×

সাময়িকী

লোকগবেষক ও লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক শামসুল আরেফীন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৪৬ পিএম

লোকগবেষক ও লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক শামসুল আরেফীন

শামসুল আরেফীন

তিনি নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে বর্তমান পর্যন্ত চট্টগ্রামের পথে-প্রান্তরে পায়ে হেঁটে, এ ছাড়া ব্যক্তিগত খরচে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোককবিদের সন্ধানে ঘুরছেন। কোনো আর্থিক সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে তিনি কোনোভাবে কখনো পাননি। এ পর্যন্ত তাঁর সব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামের বলাকা থেকে। বলাকার স্বত্বাধিকারী ও ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত গ্রন্থগুলোর প্রকাশ সম্ভব ছিল না।

লোকগবেষক ও লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক শামসুল আরেফীন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সদর এলাকায় ২০ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আবদুল মোবিন ও মাতার নাম তমনারা বেগম। শামসুল আরেফীন নব্বই দশকের প্রারম্ভে ছড়া ও কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও এই দশকের মাঝামাঝি লোকগবেষণায় সম্পৃক্ত হন। তিনি সর্বপ্রথম আস্কর আলী পণ্ডিতের রচনা সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। আস্কর আলী পণ্ডিত উনিশ ও বিশ শতকের লোককবি। ১৮৪৬ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড়ে জন্মগ্রহণকারী ও পরবর্তীতে পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডি গ্রামে স্থায়ী বসতিস্থাপনকারী, মোসরফ আলির পুত্র এই আস্কর আলী পণ্ডিত (মৃত্যু ১১ মার্চ ১৯২৭) স্বকালে বড়োমাপের লোককবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সময়ে আধুনিক সাহিত্য রচনা দেদার চললেও চট্টগ্রামের গ্রামীণ বা লোকসমাজে তাঁর রচিত লোকসাহিত্য তথা মূলধারার বাংলা সাহিত্য মনের খোরাক জোগায়। তাঁর সময়ে, সোজাসুজি বললে তখন থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর প্রভাবমুক্ত লোককবি বিশেষ করে চট্টগ্রামে অত্যন্ত অল্প। শামসুল আরেফীন তাঁর রচনা সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন ১৯৯৫ সালের দিকে। তখন পণ্ডিতের অধিকাংশ রচনা প্রায় বিলুপ্ত। শামসুল আরেফীন পণ্ডিতের গানের সংস্পর্শে আসেন চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। পণ্ডিতের গান তাঁর এতই ভালো লাগে যে, ১৯৯৫ সালের দিকে তিনি এই গান সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে তা সংগ্রহে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হন। চন্দনাইশের পার্শ্ববর্তী উপজেলা পটিয়া। আরেফীনের বাড়ি থেকে পণ্ডিতের নিবাসস্থল পটিয়ার শোভনদণ্ডি গ্রামের ব্যবধান ৫-৬ কিলোমিটার। আরেফীন বারবার ছুটে যান পণ্ডিতের বাড়িতে। তখন পণ্ডিতের নাতি ইছমাঈল ও ইসহাক জীবিত। কিন্তু তখন তাঁরা কোনো সহযোগিতা না করায় আরেফীন হতাশ হয়ে পড়েন। অল্পকাল পরে আরেফীন সাহিত্যিক আহমদ ছফার একটি চিঠি পাঠ করেন, যেখানে চিঠির প্রাপকের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল : ‘আমি তোমাকে শোভনদণ্ডি গ্রামের আসকর আলী পণ্ডিতের গানগুলোর প্রতি একটু যত্নবান হওয়ার অনুরোধ করবো। ...আসকর আলী কত বড় গীতিকার, মূল্যায়নের কোনো প্রয়াসই গ্রহণ করা হয়নি। আসকর আলীর সুরের এক বিশেষ মাদকতা এবং দাহিকা শক্তি আছে। এই জিনিস বাংলা গানের এক বিশেষ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। আমি তো তাঁকে সিলেটের হাসন রাজার মতো বড় একজন ভাবুক এবং গীতিকার মনে করি।’ ছফার এই বক্তব্য পড়ে আরেফীন আলোড়িত হয়ে আবারও পণ্ডিতের রচনা সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। আরেফীন পণ্ডিতের রচনা নিয়ে চট্টগ্রামের বলাকা থেকে তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন : ‘আস্কর আলী পণ্ডিত : একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের দুর্লভ পুঁথি জ্ঞান চৌতিসা ও পঞ্চসতী প্যারজান’ ও ‘আস্কর আলী পণ্ডিত : ৮৬ বছর পর’। ‘আস্কর আলী পণ্ডিত : একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ ও ‘আস্কর আলী পণ্ডিত : ৮৬ বছর পর’ গ্রন্থদ্বয়ে পণ্ডিতের তিন শতাধিক গান-কবিতাসহ গবেষণাধর্র্মী আলোচনা স্থান পেয়েছে। ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের দুর্লভ পুঁথি জ্ঞান চৌতিসা ও পঞ্চসতী প্যারজান’ গ্রন্থে পুঁথি দুটি সম্পাদিত হয়েছে। আস্কর আলী পণ্ডিতের রচনা সংগ্রহ করতে গিয়ে আরেফীন লক্ষ্য করলেন, এই পণ্ডিতের ভক্ত-অনুরক্ত ও অন্যান্য লোকসঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে আরো অনেক বিলুপ্ত লোককবির রচনা সংরক্ষণে রয়েছে। আরেফীন অনুভব করলেন, যে কোনো দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকবিশ্বাস, লোকসাধনা, লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির মধ্যে নিহিত থাকে সে দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল শক্তি। এসবের মধ্যে নিজস্বতাকে আবিষ্কার করাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে আরেফীন উক্ত বিলুপ্ত লোককবিদের রচনা উদ্ধারের দিকেও নজর দেন। তিনি পটিয়ার শোভনদণ্ডির মল্লপাড়ার মোহাম্মদ হোসেন থেকে লোককবি মনিন্দ্র দাস (১৯০০-২০০০, জন্মস্থান : চট্টগ্রামের চন্দনাইশ), মকবুল আহমদ পণ্ডিত (জন্ম-মৃত্যুসন অজ্ঞাত, জন্মস্থান : চট্টগ্রামের রাউজানের নয়াপাড়া) ও ক্ষেমেশ চন্দ্র রক্ষিতের (১৮৪৭-১৯২২, জন্মস্থান : চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার জোয়ারা); পটিয়াস্থ খরনার ফকিরপাড়ার হামিদ বখসু থেকে লোককবি সেকান্দর গাইনের (১৮৬০-১৯৪২, জন্মস্থান : চট্টগ্রামের পটিয়া); চন্দনাইশ উপজেলার মুরাদাবাদের নুরুচ্ছাফা, আবুল বশর ও পটিয়ার খরনার লালারখিলের ফজল ফকির থেকে লোককবি খায়েরজ্জমা পণ্ডিতের (১৮৭৬-১৯৫১, জন্মস্থান : চন্দনাইশের মুরাদাবাদ); চন্দনাইশের বৈলতলির রুহুল আমিন থেকে লোককবি মোয়াজ্জমের (উনিশ শতকে জন্ম ও মৃত্যু, সম্ভবত উত্তর বঙ্গের লোককবি); চন্দনাইশের উত্তর গাছবাড়িয়াস্থ বদুরপাড়ার আবুল কাসেম থেকে লোককবি মুন্সী আমিন শরীফ (১৮৯৮-১৯৬৬, জন্মস্থান : চট্টগ্রামের চন্দনাইশের মোহাম্মদপুর), আবুল খায়ের নক্সবন্দি (১৯০৮-১৯৭৩, জন্মস্থান : চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার পূর্ব বরিয়া) ও আতর আলীর (জন্ম-মৃত্যুসন ও জন্মস্থান অজ্ঞাত); চন্দনাইশের পশ্চিম এলাহাবাদের ছুফিয়া দরবার শরিফের শাহজাদা রেজাউল করিম থেকে লোককবি সাইদ মিয়া (১৮৮৯-১৯৬৬, জন্মস্থান : বরিশালের কোতোয়ালি বার থানার তাজকাটি), আতিকউল্লা শাহ (১২৯০-১৩৫৫ হিজরি, জন্মস্থান : বরিশালের আলেকান্দা এলাকার কালুখান বাড়ি) ও আবদুল আজিজ পণ্ডিতের (১৮৯৭-১৯৯৫, জন্মস্থান : বরগুনা জেলার আমতলী থানার ধানখালী); চন্দনাইশের হারলা নিবাসী মাস্টার নুরুল আলম ও প্রাগুক্ত রেজাউল করিম থেকে লোককবি শাহ্ আবদুল জলিল সিকদারের (১৮৫৭-১৯৩৪, জন্মস্থান : চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার মনেয়াবাদ); চন্দনাইশের দক্ষিণ গাছবাড়িয়া গ্রামের অছিয়র রহমান থেকে লোককবি মোরশেদ চাঁদ দরবেশ (জন্ম-মৃত্যুসন ও জন্মস্থান অজ্ঞাত), আবদুল্লাহ বাঞ্ছারামপুর (জন্ম-মৃত্যুসন অজ্ঞাত, জন্মস্থান : ত্রিপুরা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর) ও করিম শাহার (জন্ম-মৃত্যুসন অজ্ঞাত, জন্মস্থান : নয়নপুরের অন্তর্গত বাগরা); নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপের চরকৈলাস গ্রামের বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন থেকে লোককবি আব্দুর রশিদের (১৮৯৯-২০০১/২০০২, জন্মস্থান : হাতিয়ার চরবাটা); চন্দনাইশ নিবাসী শাহীন নূপুরের মাধ্যমে লোককবি আবদুল লতিফ শাহ-র (-১৯৮২, জন্মস্থান : মধ্যম চন্দনাইশ) অনেক দুষ্প্রাপ্য রচনা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। শামসুল আরেফীন এসব লোককবি ছাড়াও আরো অনেক লোককবিসহ মোট শতাধিক লোককবির বিলুপ্ত রচনা আবিষ্কার বা উদ্ধার করেন। শামসুল আরেফীন আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকিরের (১৭৫৯-১৮৩৭) দুই শতাধিক গান এবং ‘সৃষ্টিপত্তন’ নামে একটি পুঁথিও উদ্ধার করেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ওসখাইন গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই আলী রজা সম্পর্কে বলা দরকার, তিনি আঠারো শতকের শক্তিমান কবি। তিনি জীবদ্দশায় অনেক পুঁথি রচনা করেন। তাঁর ‘জ্ঞানসাগর’সহ এ পর্যন্ত ৩০টি গ্রন্থের নাম পাওয়া গেছে। শামসুল আরেফীন আলী রজার অধিকাংশ বংশধরের কাছ থেকে তাঁর রচনা উদ্ধারে কোনো সহযোগিতা না পেলেও কোনো কোনো বংশধর ও আবুল বশর নামে আলী রজার একজন ভক্তের সহযোগিতায় প্রাগুক্ত রচনা অর্থাৎ দুই শতাধিক গান এবং ‘সৃষ্টিপত্তন’ পুঁথি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে বর্তমান পর্যন্ত চট্টগ্রামের পথে-প্রান্তরে পায়ে হেঁটে, এ ছাড়া ব্যক্তিগত খরচে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোককবিদের সন্ধানে ঘুরছেন। কোনো আর্থিক সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে তিনি কোনোভাবে কখনো পাননি। এ পর্যন্ত তাঁর সব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামের বলাকা থেকে। বলাকার স্বত্বাধিকারী ও ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত গ্রন্থগুলোর প্রকাশ সম্ভব ছিল না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App