×

মুক্তচিন্তা

পেঁয়াজের ঝাঁজ ও গুলতেকিন প্রসঙ্গ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ১০:০৯ পিএম

মানুষকে খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না। তারা তাকে সমাজের, দেশের রোল মডেল ভেবে বসায় এই বিপত্তি। লেখক কেন মডেল হতে যাবেন? পাশ্চাত্য এমনকি ভারতেও লেখকদের বিবাহিত জীবন নানা ধরনের ওঠানামায় ভরপুর। সমরেশ বসু থেকে সদ্য প্রয়াত নবনীতা দেবসেন সবার বিবাহ বিচ্ছেদ ও আবার বিয়ে করার কাহিনী আছে। কিন্তু আমাদের সমাজ এখনো তেমন উন্মুক্ত না। মানুষের মনে যে সংস্কার আর বিশ্বাস তার সঙ্গে সংঘাত তারা মানতে পারে না।

পেঁয়াজের ঝাঁজ এখন বেশ ভোগাচ্ছে আমাদের। খবরে দেখলাম এর কেজি দুইশ টাকার ওপরে। সামাজিক মিডিয়ার ভাসমান মন্তব্য আর ঢালাও ট্রলে বোঝা কঠিন কোনটা সত্য। যেমন শিল্পী লতা মুঙ্গেশকারকে ইতোমধ্যে কয়েকবার মেরে ফেলা হয়েছে। এমন এমন মানুষ তা লিখেছেন যারা দেশের বড় বড় মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। অথচ এ লেখা যখন লিখছি তখন তিনি মোটামুটি ভালো হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বলছিলাম পেঁয়াজের কথা। পেঁয়াজ তো বাঙালিকে খাওয়া শিখিয়েছে পর্তুগিজরা। তারা আসার আগে আমরা কি পেঁয়াজ খেতাম? আপনি ভালো করে খেয়াল করুন আমাদের সঙ্গে সাউথ ইন্ডিয়ার লোকদের কি মিল। তারা গায়ের রংয়ে একটু বেশি কালো হলেও মোটামুটি আমাদের মতো। মাছ থেকে নিরামিষ সব কিছুতে আমাদের সমান সমান। আবহাওয়া একই, বঙ্গোপসাগরের তীর মিলে এরা আমাদের কাছাকাছি হলেও আমাদের জীবন উল্টো উত্তর ভারত প্রভাবিত। কারণ মোগল থেকে ইংরেজ যারা ভারত দখল করে শাসন করেছে তাদের রাজধানী ছিল দিল্লি। আর স্বভাবতই এদের প্রভাব পড়েছে আমাদের জীবনে। এদের শেখানো রান্না খাওয়াতে অভ্যস্ত আমরা হয়ে উঠেছি পেঁয়াজপ্রবণ। যিনি বাণিজ্যমন্ত্রী তিনি এখন সিডনিতে। দেশে বলে এসেছেন পেঁয়াজের দাম কমবে না। মিডিয়ায় দেখলাম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং ডেকে চলে আসার পর ওই সভায় নাকি একজন মাত্র ব্যবসায়ী এসেছিলেন। বেচারা হয়তো জানতেন না পেঁয়াজের শোক কাকে কখন দেশান্তরী করে। যাই হোক, এখানকার নেতারা আমাকে বলেছেন তিনি নাকি খুব ভালো বলেন আর অমায়িক মানুষ। তাই পেঁয়াজ নিয়ে অসাধু বাণিজ্য হয়তো তিনি বন্ধ করবেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যেখানে কথা বলেছেন সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য। পেঁয়াজের এই ঝাঁজ ছাড়িয়ে ইস্যুভিত্তিক সমাজে বড় হয়ে উঠেছিল আরেক বুদবুদ। সেটি একটি বিয়ে। সত্যিকারের সেলিব্রেটিদের জীবনই এমন। তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ যেমন দেশ কাঁপানো খবর, তেমনি ফের বিয়ে করলেও তা হয় টক অফ দ্য কান্ট্রি। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ছিল ১৩ নভেম্বর। সে দিনই খবরটা ঘটা করে বাজারে এল। হুমায়ূন আহমেদ যখন খ্যাতির মধ্য গগনে তখন তিনি কন্যার সমবয়সী শাওনকে বিয়ে করে সমালোচনার মুখে পড়েন। শেষতক তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে স্পর্শ করতে না পারলেও এ ঘটনা তাকে নিন্দিত করেছিল। মানুষকে খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না। তারা তাকে সমাজের, দেশের রোল মডেল ভেবে বসায় এই বিপত্তি। লেখক কেন মডেল হতে যাবেন? পাশ্চাত্য এমনকি ভারতেও লেখকদের বিবাহিত জীবন নানা ধরনের ওঠানামায় ভরপুর। সমরেশ বসু থেকে সদ্য প্রয়াত নবনীতা দেবসেন সবার বিবাহ বিচ্ছেদ ও আবার বিয়ে করার কাহিনী আছে। কিন্তু আমাদের সমাজ এখনো তেমন উন্মুক্ত না। মানুষের মনে যে সংস্কার আর বিশ্বাস তার সঙ্গে সংঘাত তারা মানতে পারে না। যারা মনে করেন হুমায়ূনের আলোয় আলোকিত বলে গুলতেকিন আলোচিত ও বিখ্যাত তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। কারণ তার ভূমিকা হুমায়ূনের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে তার যে ত্যাগ এবং শেষ পর্যন্ত যে ধৈর্য তার সঙ্গে আদর্শ বাঙালি রমণীর মিল আছে। হয়তো সে কারণেই মানুষ তার জন্য কেঁদেছিল। তার দৃঢ় মনোবল আর সামাজিক বন্ধনে পরিবার প্রীতিও তখন চোখে পড়েছিল মানুষের। এরপর তিনি নিভৃত জীবনযাপন করলেও কবিতা লিখতেন। পাদপ্রদীপের আলোয় আসার মতো প্রচুর কারণ থাকলেও আসেননি। এখন এলেন। এবং দাপটের সঙ্গে বাকি সব খবরকে ম্লান করে দিয়েছেন গুলতেকিন। কিছুই করেননি তিনি। মাত্র নতুন একটি বিয়ে করেছেন। কেন এই মানুষের ভালোলাগা ভালোবাসা? কলকাতার বন্ধুদের টাইমলাইনও দেখলাম ভেসে যাচ্ছে। গুলতেকিনের প্রতি ভালোবাসায় তারাও একধাপ এগিয়ে। আমার এক কবি বন্ধুর স্ত্রী গত মাসে যাদের বাড়িতে দাওয়াত খেলাম সেও আজ চমকে দিয়েছে আমাকে। মাত্র এক লাইনে সে লিখেছে, গুলতেকিন আমাদের নতুন পথ দেখিয়ে দিয়েছে। কথাটা শক্তিশালী। এতে এমন মনে করার কারণ নেই সে বিচ্ছেদ কামনা করছে। মূলত অধিকাংশ নারী দেখছে কিছু কিছু বাদ-প্রতিবাদ আর সাহসী বা সে নামে মাঠ গরম কিছু লেখালেখি ব্যতীত আসলে কেউই কিছু করে না। গুলতেকিন কোনো বিপ্লব করেননি। কোনো মহৎ কাজও না যে তাকে স্যালুট দিতে হবে। কিন্তু তাকে ঘিরে এই আনন্দ উপচেপড়ার মূল কারণ তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, যে বয়সে আমাদের দেশের মানুষ মনে করে তাদের জীবন শেষ আর কিছু করার নেই সে বয়সে তিনি ঘর বেঁধেছেন। বয়স শরীর সামাজিকতার ওপরে চলে যাওয়া এই সম্পর্ক হয়তো কেবলই জীবনসঙ্গীর। যে সঙ্গীর হাত ধরে তিনি জীবনের শেষ সময়টুকু পার করবেন আনন্দ ও নির্ভরতায়। আমি এতে প্রতিশোধ দেখিনি। আমার মনে হয়েছে এ এক সবল ও সুন্দর সিদ্ধান্ত। গুলতেকিন খান তার রুচি ও আভিজাত্য বোধের জন্য নন্দিত। হুমায়ূন আহমেদ তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তিনি নিজের ভেতর সংসারের ভেতরই গুটিয়ে ছিলেন। জনশ্রুতি এমন, হুমায়ূন আহমেদই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর লেখায়ও আছে মেয়ে, ছেলে ও ভাইয়েরা সবাই ভাবির দলে। তার মৃত্যুর পর চারদিকে যখন শোক ও বিরহের মাতম তখনো গড়িয়ে পড়া দু’ফোঁটা চোখের জলে গুলতেকিন ছিলেন ব্যতিক্রমী ও নান্দনিক। যেসব মানুষ হুমায়ূনের বিয়ে নিয়ে শোরগোল করতেন, যারা এই কারণে তাকে পছন্দ করেন না তারা কি এখন বুঝতে পারবেন, বিয়ে একটি অধিকার। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন মানুষ তাদের জীবন বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা তাদের ব্যাপার। এই যেমন মনে করছি, বিয়ে যতটা তার চেয়ে পরিণত বয়সে একজন জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছেন গুলতেকিন। মাঝপথে নয় গোধূলির সোনালি আভায় সামাজিক বৈধতায় বিয়ের নামে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়ায় তাকে অভিবাদন। নীরবে অনেকেই এভাবে প্রতিবাদ করেন। উচ্চকিতরা যখন সোচ্চার তখন গুলতেকিনই পারেন নীরবতাকে রঙিন করতে। শুভ জীবন গুলতেকিন। আপনার বাকি জীবন নান্দনিক ও সুখময় হোক। হয়তো হুমায়ূন আহমেদও আপনাকে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অদৃশ্যলোক থেকে। বলছেন : ভালো থেকো। সুখে থেকো। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার পঙ্ক্তিটাই আসলে চিরসত্য মনে হচ্ছে: সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা বেদনার জলাভূমি সংসার মানে সংসার ভাঙা সংসার মানে তুমি।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App