×

মুক্তচিন্তা

মহারাষ্ট্র ও জোট রাজনীতির পরীক্ষা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম

আঞ্চলিক দলগুলো যদি কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয়, আর বিজেপি যদি সেই দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলে, তাহলে সেই দলগুলোর কর্মীদের ফেরার জায়গা কোথায় হতে পারে? সর্বভারতীয়ভাবে বিজেপির বিরোধী শক্তি কোনো দল হয়ে উঠতে পারে? কংগ্রেস এভাবেই ভাবছে কিনা জানা নেই। রাহুল গান্ধীর বদলে দলের দায়িত্বে আবার সোনিয়া। এবং ওনার মাথা তুলনায় সরেস। তাই ভাবনাগুলো উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বিধানসভা ভোটের ফলাফল বেরোবার পর টানা উনিশ দিনের নাটক শেষে অবশেষে মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলো। প্রধান কুশীলব শিবসেনা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। কোর্ট কী বলে দেখা যাক, তবে উনিশ দিন ধরে কেউ সরকার গঠন করার দাবি জানায়নি।

নিয়ম হলো, ভোটের ফলাফল বেরোবার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট, গরিষ্ঠতার প্রাথমিক প্রমাণ সমেত সরকার গঠনের দাবি জানায়। অন্যথায় রাজ্যপাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে দলগুলোকে ডাকবেন। এক্ষেত্রে কেউ দাবি জানায়নি। দু-হপ্তা অপেক্ষা করার পর রাজ্যপাল নিজে সবাইকেই ডেকেছিলেন। ২৮৮ আসনের বিধানসভায় ১০৫ জন বিধায়ক নিয়ে সব থেকে বড় দল বিজেপি রবিবার জানিয়ে দিয়েছিল, তারা সরকার গড়তে পারছে না। বিজেপি-শিবসেনার সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করেছিল কিন্তু অক্টোবরের ২৪ তারিখে ফল প্রকাশের পর ৫৬ জন বিধায়কের শিবসেনা মুখ্যমন্ত্রীর পদ চেয়ে বসে, সেই থেকেই বিপত্তি। এরপর দ্বিতীয় শিবসেনা ও তৃতীয় শারদ পাওয়ারের এনসিপিকে (৫৪) একদিন করে সময় দেয়া হয়। দুজনেই আরো সময় চায়। কারণ বিজেপিকে ছাড়া সরকার গড়তে গেলে চতুর্থ স্থানে থাকা কংগ্রেসের সমর্থন লাগবে। সেটা পাওয়া যায়নি।

কোদলের ইতিহাস: মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসন এই প্রথম নয়। ১৯৮০ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরে এসে ইন্দিরা গান্ধী শারদ পাওয়ারের সরকার ফেলে দেন। পাওয়ার তখন ইন্দিরার হাত ছেড়ে অধুনালুপ্ত কংগ্রেস (ইউ)-তে। শেষবার হয়েছে ২০১৪ সালের নির্বাচনের এক মাস আগে যখন পাওয়ারের এনসিপি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট সরকার ছেড়ে বেরিয়ে যান। মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে পাওয়ার আর প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের গড়া শিবসেনা, মারাঠি অস্মিতার দাবিদার ও চিরশত্রু। ইন্দিরার মৃত্যুর পর পাওয়ার কংগ্রেস ঘুরে ১৯৯৯ সালে এনসিপি বানান। ওদিকে বালাসাহেবের ছেলে উদ্ধব ২০০৩ সাল থেকে পার্টির দায়িত্বে। ২০১২ সালে বালাসাহেবের মৃত্যুর পর থেকে উদ্ধবই ঠাকরে সাম্রাজ্যের কর্তা। রাজনৈতিক শত্রুতা থাকলেও উদ্ধব আর পাওয়ারের ভেতর এক জায়গায় খুব মিল। দুজনেই বারবার তাদের দুই দশকের পুরনো জোটসঙ্গী বিজেপি ও কংগ্রেসের মাথাব্যথার কারণ হয়েছেন।

প্রাদেশিক রাজনীতির ওপর চাপ যত বেড়েছে মাথাব্যথাও তত বেড়েছে। ২০১৪ সালে দুই দলই জোট ভেঙে বেকায়দায় পড়েছিল। শিবসেনাকে মাথা মুড়িয়ে বিজেপির সঙ্গে সরকারে যেতে হয়েছে। কিন্তু গিয়েও শান্তি ছিল না। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ কেউ উদ্ধবের দৈনন্দিন বাহানায় তাল দিতে রাজি ছিলেন না।

লোকসভা ভোটের পরে একটু মুষড়ে পড়লেও বিধানসভায় বিজেপি ২০১৪-এর থেকে ১৭টি আসন কম পেতেই শিবসেনা আবার পুরনো ফর্মে ফিরে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, শিবসেনারও এবারের ভোটে আসন কমেছে ৬৩ থেকে ৫৬। গতবার ২৩০ সিটে প্রার্থী দিয়ে বিজেপি ১২২ আসন পেয়েছিল। তুলনায় এবার ১৫২-তে ১০৫ খারাপ বলা যায় না। চারটি বড় দলেরই ভোট শতাংশ কমেছে। শিবসেনার ভোট কমেছে সব থেকে বেশি তিন শতাংশ। ওদিকে ভোট কম পেলেও কংগ্রেস ও এনসিপি আসন বাড়িয়েছে।

অর্থাৎ সংখ্যার বিচারে বিজেপির ফল তেমন কিছু খারাপ নয়। আগেরবারও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, এবারো নেই। বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মহারাষ্ট্রের প্রথম অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী যিনি পুরো পাঁচ বছর সরকার চালিয়েছেন এবং সেটা কোনো রকম বিতর্ক ছাড়াই। যে শহরে টাকা হাওয়ায় ওড়ে, পৃথিবীর অন্যতম বড় কোম্পানিদের ভিড়, আর সরকারের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা; সেখানে কোনো রকম দুর্নীতির ছাপ ছাড়া পাঁচ বছর পার করা বড় ব্যাপার বৈকি! শুধু তাই নয়। কাজকর্মের নিরিখে ফড়নবিশকে গত পাঁচ বছরে ভারতের অন্যতম সেরা মুখ্যমন্ত্রী বলা যায়। শুধু উন্নয়নমূলক কাজ নয়, মুম্বাইয়ের যে অপরাধ জগৎ নিয়ে এত আলোচনা হয়, তাকে ফড়নবিশ একেবারে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও বিজেপি সরকার গড়তে পারেনি তার কিছু কারণ আছে।

অস্তিত্বের সংকট

প্রথম, আগেরবার ছোট জোটসঙ্গীদের নিয়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। শিবসেনা যাতে বেশি দরাদরি না করতে পারে সেই জন্য এনসিপি বিজেপির সঙ্গে বিরোধিতা ভুলে এনডিএকে আগাম সমর্থন দিয়ে রেখেছিল। ফলে শিবসেনার পথ ছিল না। তুলনামূলকভাবে এবার বিজেপি শিবসেনার ওপর বেশি নির্ভরশীল।

দ্বিতীয়, বিজেপি এবার মারাঠি সত্তার প্রতীক মারাঠাওয়াড়া অঞ্চলে কম ভোট পেয়েছে। জাতি মারাঠারা ভোট দিয়েছে এনসিপিকে। বিজেপির ১৭টি আসন কমার এটাই মূল কারণ।

তৃতীয় কারণটা দ্বিতীয়র সঙ্গে যুক্ত। সেপ্টেম্বর মাসে শারদ পাওয়ারের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র রাজ্য সমবায় ব্যাংকে ২৫ হাজার কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগে কেন্দ্রীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। ভারতের সমবায় ব্যাংকগুলো রাজনীতিকদের ছত্রছায়ায় থাকে এবং তছরুপের অভিযোগ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিজেপি খুব সচেতনভাবে প্রত্যেক রাজ্যের চলে আসা ছকগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে, যাতে অঞ্চল, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ভোট, উন্নয়নের নিরিখে এক জায়গায় আসে। এবং সেটা আঞ্চলিক দলগুলোর ভয়ের কারণ।

মহারাষ্ট্রের শিবসেনা, এনসিপি; বিহারের জেডি (ইউ), বাংলার তৃণমূল সবাই জানে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির উল্কার গতিতে উত্থান ভারতের রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে দিচ্ছে।

সুতরাং প্রত্যাঘাতের এই সুযোগ। এনসিপি তো শিবসেনার হয়ে এবার সোনিয়া গান্ধীর কাছে দরবারও করে ফেললেন। প্রশ্ন এবং গভীর প্রশ্ন, সোনিয়া তাতে সাড়া দিলেন না কেন? শুধুই কি দর কষাকষি না আরো কিছু? বহুদলীয় থেকে দুই-দলীয় রাজনীতি সাধারণভাবে দেখলে কংগ্রেসের কাছে এটা বিজেপিকে আটকানোর সুযোগ ছিল। অতীতে কংগ্রেস বহুবার তাই করেছে। কিন্তু সেই সুযোগের কিছু অসুবিধাজনক দিকও ছিল বা আছে।

প্রথমত, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোট থাকার নয়। দলগুলো চরিত্রগতভাবে এত আলাদা যে ঠোকাঠুকি লাগতে বাধ্য। সবাই যখন আসনের হিসেবে প্রায় সমান তখন মারামারি ও সরকার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আরো বেশি। আর সে রকম হলে শিবসেনা, কংগ্রেসের ঘাড়েই দোষ ফেলবে। তা ছাড়া অঙ্কের হিসাবে বিজেপির সাহায্য ছাড়া মিলিজুলি সরকার কোনো বিল পাস করতে পারবে না। এভাবে বিজেপিকে আটকাতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা।

দ্বিতীয়ত, দুয়েকটা ছাড়া ভারতের প্রায় সব আঞ্চলিক দল কংগ্রেস ভেঙে তৈরি। জোট রাজনীতির মাধ্যমে কংগ্রেস হয়তো অতীতে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে, কিন্তু বদলে তার সংগঠন দুর্বল হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা কংগ্রেসের সঙ্গে ক্ষমতায় এসে কংগ্রেসকেই গিলে ফেলেছেন।

তৃতীয় এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ- আঞ্চলিক দলগুলো যদি কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয়, আর বিজেপি যদি সেই দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলে, তাহলে সেই দলগুলোর কর্মীদের ফেরার জায়গা কোথায় হতে পারে? সর্বভারতীয়ভাবে বিজেপির বিরোধী শক্তি কোনো দল হয়ে উঠতে পারে? কংগ্রেস এভাবেই ভাবছে কিনা জানা নেই। রাহুল গান্ধীর বদলে দলের দায়িত্বে আবার সোনিয়া। এবং ওনার মাথা তুলনায় সরেস। তাই ভাবনাগুলো উড়িয়ে দেয়া যায় না।

প্রতিম বসু: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App