×

মুক্তচিন্তা

স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অবদান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০১৯, ১০:০৯ পিএম

নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের দুই অভিযানই ছিল দুঃসাহসী এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পাকিস্তানের রাডার ফাঁকি দিয়ে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে নন-কমব্যাট বিমান দিয়ে এ রকম সফল হামলা ছিল অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা এর ধারাবাহিকতায় সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকায় অনেক অভিযান পরিচালনা করেন।

আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি বৈমানিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত ও উদ্দীপ্ত করে। যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙালি বৈমানিকরা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেকে পালিয়ে আসার সময় পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম মতিউর রহমান পাকিস্তান থেকে যুদ্ধবিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের চেষ্টাকালে ওই বিমান দুর্ঘটনায় শাহাদতবরণ করেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বাঙালি বৈমানিকরাও পালিয়ে ভারতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ১৯৭১ সালের মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট এলাকায় বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ধ্বংস ও চট্টগ্রাম এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে তার একক কৃতিত্ব রয়েছে। এ ছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ইউনিট কিলো ফ্লাইটের প্রথম অধিনায়ক। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম মতিউর রহমান ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দুই মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে আসেন। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলেন এবং বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। তিনি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন এবং বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি ৯ মে সপরিবারের পাকিস্তানের করাচি চলে যান এবং একটি বিমান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি পাইলট রাশেদ মিনহাজ একটি বিমান নিয়ে একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময়ে রানওয়েতে ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্বরত মতিউর রহমান তার ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। এ সময়ে রাশেদ মিনহাজ বিমানের ক্যানোপি খুলে বিমান থামানোর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। এ সময়ে মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে বিমানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তবে মিনহাজ অচেতন হওয়ার আগেই কন্ট্রোল টাওয়ারে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হন যে, বিমানটি তিনিসহ ছিনতাই হয়েছে। এই বার্তা পাওয়ার পর চারটি যুদ্ধ বিমান ছিনতাইকৃত বিমানটিকে ধাওয়া করে। এক সময় পাকিস্তানি পাইলট মিনহাজ চেতনা ফিরে পায় এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য মতিউরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে। এ সময় বিমানটি ভরতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ কি.মি. দূরে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয় এবং মতিউর রহমান শাহাদতবরণ করেন। এ ঘটনায় মিনহাজও নিহত হন। দিনটি ছিল ২০ আগস্ট ১৯৭১। মতিউর রহমানের অসীম সহাসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। পাকিস্তানে তাকে চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল এবং মাশরুর বিমান ঘাঁটির গেটে মতিউরের ছবি টাঙিয়ে তাতে লিখে রেখেছিল গাদ্দার শব্দটি। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম পাকিস্তান থেকে ছুটি নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দি অবস্থায় তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এ জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ঢাকা থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ রেজা (অব.), উইং কমান্ডার শামসুর রহমান মির্জা (অব.), ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম এবং স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। তারা এভাবে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক, স্কোয়াড্রন লিডার হাবিবুর রহমান এবং ফ্লাইং অফিসার জিএইচ মির্জা পালাতে গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ডিমাপুরে বাংলাদেশের প্রথম ইউনিট কিলো ফ্লাইট গঠনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। ভারতের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া তিনটি এয়ার ক্রাফট নিয়ে গঠিত হয় কিলো ফ্লাইট। এগুলো হলো- অ্যালুয়েট-ওওও হেলিকপ্টার, অটার ডিএইচসি-৩ এবং সিসি-৩ ডাকোটা বিমান। এগুলো ছিল সম্পূর্ণই নন-কমব্যাট এয়ার ক্রাফট। অ্যালুয়েট-ওওও হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ (পিআইএ পাইলট), এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। ডিএইচসি-৩ অটার বিমানের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (পিআইএ পাইলট) এবং ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ (বেসরকারি কোম্পানির পাইলট)। ডিসি-৩ ডাকোটা বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক (পিআইএ পাইলট), ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত (পিআইএ পাইলট) এবং ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার (পিআইএ পাইলট)। বাংলাদেশের টেকনিশিয়ানরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে তিনটি নন-কমব্যাট এয়ার ক্রাফটকে যুদ্ধোপযোগী বিমানে রূপান্তর করেন। এ কাজে সাহায্য করেন ভারতীয় গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। কিলো ফ্লাইটের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে। কিলো ফ্লাইটে অফিসারের সংখ্যা ছিল ৯ জন এবং বিমান সেনার সংখ্যা ছিল ৩৮ জন। বাংলাদেশের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের উপঅধিনায়ক, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার ৬নং সেক্টর কমান্ডার এবং স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান ১১নং সাব-সেক্টর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৩ ডিসেম্বর অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রথম অপারেশন চালানো হয়। হেলিকপ্টারটির পাইলট ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। সঙ্গে ছিল মেশিন গান চালানোর মতো একজন গানার। সাহসী বৈমানিকদ্বয় ঔদিন রাতে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে তেল ডিপোতে রকেট হামলা করে তেল ডিপো জ্বালিয়ে দেন। ৩ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বোমা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ অটার বিমান দিয়ে এ হামলা চালান। রাত ১১টা ৪০ মিনিটে উড্ডয়ন করে রাত ১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছান। তারা এ সময় ১৪টি রকেট ফায়ার করে তেল ডিপোতে আগুন ধরিয়ে দেন। সব অভিযান শেষে তারা ভোর রাত ৩টা ১০ মিনিটে শিলচরে ফিরে আসেন। নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের দুই অভিযানই ছিল দুঃসাহসী এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পাকিস্তানের রাডার ফাঁকি দিয়ে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে নন-কমব্যাট বিমান দিয়ে এ রকম সফল হামলা ছিল অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা এর ধারাবাহিকতায় সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকায় অনেক অভিযান পরিচালনা করেন। ডাকোটা বিমানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান সেনাপতির যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনটি বিমানের প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতীয় স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষাল এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কে সি সিংলা। বাংলাদেশের মোট ১ হাজার ১৩১ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য একজন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬ জন বীর উত্তম, একজন বীর বিক্রম এবং ১৫ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। বাংলাদেশের ৬ জন অফিসারসহ মোট ৫০ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৭ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) শামসুল আলমকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১১ সালে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকারকে এবং স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলমকে ২০১৬ সালে স্বধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। ২০১৮ সালে যুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকার জন্য এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সুলতান মাহমুদকেও স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিলো ফ্লাইটের অন্যতম বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বলেন, নতুন প্রজন্মের তরুণদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করেছি গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। তরুণদের স্বাধীনতার এই আদর্শ অনুসরণ করে শোষণমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে।’

নূর ইসলাম হাবিব : সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App