×

সাময়িকী

মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:২৩ পিএম

মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ

সঞ্জীব চৌধুরী

কিছু মানুষ পৃথিবীর বুকে আসে সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ার আকাশচুম্বী স্বপ্ন নিয়ে। তারা ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা বদলে দিতে নিজেকে উজাড় করে নিরন্তর সংগ্রাম করে যায়। নিঃস্বার্থভাবে মুক্তি ও মানবতার বার্তা নিয়ে ফেরি করে পথে-প্রান্তরে। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে রুখে দাঁড়ায়। তাদেরই মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় ‘দলছুট’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী। তিনি ছিলেন একাধারে একজন খ্যাতিমান গায়ক, গীতিকার, সুরকার, নাট্য অভিনেতা, সাংবাদিক ও কবি। এর বাইরেও তিনি বহুগুণে গুণান্বিত, আরও বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন। সবকিছুর মধ্যে তার অন্যতম গুণ হচ্ছে, তিনি ছিলেন বিপ্লবী ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, বরং মাথা তুলে বুক চেতিয়ে উচ্চস্বরে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। উনাকে দেখতে যতটাই গম্ভীর মনে হতো না কেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত রসবোধ সম্পন্ন একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তিনি এতোটাই রসিক ছিলেন যে, নিজের মৃত্যু নিয়েও কাছের মানুষদের সাথে রসিকতা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পেরেও তিনি মৃত্যু নিয়ে বিন্দু পরিমাণ বিচলিতও ছিলেন না। সত্যি কথা বলতে, প্রকৃত অর্থে যারা বিপ্লবী, তারা এমন স্বভাবের হতেই দেখা যায়। তারা জানেন, বিপ্লবীদের কখনো মৃত্যু হয় না। বিপ্লবীরা ফিনিক্স পাখির মতো বারবার জন্ম নিয়ে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে। তিনি সেই বিশ্বাস থেকেই হয়তো বলেছিলেন, “টিএসসি চত্বরে কিংবা আজিজ সুপার মার্কেটে আমি থাকবো না, সেটা কী কখনো কল্পনা করা যায়! গিয়ে দেখবেন, আমি সেখানে মস্ত আড্ডা জমিয়ে বসে আছি। জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটির আদলে আমি আউড়ে যাই, আবার আসিব ফিরে, টিএসসির মোড়ে, হয়তো কোনো এক বিপ্লবীর বেশে।” সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে চত্বরের নামকরণ করা হয় ‘সঞ্জীব চত্বর’। যদিও তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিন্তু তার ধ্যানে জ্ঞানে ছিল বিপ্লব। তাই তিনি গানটাকেই করেছিলেন প্রতিবাদের হাতিয়ার। ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মিছিলে প্রতিবাদী গান গেয়ে আন্দোলনকে চাঙ্গা করে রাখতেন। বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়েও তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে বুক চেতিয়ে প্রতিবাদের গান গাইতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তার প্রতিবাদের ধরন তরুণ প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করে। তাই সঞ্জীব চৌধুরীকে প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে একটি সম্ভ্রান্ত হিন্দু জমিদার পরিবারে সঞ্জীব চৌধুরীর জন্ম। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন। প্রথমেই দৈনিক উত্তরণে কাজ করা শুরু করেন তিনি। এরপর ‘ভোরের কাগজ’, ‘আজকের কাগজ’, ‘যায়যায়দিন’ প্রভৃতি দৈনিক পত্রিকায়ও কাজ করেছেন সঞ্জীব চৌধুরী। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে ফিচার বিভাগ চালু করার ক্ষেত্রে সঞ্জীব চৌধুরী বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নব্বইয়ের দশকের আগে সকল সংবাদপত্র ভর্তি ছিল শুধু সংবাদ আর সংবাদ। ভোরের কাগজে কাজ করার সময় সঞ্জীব চৌধুরী প্রথমবার ফিচার লেখা শুরু করেন। তার এই পদক্ষেপে সংবাদপত্রের কাটতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে থাকে। ১৯৮৩ সালে একুশে বইমেলায় তিনি ‘মৈনাক’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৯৫ সালে সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দলছুট ব্যান্ড। গতানুগতিক ধারার বাইরে ব্যতিক্রম কিছু গান নিয়ে কাজ করে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যান্ডটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’। এরপর ‘হৃদয়পুর’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আকাশচুরি’, ‘জ্যোছনা বিহার’, ‘টুকরো কথা’, ‘আয় আমন্ত্রণ’ নামে আরো কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘স্বপ্নবাজি’ ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘টুকরো কথা’ অ্যালবামটি সঞ্জীবের মৃত্যুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধার্থে প্রকাশ পায়। এতে তার লেখা কবিতাগুলোর সংকলন ছিল। এ ছাড়া ‘আয় আমন্ত্রণ’ হচ্ছে ব্যান্ডটির ষষ্ঠ ও সর্বশেষ অ্যালবাম। ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর সঞ্জীব চৌধুরীর ৪৭তম জন্মদিনে ‘সঞ্জীব উৎসব’ পালনের মধ্য দিয়ে এই অ্যালবামটি প্রকাশ পায়। এই অ্যালবামের ‘নতজানু’ নামে সর্বশেষ গানটি সঞ্জীব চৌধুরীর নিজের লেখা। সঞ্জীব চৌধুরীর রাজনৈতিক বোধ অনেক গভীর ছিল। স্কুলে থাকাকালীনই তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং এই সংযুক্তি আরো প্রবল হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং তিনি এর সাংস্কৃতিক সম্পাদকও নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে তিনি একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে ওঠে। হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটির চিন্তাভাবনার গভীর?তা ছিল। সবার সাথে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রবণতা ছিল। খুব সহজেই মিশে যেতে পারতেন যে কোনো মানুষের সঙ্গে। যে কোনো আড্ডায় তিনি সবার মধ্যে হয়ে উঠতেন মধ্যমণি। তার বুদ্ধিদীপ্ত ও যুক্তিবাদী বক্তৃতার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রাবস্থায় সুপরিচিত হয়ে উঠেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ বহুবার আলোড়িত হয়েছে তার কণ্ঠের কবিতা ও বক্তৃতায়। তাৎক্ষণিক গান লেখার পর তাতে তখনই সুর বসিয়ে তিনি রাজপথ কাঁপাতেন স্বৈরাচার পতনের গানে গানে। তার রাজনৈতিক সচেতনতা ও কণ্ঠের মহিমাÑ এ দুয়ে মিলে যেন আন্দোলনের ভাষায় কথা বলতো সমন্বিত সুরে। ক্লান্তি তাকে থামায়নি সে দিন, শ্রান্তি তাকে করতে পারেনি কাবু। সুরের ঝঙ্কারে মেতে উঠেছেন ছাত্রবিপ্লবী এক গায়ক তরুণ সঞ্জীব চৌধুরী। পেশার তাগিদে এবং নেশার প্রেষণায় তিনি বহু কাজই করেছেন, কিন্তু কখনোই সমঝোতা করেননি নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে। তিনি বিশ্বাস করতেন সাম্যবাদে, একদিন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে এই সমাজে, এই আশা ছিল তার মনে। মানবতার ভোগান্তির কারণ হিসেবে বিদ্যমান সকল সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। শ্রেণিসচেতন এই সমাজে সঞ্জীব চৌধুরী এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি এক নিমেষেই নিজেকে শ্রেণিচ্যুত করে ফেলতে পারতেন। তিনি সব শ্রেণির মানুষের সাথে কথা বলতে পারতেন, মিশতে পারতেন তাদের মতো করে। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর মাঝরাতে মৃত্যুবরণ করেন। এক যুগ চলে গেছে সঞ্জীব চৌধুরীবিহীন, তবুও মনে হয়, আমাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি আমাদের মাঝেই আছেন। তিনি তার ভক্তদের কাছে বাংলার বব ডিলান কিংবা প্রিয় সঞ্জীব দা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App