×

সাময়িকী

নবনীতাদির স্মৃতির পরশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:০৬ পিএম

নবনীতাদির স্মৃতির পরশ

সেলিনা হোসেন, নবনীতা দেবসেন ও মারাঠি ভাষার লেখক বালাচন্দ্র নেমাদী

সেবার নবনীতাদির বাড়িতে গিয়েছিলাম। ‘ভালো-বাসা’ নামের বাড়িতে অনেকক্ষণ কাটিয়ে ফিরে আসি। দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় চন্দ্রবতীর ‘রামায়ণ’ নিয়ে আলাপ করেন দিদি।
নবনীতা দেবসেন নেই, এই সত্য মেনে নিতে আমার চোখের জল ঝরছে। তাঁর মৃত্যুর খবর কলকাতা থেকে প্রথমে আমাকে জানিয়েছে বাংলাদেশের কবি পিয়াস মজিদ। কিছুক্ষণ পরে দ্বিতীয় ফোনটি পাই কবি-কথাসাহিত্যিক গার্গী রায় চৌধুরীর কাছ থেকে। এই প্রজন্মের দুজন সাহিত্যিক ভেজাকণ্ঠে প্রবীণের মৃত্যুর খবর দেয় আমাকে। চোখের জল মুছলে আমার সামনে ভেসে ওঠে নবনীতা দেবসেনের শিল্প-সাহিত্যের যৌগিক সাধনার বলয়। অসংখ্যবার তাঁকে পেয়েছি শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠানে। সংস্কৃতি জগতের জন্য তাঁর টান কাছ থেকে দেখেছিÑ দেখেছি শিল্প-সাহিত্যের জন্য তাঁর অনুভবের মাত্রার ব্যাপকতা। সবকিছু মিলিয়ে তিনি আমার মানসলোকের বরেণ্য মানুষ। আমি জানতাম তিনি যাবদপুর বিশ^বিদ্যালয়ে ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। ১৯৯২ সালে আমার ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ উপন্যাসটি সেই বিভাগের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন পর্যন্ত নবনীতা দেবসেনকে আমি সামনাসামনি দেখিনি। ওই বিভাগের অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। সেদিন বুঝেছিলাম আমাকে তাঁরা পেয়েছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্যে। পরিচয়ের সূত্র কোনো ব্যাপার ছিল না। সেদিন আমার নবনীতাদির কথা মনে হয়েছিল। তাঁর লেখা পড়ে তাঁকে এমন মর্যাদায় বুঝতে পেরেছিলাম। ২০০১ সালে ভারতের কেরালা রাজ্যের সাহিত্য অকাদেমির অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন। কেরালা মালয়ালাম ভাষার রাজ্য। সেই সাহিত্য সম্মেলনে অনেক সাহিত্যিক এসেছিলেন। আমি, নবনীতাদি ছিলাম বাংলা ভাষার লেখক। সেই সম্মেলনে নবনীতাদিকে না পেলে আমার বাংলা ভাষায় কথা বলা হতো না। যে কদিন কেরালায় ছিলাম নিজের অন্তরঙ্গ অনুভব নবনীতাদিকে নিয়েই উড়াল দিয়েছিল। এরপর দেখা হয়েছিল দিল্লিতে। দিদির মেয়ে অন্তরা দেবসেন The Little Magazine পত্রিকাটি সম্পাদনা করে। পাশাপাশি ও ২০০৬ সালে South Asian Literature Award for Masters প্রবর্তন করে। সে বছর আমাকে জুরিবোর্ডের সদস্য রেখেছিল। কবিতায় পুরস্কৃত হয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান। নাটকের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন মারাঠি ভাষার নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকার। উপন্যাসে পুরস্কৃত হয়েছিলেন মালয়ালাম ভাষার ঔপন্যাসিক কমলা দাস। পুরস্কার প্রদানের দিন সন্ধ্যায় আবার নবনীতাদিকে পাই দিল্লির হ্যার্বিট্যাট সেন্টার মিলনায়তনে। ঘনিয়ে ওঠে অন্তরঙ্গ পরিবেশ। তিনি হেসে বলেন, তুমি আসবে জেনে তোমার জন্য একটা বই এনেছি। নাও। আমাকে ‘নটী নবনীতা’ বইটা দিলেন। বইটা বুকে জড়িয়ে তার ঘাড়ে মাথা রাখি। সঙ্গে সঙ্গে নবনীতাদির প্রথম কবিতার বইয়ের কথা মনে হয়। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় পড়েছিলাম ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়।’ ‘সই’ নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন নারী লেখকদের নিয়ে সংগঠন। অনেকের কাছে শুনেছি তিনি এমন আয়োজনের প্রথম ব্যক্তি। নারী লেখক ও প্রকাশকদের নিয়ে আয়োজন করেন বইমেলা, যেটি ‘সইমেলা’ নামে পরিচিত। সইমেলায় যোগদানের জন্য আমি একবার আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। কলকাতার আইসিসিআর মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। বইমেলার পাশাপাশি অগণিত পাঠকে পূর্ণ ছিল মিলনায়তন। দেখে আমার মুগ্ধতা ফুরোয় না। সেবার নবনীতাদির বাড়িতে গিয়েছিলাম। ‘ভালো-বাসা’ নামের বাড়িতে অনেকক্ষণ কাটিয়ে ফিরে আসি। দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় চন্দ্রবতীর ‘রামায়ণ’ নিয়ে আলাপ করেন দিদি। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ থেকে দুটো পঙ্ক্তি উল্লেখ করে বলেছিলেন, দেখো নারীর জ্ঞানের প্রজ্ঞা কত বিস্তৃত। রাম সীতাকে অগ্নিপরীক্ষায় হাজির করলে চন্দ্রাবতী লিখেছেন : ‘পরের কথা কানে লইলে গো নিজের সর্বনাশ চন্দ্রাবতী কহে রামের বুদ্ধি হইল গো নাশ।’ সে দিন দিদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি চন্দ্রাবতীকে আবিষ্কার করার জ্ঞান নিয়ে ফিরেছিলাম। চন্দ্রাবতী ৫০০ বছর আগের লেখক। তাঁকে পড়ার সুযোগ করেছিলাম এই জানা থেকে। এই বছরের আগস্ট মাসে ত্রিধারা আয়োজিত সম্মেলনে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ত্রিধারা দিদিকে আজীবন সম্মাননা দিয়েছিল। অসুস্থতার জন্য দিদি আসতে পারেননি। পুরস্কার গ্রহণ করেছিল নন্দনা। পরদিন সকালে ফিরে আসব বলে দিদিকে দেখতে যাওয়া হয়নি। এমনই নিয়তি ছিল আমার। এখন দিদির যে বইটি আমার সামনে তার নাম ‘শীত সাহসিক হেমন্তলোক’। ছোট পরিসরের উপন্যাস, শেষ হয়েছে এভাবে ‘আহা ওদের জন্যিই তো পিথিবীটা এ্যাখোনো চলচে, চাঁদসুজ্জি উটচে। অ্যামনটা নইলে আর সন্তান? জগৎ সংসারের হালটা আজও ভাগ্যিস এই রকম সব ভালো মানষের হাতেই ধরা রয়েচে। ওই বলেই তো পাপের ভরা পুন্নো হয়েও ভেসে যায় নিকো, ডুবে যায় নিকো তিনভুবন। হতচ্ছাড়া বুকখানার মদ্দে এ্যাখোনো যে কিসের অ্যাতো মায়া। ঘর ছেড়ে এখেনে এসেও মুক্তি নেইকো। এই জগৎটাকে ছেড়ে দে’ চলে যেতে হবে ভাবলেই বুকখানা ক্যামন ক্যামন কোরে ওটে। কে জানে কী আচে ওপারে? কিচু আচে কিনা? এপারে এই ছেঁড়া খোঁড়া, পোকায় কাটা মনিষ্যি জীবনখানা যেন কাশ্মীরী জামেয়ারের মতোনÑ য্যাতো পুরনো হচ্চে, ত্যাতো য্যানো সোন্দর।’ দেখা যাচ্ছে নবনীতা দেবসেন সাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে আঙ্গিকের যেমন যেমন ব্যবহার করেছেন তেমনি ভাষার নিরীক্ষাতেও পিছিয়ে থাকেননি। বিপুলা পৃথিবীর অনেককিছু তার করতলে প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর সাধানায় অমরত্বের যোগ নিবিড়। তাঁর কবিতা ‘আরোগ্য’ তুলে দিলাম : শুধু তুমি সুস্থ হবে। আমি দিয়ে দেবো আমার কোজাগরী চাঁদ, সাদা দেয়ালের ময়ূরকণ্ঠী আলো, দিয়ে দেবো বিগত বছরের মরা পাখির মমতা, আর আগামী বছরের কলাগাছটির স্বপ্ন। চলে যেতে যেতে সবাই তো বলে গেলো। কুন্তী নদীর গেরুয়া জল তার সবুজ ছায়া কাঁপা ঠাণ্ডা গলায় আমাকে বলেছে, শুকনো সোনালি গোরুর গাড়িগুলো ক্লান্ত কাদাটে গলায় আমাকে বলেছে, আসন্ন মৃত্যুর খস্ খসে গলাতে বলেছে জয়তু নবনীতা দেবসেন। সাহিত্যের ভুবনে চিরকালীন হবে অবস্থান। মৃত্যুর সাধ্য নেই মুছে ফেলার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App