×

জাতীয়

সাংকেতিক নামে তৎপর নিষিদ্ধ সংগঠনের জঙ্গিরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩০ এএম

সাংকেতিক নামে তৎপর নিষিদ্ধ সংগঠনের জঙ্গিরা
নিষিদ্ধ ঘোষিত ৮ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা নাম পাল্টে সাংকেতিক নামে সক্রিয় রয়েছে। অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে নাশকতার সুযোগ খুঁজছে এবং পরিকল্পনা আঁটছে। তৈরি করছে দেশ-বিদেশে নেটওয়ার্ক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার একাধিক জঙ্গির কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। জঙ্গি তৎপরতার কারণে সর্বশেষ গত ৬ নভেম্বর নিষিদ্ধ হয় ‘আল্লর দল’। এর আগে নিষিদ্ধ অন্য সাত সংগঠন হচ্ছে জামা’য়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা, হিযবুত তাহ্্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং আনসার আল ইসলাম। প্রাপ্ত তথ্য মতে, আনসার আল ইসলামের ৩৩ জন জঙ্গি ‘সাংকেতিক’ নামে সংগঠিত হচ্ছিল। তারা একে অন্যকে চিনত ‘সাংকেতিক’ নামেই। দারুল জান্নাত নামে আনসার আল ইসলামের একটি সেলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল কোরিয়া ফেরত তরুণ শাহীন আলম ওরফে ওমর শরীফ। সম্প্রতি এই গ্রুপের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন তরুণ কথিত হিজরতের নামে বাসাও ছেড়েছিল। তারা সুন্দরবনে শারীরিক প্রশিক্ষণ নেয়ার পর গিয়েছিল বান্দরবানে। সেখানে এক মাস প্রশিক্ষণ ক্যাম্পও পরিচালনা করে। অর্থ সংগ্রহ করতে এই গ্রুপের দলনেতা শাহীন আলম ওরফে ওমর শরীফ তার দুই সহযোগী হানিফুজ্জামান তারেক ও সাইফুল ইসলামকে নিয়ে ঢাকায় এলে তাদের গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। গত ১০ অক্টোবর শাহীন আলম ওরফে ওমর শরীফ, সাইফুল ইসলাম, হানিফুজ্জামান বিপ্লব ও মামুনকে গ্রেপ্তারের পর যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত ১৭ অক্টোবর তিনজনকে আদালতে সোপর্দ করলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। সিটিটিসি সূত্র মতে, সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া কয়েকজন তরুণ এই গ্রুপটিতে যোগ দিয়ে ঘর ছেড়েছিল। যাদের মধ্যে ময়মনসিংহ থেকে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হওয়া সাফায়েত নামে এক শিক্ষার্থী ও সাতক্ষীরা থেকে এক পুলিশ কনস্টেবলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে মোহাইমিনুল ইসলামও ছিল। মোহাইমিনুল হিজরতের মাঝপথ থেকে বাড়িতে ফিরলেও সাফায়েতকে সিটিটিসি গ্রেপ্তার করেছে। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের প্রকৃত নামের আড়ালে একেকটি ‘সাংকেতিক’ নাম ব্যবহার করত। এ, বি, সি, ডি এই চারটি অক্ষরে ‘এ থেকে এ-৯’ পর্যন্ত শুরা সদস্য, অন্য সদস্যরা বি, সি ও ডি সংকেত ব্যবহার করত। সিটিটিসির উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, আনসার আল ইসলামের এই গ্রুপটি অন্তত ৩৩ জনকে নিজেদের দলে ভেড়াতে পেরেছিল। তারা সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ সংগ্রহের কাজ করছিল। এই গ্রুপের অপর সদস্যদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। আনসার আল ইসলামের দারুল জান্নাত সেলের শীর্ষ নেতা শাহীন আলম তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তিনি ঢাকার আদাবরের মিশন ইন্টারন্যাশনাল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে স্কলারশিপ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার হানসিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনার্স পড়ছিলেন। ‘ভাঙ্গা তরবারি’ নামে একটি ফেসবুক আইডি পরিচালনা করতেন তিনি। আনসার আল ইসলামের হয়ে দারুল জান্নাত নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সেখানে ৩৩ জনকে যুক্ত করেন। গ্রুপে তিনি নিজেই সবাইকে ‘সাংকেতিক নাম’ সরবরাহ করতেন। শাহীন আলম তার জবানবন্দিতে জানান, গাজওয়াতুল হিন্দ বলে ভারতীয় উপমহাদেশে কথিত যে যুদ্ধের কথা উল্লেখ রয়েছে, সে ওই যুদ্ধের জন্য মুসলমানদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই গ্রুপের সূত্র ধরে তারেক, সাইফুল ও হানিফুজ্জামানদের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত ২৯ আগস্ট তিনি পরিবারকে না জানিয়ে দেশে ফিরে হানিফুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারেকসহ তারা সাভারে গিয়ে একত্রিত হয়ে প্রথমে খুলনায় যান। সেখানে সাইফুল নামে আরেক সহযোগীসহ সুন্দরবনে যান। সেখান থেকে বান্দরবনের আলীকদমে গিয়ে অর্থ আয়ের জন্য একটি জমি লিজ নিয়ে একটা ক্যাম্প গড়ে তোলেন।’ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হানিফুজ্জামান বিপ্লব বলেছেন, গ্রুপের সদস্যরা একে অন্যের আইডি দেখে চিনতে পারত না। সব সদস্যে নিজ নিজ সাংকেতিক চিহ্ন ছিল। সদস্যরা একে অন্যের সঙ্গে সংকেতের মাধ্যমে পরিচিত হতো। তার পরিচিতি ছিল ‘বি-৭’। বিপ্লব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, তার বাড়ি জয়পুরহাটের আলমডাঙ্গায়। গত ২৯ আগস্ট শাহীনের কথামতো সে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসেই সাভার স্মৃতিসৌধে নেমে শাহীনের সঙ্গে দেখা করে। তখন শাহীনের সঙ্গে তারেক নামে তাদের আরেক সদস্য ছিল। ওই দিনই তারা খুলনা যান। সেখান থেকে সাইফুলসহ তারা একসঙ্গে সুন্দরবনে যান। হানিফুজ্জামান বলেন, সুন্দরবনের তারা কিছুটা ভেতরে ঢুকে গাছে উঠে রাত কাটায়। সেখান থেকে তারা দুই দিনে যাত্রা করে বান্দরবানে যান। সেখানে লোকজনকে দাওয়াত দেয়া ও অর্থ সংগ্রহ করার জন্য পাহাড়ের পাশে একটি জমি লিজ নিয়ে ক্যাম্প তৈরি করে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বলেন, এইচএসসি পড়ার সময় ওমর শরীফ ওরফে শাহীনের সঙ্গে তার ফেসবুকে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। ফেসবুক আইডি ছিল এনকে সাগর নামে। তাদের মধ্যে ইসলামি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হতো। ওই সময় শাহীন কোরিয়ায় পড়ালেখা করত। তার মাধ্যমে বিপ্লব দারুল জান্নাত নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হয়। ওই গ্রুপের সদস্যরা সবাই আল কায়েদা ও আল কায়েদার বাংলাদেশি শাখা আনসার আল ইসলামকে সমর্থন করে। সূত্রমতে, আনসার আল ইসলামের এই গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট জানতে পেরেছে, এই গ্রুপের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে অন্য সদস্যরাও অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিল। শীর্ষ নেতা শাহীন আলম ওরফে ওমর শরীফ নিজেও অনলাইনের মাধ্যমে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে সেও অনলাইনে গ্রুপ খুলে ইসলামের খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিয়ে ৩৩ জনকে মোটিভেটেড করে তার দলে ভেড়ায়। সূত্র আরো জানায়, অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। অনলাইনে জঙ্গি গ্রুপগুলোর ভ্রান্ত মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে কথিত হিজরতের কথা বলে ঘরও ছাড়ছে অনেকে। এ জন্য অনলাইনকে আরো বেশি বেশি নজরদারির মধ্যে আনার চেষ্টা চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App