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার ইতিহাসের স্বাভাবিক যাত্রাপথ থেকে ছিটকে পড়ে; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রের উল্টো যাত্রা, নব্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকদের হাতে, প্রায় পরিকল্পিতভাবে, লাখো শহীদের রক্তে বিনির্মিত বাংলাদেশ অভাবিতভাবেই নতুন পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়! এ সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রে একাত্তরের ঘাতকদের পরিকল্পিতভাবে পুনর্বাসিত করা হয়, গোলাম আযমসহ পলাতক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা দেশে ফিরে আসে। শুরু হয় ভয়ঙ্কর সব পালাবদল, যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে, লাখো শহীদের আত্মাকে অপমানিত করে।

সেই দুঃসহকালের সমাপ্তি টানতে বাংলাদেশ ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়ায়। বহুবিধ বাধা ও প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তি সংগঠিত হয়, সামনে এগুতে থাকে। ১৯৯২ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবি প্রবলভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। সে সময়ই ১০১ জনের সদস্য নিয়ে গঠিত হয় ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’, যা এক নতুন জাগরণের জন্ম দেয়। সে আন্দোলনের প্রাথমিক কাল এবং পরবর্তীকালের সব পদচারণায় শাহরিয়ার থেকে গেছেন অন্যতম মূল চালিকাশক্তি হিসেবে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটির আন্দোলন গতি লাভ করে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জাতি জেগে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। এই প্রক্রিয়ায় গঠন করা হয় গোলাম আযমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ‘গণআদালত’, যা জাতির বিবেককে শানিত করে। কিন্তু জাহানারা ইমামের আকস্মিক মৃত্যু এবং জোট সরকারের শক্ত প্রতিরোধ তৎপরতায় আন্দোলন স্তিমিত হয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন জাতীয় বরেণ্য ব্যক্তিরা। এরপরও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির একনিষ্ঠভাবে ময়দানে আছেন, যার সরব উপস্থিতি ও সাংগঠনিক নেতৃত্ব তাঁকে এই অঙ্গনের আর সবার চাইতে সতন্ত্র মর্যাদা দান করে।

শাহরিয়ার কবিরকে আমি মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতির একজন হিসেবেই চিনে এসেছি- কারণ তিনি লেখালেখি নিয়েই প্রথম উপস্থিত হন জনসম্মুখে। এরই স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এক সময় তাঁদেরই কয়েকজনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলন, বাংলাদেশ লেখক শিবির, যার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন শাহরিয়ার কবির অনেক বছর। এরপর লিখেছেন তিনি অনেক, ছোট ও বড়দের জন্য। অনেককাল আগে তাঁর আলোচিত গল্প ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে তাঁর পুস্তক সম্ভারের বেশির ভাগই দেশ ও সমাজের সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও মানবাধিকার চিত্র নিয়ে।

আগেই বলেছি, দেশ ও সমাজের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে শাহরিয়ার কবিরের সাহসী অবস্থান সর্বজনবিদিত। সেই অবস্থানে ভয় পেয়ে তিনি পথচ্যুত হয়েছেন, কিংবা লালিত অবস্থানের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন- এমনটা শোনা যায়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রশক্তির কোপানলে পড়তে হয়েছে তাঁকে, নির্যাতিত হতে হয়েছে বারবার। কারান্তরালেও যেতে হয়েছে ২০০১ এবং ২০০২ সালে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে।

উল্লেখ্য, সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, ২০০১-এর নির্বাচনের আগে ও পরে, যে ভয়ঙ্কর সহিংসতা ঘটেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে এবং সেই সবাক চিত্র তুলে এনেছেন শাহরিয়ার কবির; ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, তুলে এনেছেন বিভীষিকাময় সব চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ শাহরিয়ার একজন সমাজ সচেতন মানুষ, চলচ্চিত্রকার। তাঁর সব চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র দেখার সুযোগ হয়নি আমার। তবে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী, যুদ্ধাপরাধ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন তিনি, যা নির্মাতার প্রত্যয় ও সমাজদীক্ষার স্বাক্ষর বহন করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শাহরিয়ারের ডকুমেন্টারিগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কেবল দেশের বিষয় নিয়ে নয়, দক্ষিণ এশিয়া, এমনকি সুদূর কাশ্মির উপত্যকায় মৌলবাদের বিস্তার নিয়েও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন শাহরিয়ার। আজো তিনি অক্লান্ত, পশ্চিমের দেশগুলোতে, সেখানকার সুধী মহলে তুলে ধরছেন বাংলাদেশকে, তার অসাম্প্রদায়িক সত্তার লড়াইকে, একজন নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিকের চোখে। গেছেন তিনি পাকিস্তানেও, সেখানকার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে লেখালেখি করেছেন, তুলে ধরেছেন ১৯৭১-এর অসাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি সমাজ সৈনিকদের অবস্থান।

আর এসব কাজে যদ্দুর জানি, আর অন্যদের সঙ্গে তাঁর তুলনা কমই করা চলে। কারণ তিনি আজো সেই প্রথম থেকে অক্লান্ত এবং অপ্রতিরোধ্য। আমার শুভ কামনা তাঁর প্রতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App