×

মুক্তচিন্তা

একজন সৃজনশীল সুভাষ দত্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম

বিশিষ্ট অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্ত (জন্ম: ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০; মৃত্যু: ১৬ নভেম্বর, ২০১২) সর্বৈবভাবে ছিলেন একজন সৃজনশীল সত্তা, কুশলী কৃতবিদ, সৎ ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী। প্রায় এক যুগ আগে নিজের সহযাত্রী আত্মীয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার উপলব্ধির স্তরে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে পরবর্তীকালে তিনি সর্ববাদী, সাত্ত্বিক সাধনায় নিবেদিত হন। তার ‘আলিঙ্গন’ ছবিতে এ ধরনের একটি চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল আমাদের। তার মধ্যে আমরা এমন একটি চরিত্রের সন্ধান পাই, যার কাছে সব ধর্ম ও মতের মধ্যে ঐকমত্যের মর্মবাণী অনুভূত হয়। সব প্রকার সংকীর্ণতা রহিত সুভাষ দত্ত সর্ববাদী মতাদর্শের ছিলেন।

অসম্ভব অনুসন্ধিৎসু এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটির সব সময় আগ্রহ ছিল সৃজনশীল কিছু করার। জীবনকে যেমন দেখতেন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তেমনি এর শিল্পিত রূপায়ণেও ভাবতেন বেশি। আর এর জন্য তার পড়াশোনা ও অধ্যবসায় শেষমেশ মেশে সেলুলয়েডের ফিতার ক্যানভাসে জীবনের নিত্যতাকে তুলে ধরায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প যখন পশ্চিম বাংলার সেরা সব বাংলা ছবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবির প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় নিরুদ্দেশ যাত্রী, এই ঢাকাতেও উর্দু ছবি নির্মাণের বন্যা বইতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ ছবি নির্মাণ করে বাঙালির, বাংলা সংস্কৃতির, সৃজনশীলতার, মৌলিকত্বের মর্মমূলে যেন আত্মবিশ্বাসের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন।

তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মর্মবাণী হলো শেকড়ের কাছে ফিরে আসা। দেশিকোত্তম এই ব্যক্তিত্ব নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় দেখিয়েছেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও সেই অভিনয় সুনামের সুবাদে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের শ্রদ্ধা ও সমীহবোধের কারণে মুক্তি পেয়েছিলেন। নিজের সেই মুক্ত পাওয়ার স্মৃতিকে ‘অরুণোদয়ের অগ্নি সাক্ষীতে’ আনোয়ার হোসেনের অভিনয় জীবনের মধ্যে তুলে ধরেছেন। ১৯৭২ সালে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসনে রেখেছেন মানবীয় দর্শনের ব্যাখ্যা ও সমাধানের প্রেরণা। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকির ‘গলির ধারের ছেলেটি’র চলচ্চিত্রায়নে (ডুমুরের ফুল) একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্ত্বের ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির এমন কাব্যিক শোকগাথা নির্মাণ করেন, যা একটি ধ্রুপদী শিল্পকর্মে উন্নীত হয়। ‘আবির্ভাব’ ও ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে সন্তানময়ী মায়ের আবেগ ও আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষকে শৈল্পিক তুলিতে বিমূর্ত করেছেন। তার তাবৎ চলচ্চিত্রই মানবিক মূল্যবোধের, সমাজ দর্শনের এবং নিবিষ্ট চিন্তা-চেতনার ভাষ্যে বাক্সময় হয়ে উঠেছে।

সামাজিক গবেষণার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল, প্রচুর পড়াশোনা করতেন। সুভাষ দত্ত একজন মহৎ প্রাণ শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রকে শিল্প মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে তার প্রয়াসের যেমন অন্ত ছিল না আবার তার হাতেই বাংলা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগের সার্থকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলা বাহুল্য, তিনিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে, উর্দু ছবির ভাববন্ধন থেকে বাংলা ছবিকে রক্তমাংসসহ সবল-সতেজ ও শিল্প বিনিয়োগ উপযোগী করে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি।

সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App