×

সাময়িকী

ভালোবাসার বাড়ি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৫৩ পিএম

ভালোবাসার বাড়ি
হ্যালো রুম্পা! জ্বি মা, বলো। রিটায়ার্ড করার পর তোর বাবা তো পাগল হয়ে গেছে! এ আর নতুন কী মা, বাবার পাগল হওয়ার অভিযোগ তো তোমার অনেক আগের। তা, পাগল হয়ে এখন কী করছে বাবা? প্রতিদিন সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে যায় আর ফেরে সেই রাতে। কোথায় যায়, কী করে কিচ্ছু বলে না। বলো কী! তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার! আমিও তো তাই বলছি। সারাদিন বাইরে বাইরে তো থাকেই, তা ছাড়া পেনশনের টাকাপয়সা কোথায় কী রাখছে কিচ্ছু জানাচ্ছে না আমাকে। আগে তো টাকাপয়সার ব্যাপারে সব সময় আমার সঙ্গে শেয়ার করত। টাকাপয়সার ব্যাপারে তুমি চিন্তা করো না মা, বাবা কোনোদিনই প্রয়োজনের বাইরে এক পয়সাও খরচ করেনি, এখনও করবে না। রুম্পা শোন, আমার কী মনে হয় জানিস! তোর বাবা মনে হয় আরেকটা বিয়ে করেছে। তাই নাকি? তা এমন কথা তো তুমি বাবাকে আগেও অনেকবার বলেছো। কিন্তু কোনো দিনই তো লোকটাকে দেখলাম না বিয়ে তো দূরের কথা একটা বান্ধবী পর্যন্ত জোগাড় করতে পেরেছে। তুই না আমার কথার কোনো গুরুত্বই দিচ্ছিস না। যখন অন্য এক মহিলাকে মা বলে ডাকতে হবে তখন বুঝবি। আচ্ছা মা, তুমি একদম চিন্তা করো না, আমি এখনই বাবাকে ফোন করে জানছি সব। ঠিক আছে, তুই জেনে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে আমাকে জানাবি। আচ্ছা জানাব মা। হ্যালো বাবা! জ্বি মা, বল। তুমি এখন কোথায়? কী করছো? তার আগে বল তুই কেমন আছিস? আমি ভালো আছি বাবা। কই বললে না, তুমি কোথায়? আরে বলছি। তুই তো এখন আর ফোনই করিস না। তুমি কিন্তু আমার কথার উত্তর দিচ্ছো না বাবা। শোন, আগামী শুক্রবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য আমার এখানে চলে আসবি। জামাইকে আজই বলে রাখবি। আচ্ছা আসব। কিন্তু তুমি এখন কোথায় কী করছো তা তো বলছো না। মা বলল, তুমি নাকি সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো। কোথায় যাও, কী করো, কিচ্ছু বলো না মাকে। তোর আর তোর মায়ের সব কথার জবাব শুক্রবারই পেয়ে যাবি। আর শোন, তোদের গাড়িতে আসবি না। সকাল সকাল আমি গাড়ি পাঠাব। সেই গাড়িতে চলে আসবি। তুমি গাড়ি কোথায় পাবে বাবা? সে চিন্তা তোর করতে হবে না। এখন রাখি। আচ্ছা বাবা। হ্যালো মা! হ্যাঁ রুম্পা বল। কিছু জানতে পারলি? না মা। বাবা কিছুই বলল না। শুধু বলল, আগামী শুক্রবার থেকে এক সপ্তাহ তার কাছে থাকতে হবে। দেখলি, আমার সন্দেহই মনে হয় সত্যি। বাবা আরও বলল, তোমার সব প্রশ্নের উত্তর নাকি শুক্রবারেই পাবে। তুমি কোনো চিন্তা করো না মা। শুক্রবার আসতে তো আর মাত্র কয়েকদিন। আমি আসি। তারপর সব খবর বের করে ফেলব। ঠিক আছে মা। ভালো থাকিস। শুক্রবার। আকবর সাহেব, মিসেস আকবর, তাদের ছেলে রুবেল আর মেয়ে রুম্পাকে নিয়ে একটি গাড়ি পথ ধরল সাভারের আশুলিয়ার। কিছুক্ষণ পর গাড়ি গিয়ে থামল নতুন একটি বাড়ির সামনে। পনেরো শতকের মতো জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা নতুন ডুপ্লেক্স বাড়ি। গেট খুলে দিল কেয়ার টেকার টাইপের এক লোক। গেট দিয়ে ঢুকেই মিসেস আকবর বললেন, এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে আমাদের! এখানকার কোন জায়গায় যেন আমাদের একটা জায়গা কেনা ছিল না! রুম্পা আর রুবেলের চোখেমুখে প্রশ্ন কিন্তু তারা কিছু বলছে না। রুম্পার ছোট্ট মেয়েটা গেট দিয়ে ঢুকে বাড়ির দরজার দিকে না গিয়ে পাশের বাগানমতো জায়গাটার দিকে দৌড়ে গেল। ছোট্ট বাড়িটার চারদিকেই গাছগাছালিতে ভর্তি। বেশিরভাগই ফলের আর ফুলের গাছ। কী গাছ যে নেই ওইটুকু বাড়িটায় তা একনজর দেখে কেউ বলতে পারবে না। একেই বোধহয় বলে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। বাড়ির ভেতর গিয়ে মুখ খুললেন আকবর সাহেব। শোনো রুম্পার মা, রুম্পা আর রুবেল। তোমাদের তো জীবনে কিছুই দিতে পারিনি, আজ একটা সারপ্রাইজ দিলাম। আমার জীবনের প্রায় সব সঞ্চয় দিয়ে তোমাদের জন্য এই বাড়িটা বানিয়েছি। আকবর সাহেবের কথা শুনে সবাই চমকে উঠল। এত বড় সারপ্রাইজ যে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা তারা কেউই চিন্তাও করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে বাবা বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন সবাইকে। এই দেখ, নিচতলায় কিচেন, ডাইনিং, ড্রইং আর গেস্টরুম। দোতলায় তোদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে রুম। আর আছে আমার জন্য রিডিং রুম। রুম্পারা দেখল, চমৎকার ডিজাইনে তৈরি হয়েছে বাড়িটা। দোতলার প্রতিটা বেডরুমের সঙ্গে একটা করে বারান্দা। প্রত্যেকটা কাজেই রয়েছে আভিজাত্য আর রুচির ছাপ। শুধু নতুন বাড়িই না, প্রতিটি রুমেই রয়েছে মানানসই নতুন ফার্নিচার। এরপর তারা সবাই মিলে গেল বাগান দেখতে। মূল গেটের ওপরটা ঢেকে রেখেছে বাগানবিলাস গাছ। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস বড় প্রিয় মিসেস আকবরের। দক্ষিণ দিকে বাড়িটা ছুঁই ছুঁই করছে একটা হাসনাহেনা গাছ। আম জাম পেয়ারা বরই জামরুল আতা ডালিমসহ সব গাছই চোখে পড়ছে। বাগানের মাঝামাঝি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো দুটো বেঞ্চিমতো। জোছনারাতে এখানে বসে গল্প করতে কত ভালো লাগবে চিন্তা করতেও ভালো লাগে রুম্পার। মিসেস আকবর ভাবতে লাগলেন মনে মনে, যে লোক জীবনে নিজের জন্য ভালো দুটো জামা কেনেনি বলে রুচিহীন আর গেঁয়ো বলে কত কথা শুনিয়েছেন সেই লোকই এত টাকা খরচ করে এত সুন্দর একটা বাড়ি বানাল! অবশ্য এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন আকবর সাহেবের পরিবারের সবারই একসময় ছিল। কিন্তু সামান্য আয়ের একজন সরকারি চাকরিজীবীর পরিবারের পক্ষে যে এটা বাস্তব হবে এ চিন্তা কেউ কোনো দিনই করেনি। আকবর সাহেব বললেন, তোরা রাগ করবি কি না জানি না। পেনশন থেকে পাওয়া পুরো টাকাটাই এই বাড়ির পিছনে খরচ করেছি আমি। তোদের দুজনকে যেভাবে মানুষ করেছি তাতে তোদের কারও আমার পেনশনের টাকা দরকার হবে না সে আমি জানি। আর যে টাকাটা সরকারের ফান্ডে রয়ে গেছে সেটা দিয়ে তোর মা সারা জীবন বসে বসে খেতে পারবে। রুবেল বলল, বলো কী বাবা, রাগ করব মানে? এত সুন্দর একটা বাড়ি তুমি বানিয়েছো এরপরও আমরা রাগ করব? রুম্পা বলল, সত্যিই বাবা আমরা খুব খুশি হয়েছি। সে দিন রুম্পাদের সারাদিন কাটে গল্পগুজব করে হাসিখুশিতে। বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে-নাতনি সবাই মিলে খুনসুটি করে দিন কাটায়। নাতনির সঙ্গে বাগানে খেলাধুলা করেন আকবর সাহেব। সন্ধ্যায় ছেলেমেয়ের সঙ্গে তার সারা জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। আকবর সাহেব বলেন, এমন একটা বাড়ির শখ আমারও অনেক দিনের। কিন্তু সত্যিই যে এটা বানাতে পারব এমনটা ভাবিনি কোনো দিন। তবে এখন এ বাড়িটা আমি তোদের জন্যই বানিয়েছি। আমি বুড়ো হয়েছি। সেই আগের শখ বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই আগের মতো। কিন্তু তোদের তো আছে। একটু থেমে তিনি বলেন, তোর দাদু মারা যাওয়ার সময় আমাদের জন্য এক কানাকড়িও রেখে যাননি। সাত সাতটি ভাইবোনকে নিয়ে মা সে দিন অথৈ সমুদ্রে পড়েন। কোনো দিন ভাত জুটত, বেশিরভাগ দিনই জুটত না। সাত ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম ছোট। যেখানে খাবার জোটে না সেখানে লেখাপড়া ঠিকমতো চলার তো প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে বেতন না দিতে পারায় নাম কাটা যেত প্রতি মাসে। ফি না দেওয়ায় পরীক্ষা দিতে দিত না স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেই অবস্থা থেকে সৃষ্টিকর্তা কী করে যে টেনে তুললেন, বাঁচিয়ে রাখলেন আমাদের, তা তিনিই জানেন। মিসেস আকবর বলেন, এসব কথা বলে কী লাভ এখন? এখন তো তোমার সব হয়েছে। আকবর সাহেব বলেন, ওদের এসব কথা শোনার দরকার আছে। নইলে ওরা ভাববে আমি হয়তো ওদের ঠকিয়েছি সারা জীবন। তোমরা আমাকে কৃপণ বা কঞ্জুস বলেছো সারা জীবন। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক যে তোমার ছেলেমেয়েদের কোনো কিছুতেই কষ্ট দিইনি কোনো দিন। ওরা যখন যে জিনিসটার কথা বলেছে, তখনই আমার ঠিক ওদের বয়সে ওরকম একটা জিনিস না পাওয়ার কষ্টের কথাটা মনে হয়েছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ওদের সেই জিনিসটা কিনে দিয়েছি। যাই হোক, খেয়ে-না খেয়ে কোনোমতে স্থানীয় কলেজে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় এসে ভাগ্যগুণে সরকারি চাকরিটা পেয়ে গেলাম। তার পরের সব কিছু অবশ্য তোদের মা-ই জানে। রুম্পা বলে, বাবা, তোমার এত কষ্টের কথা তো আমাদের কোনো দিনই বলোনি। না রে মা, এগুলো কষ্টের কথা না। এসব স্মৃতিই এখন আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। শোন, মানুষের অতীত যখন হয় আনন্দের আর বর্তমান কষ্টের, সে বড় দুঃখের। আর অতীত যদি হয় কষ্টের আর বর্তমান আনন্দের, তার চেয়ে শান্তির আর কিছু নেই। আজ আমার নিজেকে সবচেয়ে সফল মানুষ মনে হয়। কারণ আমি আমার নিজের যোগ্যতা দিয়ে তিল তিল করে এ সুখ অর্জন করেছি। তবে একসময় না পাওয়ার কষ্টও আমার ছিল। বাবা-মা কোনো কিছু রেখে যাননি বলে কষ্ট আর আক্ষেপ আমারও ছিল। সেই কষ্টটা যাতে তোদের না থাকে সে জন্যই তোদের কোনো দিন না পাওয়ার কষ্ট বুঝতে দিইনি। আর এই বাড়িটাও আমি বানিয়েছি সে কারণে। এটা আমার জন্য বানাইনি। এই ভালোবাসার বাড়িটা আমি আমার ভালোবাসার মানুষদের জন্যই বানিয়েছি। গল্পগুজব, খাওয়া-দাওয়া শেষে যে যার রুমে ঘুমাতে যাওয়ার পালা। আকবর সাহেব ঘুমানোর সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে পছন্দ করেন। রুম্পা ঘুমাতে যাওয়ার আগে ল্যাপটপে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছেড়ে দিয়ে যায়। এক সময় পুরো বাড়িটাতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সকালবেলা সবার ঘুম ভাঙে মিসেস আকবরের আর্তচিৎকারে। রুম্পা, রুবেল তাড়াতাড়ি আয়। তোর বাবার কী যেন হয়েছে। ডাক শুনে সবাই ছুটে আসে। খাটের ওপর নিশ্চল শুয়ে আছেন আকবর সাহেব। মুখ দেখে বোঝা যায় না তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। তার মুখে লেগে রয়েছে একটুকরো হাসির রেখা। সে হাসি বিজয়ীর হাসি, বিজয়ের হাসি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App