×

বিনোদন

বিরান পথে সঞ্জীব চৌধুরী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০৫ পিএম

বিরান পথে সঞ্জীব চৌধুরী

বাংলা গানের জগতে যে ক’জন কিংবদন্তি রয়েছেন, তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম সঞ্জীব চৌধুরী। ছিলেন রকবাজ, ছিলেন স্বপ্নবাজ। পৃথিবীর পথে ঘুরে ঘুরে গান-গল্প-কবিতায় তিনি তার হৃদয়পুরে উদ্ভাসিত স্বপ্নের কথা বলেছেন। মিছিলের অগ্রভাগে আমাদের শুনিয়েছেন দ্রোহের গান। যে দেশে অধিকাংশ মানুষ প্রতিবাদ না করে নিশ্চুপ থাকে সেখানে তিনি অমিতাভ হয়ে কথা বলেছেন স্পষ্টবাদী চিত্তে। আজ মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) তার মৃত্যুবার্ষিকী। শিল্পকর্মই শিল্পীর আরাধ্য। তার গাওয়া সমস্ত গান-গল্প-কবিতাগুলো একত্রে জোড়া দিলে অনেকগুলো ভাবনা জড়ো হয়। সঞ্জীব চৌধুরীকে মনে হয় আকাশ; যে আকাশ যন্ত্রণায় নীল, পরক্ষণেই মনে হয় অন্ধকার এক মেঘলা আকাশ। কখনো মনে হয় সঞ্জীব চৌধুরীর বুকে বিদ্যুৎ, দুঃশাসনে আচমকা ঝড় নিয়ে টিএসসিতে নব্বইয়ের স্বৈরশাসকবিরোধী মিছিল অথবা প্রতিবাদ সভা। তিনি বলেন, ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি, দু’হাতে আগুন তারও’ যেখানে তার গানের শ্রোতা বা কনসার্টে জমায়েত সব দর্শকের হৃদয় এক। সবাই একই দুঃখে দুখী, একই স্বপ্নে বিভোর। সঞ্জীব চৌধুরীর গানগুলো মূলত কবিতা। তার গানের সামনে দাঁড়ালে শ্রোতা এক ধরনের ধাঁধায় উপনীত হয়। শ্রোতার ভাবনায় কাজ করে সঞ্জীব চৌধুরী আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন বা কী বলতে চেয়েছেন? একবার মনে হয় একটা, আবার মনে হয় অন্যটা। একেক সময় একেক রকম ভাবনা খেলে শ্রোতার মনে। এ রকম গোলকধাঁধায় শ্রোতা তার মতো করে অনুভ‚তির জানালা খুলে আনমনে ভাবতে থাকে। ভাবতে থাকে স্মৃতির বৃক্ষের কথা। যে গাছ ছিল, এখন আর নেই। আছে শুধু গাছকে ঘিরে শৈশব-কৈশোরের অমলিন স্মৃতি। কখনো গান শুনে শ্রোতার নিজেকে মনে হয় ‘গাছ’। নিজের ভেতর সে আন্দোলিত হয়, ‘কত যে কথা/এইটুকু গাছ/কত যে কান্না/এইটুকু গাছ/একটা সময়ের কিছু চিহ্ন/দাগ কেটে যায় কোথায় যেন’। সঞ্জীব চৌধুরীর গান বা লেখায় উঠে এসেছে নব্বই দশকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন স্পর্শকাতর ঘটনা। যেমন ধর্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নির্যাতন, মিছিলে বুলেট বিদ্ধ অচেনা প্রাণ, লুণ্ঠন-রাহাজানির খপ্পরে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশি কারেন্সি গায়েব হওয়া নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এদিকে তহবিল জমে/ওদিকে চোখের পানি’। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন নিপীড়িত মানুষের বেদনা। কনাসার্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ইয়াসমিন-তাজুল ইসলাম-দীপালী-নূর হোসেন-ইলা মিত্র-কর্নেল তাহেরের কথা। আসল কথা হলো গানে কিংবা কবিতায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নেকড়ের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত এক ধারালো সময়কে। মানুষ যখন ড্রাকুলার ভয়ে শঙ্কিত, তখন তার গল্প-কবিতা কিংবা গানে উঠে এসেছে সে সময়ের আখ্যান। তিনি বলেন, ‘স্টপ ইট, শিশু হত্যা বন্ধ করো’। সঞ্জীব চৌধুরী উন্মোচন করেছেন পৃথিবীর মুখোশ। তার লেখা ‘কোলাজ’ গল্পে ইমান-রতি-কৌশলের চরিত্র বিশ্লেষণে আমাদের তিনি দেখিয়েছেন দুর্বৃত্তদের রংমঞ্চ। লোমহর্ষক কোনো ঘটনায় সমাজের কোনো মানুষের কী প্রতিক্রিয়া তা ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর মুখস্ত। স্বপ্নবাজি গানে অথবা কোলাজ গল্পে তিনি বলেন, ‘ওরা বলে, ওই গাড়িতে করে আমাদের জন্য খাদ্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের জন্য খাদ্য ও পানীয়। কিন্তু আমরা জানি ওই গাড়িতে কোনো খাদ্য ছিল না কোনো পানীয় ছিল না। তিনশ’টি লাশ- ঠাণ্ডা হিম- যাদেরকে গুম করে ফেলা হবে।’ গান কিংবা ‘গল্পগ্রন্থ’ ‘রাশপ্রিন্ট’-এ সঞ্জীব চৌধুরী তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে পাঠ করেছেন। বুকভরা অভিমান নিয়ে সময়ের ছোবলে হয়েছেন নীল। কখনো বলেছেন অভিমানী প্রেমের কথা। গেয়েছেন গল্পহীন প্রেমিকা অথবা প্রেমিক হৃদয়ের আকুতি, ‘আমি যে গল্পহীন/এ হৃদয় বৃষ্টিহীন নদী/নিজের ভেতরে আড়াল খুঁজি’; আবার কখনো তিনি সমস্ত অভিমান বা রাত জাগার কথা বলে দিতে চেয়েছেন প্রিয় মানুষকে, ‘আমি তোমাকেই বলে দিবো/কী যে একা দীর্ঘ রাত/আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে’। এমন বিরান পথেই পথ চলতে হয়েছিল মায়াস্ত্রো সঞ্জীব চৌধুরীকে। চারদিকে তখন দানা বাঁধা দুঃশাসন। বুলেট-বেয়োনেট, মৃত্যু ও নৈরাজ্যের আধিপত্য। মানুষের এ রকম দুঃসময় কখনো সঞ্জীব চৌধুরী হয়তো তার স্বপ্নেও ভাবেননি। ঢাকা কলেজে পড়াকালীন জড়িয়ে ছিলেন রাজনীতিতে; যে রাজনীতি অন্যায়-অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে। ভাঙনের রুগ্ণ গান শুনতে শুনতে বিরান পথের পথিক সঞ্জীব চৌধুরী একদিন পৃথিবীর পাঠ চুকিয়ে চলে যান পরপারে। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘কে তবু মরণ হয়ে আমাকে ডাকছিল!’ তার মৃত্যুর খবর শুনে সে দিন বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিম বলেছিলেন, ‘রঙ্গের দুনিয়া তারে চায় না, এই অভিমানেই বাউলিয়া ছেলেটা চলে গেল।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App