×

সাময়িকী

‘দজ্জাল’ কবি ‘নটী’ নবনীতা অস্তাচলে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৫৪ পিএম

‘দজ্জাল’ কবি ‘নটী’ নবনীতা অস্তাচলে

‘নটী নবনীতা’ ১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় প্রকাশিত নানারঙের টুকরো লেখা একসঙ্গে বুনে এই রচনা সংকলন।

নবনীতা দেবসেন চলে গেলেন। যাওয়ার ঘণ্টা বেজেছিল। জানতাম যাবেন। তিনিও জানতেন। দীর্ঘদিন ধরেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন নবনীতা। তবু দারুণ প্রাণোচ্ছল নবনীতা কিছুদিন আগেই এক নিবন্ধে নিজের অসুস্থতা ও মৃত্যু নিয়ে চূড়ান্ত রসিকতা করেছিলেন। বলেছিলেন- ক্যান্সার হলো মৃত্যুর একটি অজুহাত। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবিদম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারানী দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন নবনীতা। জন্ম ৭২নং হিন্দুস্তান রোডের ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে। ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি। তার ‘নবনীতা’ নামটি রবি ঠাকুরের দেয়া। শেষ শয্যায় শুয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই মেয়ের একটি নাম রেখেছিলেন, ‘অনুরাধা’। নবনীতার জন্মের তিনদিন পরে মৃত্যু হয় শরৎচন্দ্রের। তারপরে এই নামটি আর রাখা হয়নি। মা রাধারানী দেবীর কাছেই পড়াশুনোর শুরু। প্রথাগত শিক্ষা শুরু গোখেল স্কুলে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ পাস করেন। ১৯৫৮-এ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে এমএ। ১৯৬১-তে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসটিংশন নিয়ে এমএ ইংরেজি সাহিত্যে। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে পিএইচডি। পোস্ট ডক ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সবসময় ‘মাই ডিয়ার’ নবনীতা দেবসেনের প্রথাগত পাঠ ও ডিগ্রি অর্জন সম্পর্কে তার নিজের বিশ্লেষণ দারুণ মজার- ওসব হয়ে গেছে, বুঝলি। বিদেশে কাজ আর কি! তখন তো অমর্ত্য’র সাথে সংসার করছি। কাজেই...। ১৯৫৯-এ অমর্ত্য সেনের সাথে বিবাহ। কবিতার হাত ধরেই নবনীতার সাহিত্যজীবনের শুরু। ১৯৫৯-এ প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা সংকলন ‘প্রথম প্রত্যয়’। এ প্রসঙ্গে নবনীতা লিখছেন ‘সময়টা ছিল ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯। আমার কবিবন্ধুদের সকলেরই কবিতাগুলি একে একে সেই প্রথম মলাটবন্দি হতে শুরু করেছে। ‘প্রথম প্রত্যয়’ বেরুল এমসি সরকার থেকে, ১৯৫৯-এ। বই সাজিয়ে দিলেন বন্ধুরাই, আমি শুধু তার উৎসাহী মলাটশিল্পী। ‘প্রথম প্রত্যয়’ তাই আমার ‘প্রথম বই লেখার অভিজ্ঞতা’ নয়, প্রথম কবিতা সংকলন তৈরি করার গল্প। জীবনে প্রথম বই লেখার উদ্বেগ, উত্তেজনা, বুক ধড়ফড়ানি, বারবার নতুন করে প্লট পরিকল্পনা, বারবার বানচাল, আগাপাশতলা অদলবদল করেও মন খুঁত-খুঁত এ সব কাণ্ডকারখানা প্রতিটি একক কবিতা লেখার সময়ে অনুভব করলেও কবিতার বই বেরুনোর সময় কিন্তু অনুভব করিনি। কবিতাগুলো তো সবই পাঠকদের চেনা। নতুন করে উদ্বেগের কী আছে? বিক্রি তো হবেই না।’ কিন্তু না। বিক্রি ভালোই হয়েছিল। খ্যাতিও এসেছিল দ্রুত। তিনি লিখলেন- বৃষ্টিতে ওড়ালো পর্দা/ পর্দা ওড়ে, শ্রাবণ-সকাল/ সব দরজা খুলে যায় পিছনের পথে/ শুকনো পাতা ভিজে,/ পদচিহ্ন ঢেকেছে শৈবাল। বৃষ্টিতে পেতেছি মুখ/ সিক্ত কেশে ঢেকেছি শরীর/ এবার উপরে চোখ তুলে/ প্রথম প্রত্যয়ে বলি/ অসংকোচ নির্ভার আলয়ে /-সব গেছি ভুলে। নবনীতা যখন এ ধরনের লিরিকাল প্রেমভাবনায় আচ্ছন্ন কবিতা লিখছেন, তার বন্ধুরা অর্থাৎ শতভিষা (১৯৫১) কৃত্তিবাস (১৯৫৩) পাল্টে ফেলতে চাইছেন

কবিতা লেখার ধরনধারণ। এরা প্রাতিষ্ঠানিকতা ও গতানুগতিকতার ধ্বজা নামিয়ে শাসন ও সংস্কারমুক্ত কবিতা লেখার পথে এগোলেন। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘স্বাগত দেবদূত’। প্রকাশকাল ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন। কবিতাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে লেখা। লিখেছেন ইউরোপ-আমেরিকা বিদেশবাসে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তে আমি রাজপুত্র’, ১৯৭২-৮৮ সালে রচিত কবিতা। ১৯৭৬ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘আমি অনুপম’। এই উপন্যাস লেখার প্রসঙ্গে নবনীতা বলছেন, “১৯৭৬-এর আনন্দবাজার পুজো সংখ্যায় উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণ পেলুম। রমাপদ চৌধুরীর চিঠিটি পেয়েও বিশ্বাস করতে পারিনি। বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিগ্যেস করলুম, ‘শুরু করি কেমন ভাবে?’ সুনীল বললেন, ‘সর্বদা একটা কোনও অ্যাকশনের মাঝখানে, কিংবা কোনও ডায়ালগের মাঝখানে উপন্যাস শুরু করবে।’ সুনীলের উপদেশ মেনেই ‘আমি, অনুপম’ উপন্যাস লেখা শুরু। জীবনে যা দেখেছি, তাই নিয়েই গল্প। সেই সময়ে চারিদিকে আদর্শের আর বিশ্বাসঘাতকতার ছবি, প্রতিদিন অল্পবয়সি ছাত্রদের মৃত্যু ঘটছে, কখনও পুলিশের হাতে, কখনও দলের ছেলেদের হাতে। গল্পটা রাজনীতির, আর সফল পুরুষের অন্তরমহলের হার-জিতের কাহিনিও বটে। নাম ‘আমি, অনুপম’ হলেও বইটি লেখা তৃতীয় পুরুষে। ওটাই আমার একমাত্র পুরুষকেন্দ্রিক বই।” ১৯৭৫ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকার পদে। ঘর ভাঙার টানাপড়েন শুরু হয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে ঘটল বিচ্ছেদ অমর্ত্য সেনের সাথে। দুই কন্যা নিয়ে আলাদা হয়ে তিনি পুরোপুরি কলকাতাবাসী। এই বিচ্ছেদে যত না পীড়িত হয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি পীড়িত ছিলেন সেই সময় নিয়ে। লিখলেন- “আমার মাথায় অনেক অস্থির অনুভূতি তোলপাড় করত তখন, অনেক ক্রোধ, অনেক অসহায় শোক। সময়টা উত্তাল, নকশাল ছেলেদের নানাভাবে তত্ত্বজ্ঞান দিয়ে মরণপণ আদর্শে উৎসাহিত করে অনায়াসে প্রাণ নিতে আর প্রাণ দিতে শিখিয়ে দিয়ে নিজেরা পিছু হটে হিল্লি দিল্লি পালিয়ে যাচ্ছে আমাদের বন্ধুগণ। বাঙালি বুদ্ধিজীবী তাত্ত্বিক গুরুদেবরা। নিজেদের মুখনিঃসৃত বাণীর দায়িত্ব তারা নেননি। আমার ধরনের কবিতায় আমি এই সব অনেক কিছুই বলতে পারি না, তার জন্যে গদ্য চাই” (‘আমার প্রথম বই’ (রবিবাসরীয়), আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৪ নভেম্বর ২০১২)। কবিতার কলম সরিয়ে রেখে গদ্যের তরবারির সাহায্যে জীবনযাপনে বুদ্ধিজীবিদের দ্বিচারিতা ও স্খলনের ছবি আঁকলেন নবনীতা তার উপন্যাসে। ১৯৭৭ সালে শারদীয় কৃত্তিবাসে প্রকাশিত নবনীতার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘প্রবাসে দৈবের বশে’। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। ‘আমার অনুপম’ উপন্যাসের পটভূমি ছিল উত্তাল সত্তরের দশক, এই উপন্যাসের ভিত্তিভূমি তারই উত্তরকালে বিদেশে ইউরোপে। সময়ের পরিবর্তিত স্রোতধারায় নকশাল আন্দোলন যখন স্তিমিত, তারা আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভুল বুঝতে পারছে তারই প্রতিনিধি হিসেবে নবনীতা আঁকলেন ‘বিপাশা’ চরিত্রকে। বিপাশা বাঙালি মেয়ে, একদা নকশাল, এখন বিদেশে থাকে, ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখে, এখন তার আদর্শগত শিকড় নেই। পূর্ব ইউরোপের চেক প্রজাতন্ত্রে লেখক-শিল্পীদের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে সে দেখে সবাই তাকে অবহেলা করছে। তার আত্মাভিমান তীব্র হয়ে ওঠে। ভালো করে মনে করুন তো আরেকটি উপন্যাসের নায়কের চরিত্রের সাথে মিল পাচ্ছেন কি না? ঠিকই ধরেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর নায়ক ‘অতীন’ নবনীতার ‘বিপাশা’র আদলে গড়া। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে কিন্তু তিনি সময়কে ধরেননি। তাঁর ‘রক্তে আমি রাজপুত্র’ (১৯৭২) সত্তরের গোড়ায় লেখা সব কবিতা। সেখানে তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব পথে নিজ ভঙ্গিমায় চলা এক অনন্যা নারী। তিনি লিখছেন- অন্যের চৌকাঠে বসে গৃহস্থালি খেলা সারা হলে/এবার নিজের ঘর গড়ো/ এখন নিজের হাতে নিজেকে নির্মাণ/ সদর্পে হরণ করো নিয়তির শাড়ি। অথচ এই সময়ে লেখা ছোটগল্পে তিনি অসম্ভর আটপৌরে। যেমন ‘পরীক্ষা’ গল্পে তার নিজের ব্যক্তিজীবনের খোলাপাঠ তিনি ব্যক্ত করেছেন এক অসম্ভব নৈপুণ্যে। তিনি লিখছেন- ‘সকাল থেকে সকাল পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টা ওর পেছনেই আছি। ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে উঠি। উঠে মেয়েকে তুলে দেই...। আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ফাইনালি ৬টায় উঠে চা খেয়ে গায়ে জোর পেয়ে রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করি। এবার মেয়ে ওঠেন।’ এখানেই তিনি সমসাময়িক সাহিত্যিকদের থেকে পৃথক অবস্থানে দাঁড়িয়ে। আবার ‘খেসারৎ’ গল্পে সব হারানো সাধারণ মানুষের বুকফাটা আত্মবিলাপ। তিনি লিখছেন- ‘মোর ঘরকে কি কম লুক মেইরেছো সরকার? খেসারৎ দিবেক লাই? প্যাটের বিটাটো ফাউ। হুঁ- পুরো দশ হাজার’।

কলকাতার বাংলা অ্যাকাডেমিতে বছর দেড়েক আগে একটি অনুষ্ঠান। পায়ের সমস্যায় নবনীতা’দি ও স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের দোতলায় অনুষ্ঠান মঞ্চে যাওয়া বেশ কষ্টকর। ধরে নিয়ে আসার জন্যে আমাকে এবং আরেক ক্ষীণতনু বিখ্যাত কবিকে নিচে পাঠানো হলো। আমাদের দেখেই চিৎকার করে বললেন- বাহ, আমাদের নিতে এলেন এক দুবলা আরেক হাতভাঙা (আমার ঢাকায় হাত ভেঙেছিল ও অস্ত্রোপচার হয়েছিল)। আজকাল কি সুনীলের মতো তাগড়া কবি তৈরি হয় না? বলে নিজেই হেঁটে হেঁটে উঠে গেলেন ওপরে। একেবারে একা।

১৯৮৯ সালে তিনি লিখলেন বৃদ্ধাবাসের কাহিনী- ‘শীতসাহসিক হেমন্তলোক’। সেখানে শত বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে চরিত্ররা বেঁচে থাকেন, সেখানে মৃত্যু নয় সংগ্রাম করে জীবনের জয়গানই প্রধান হয়ে ওঠে। নব্বই দশকের সর্বাপেক্ষা রাজনৈতিক অভিঘাতে আলোড়িত রামমন্দির বাবরি মসজিদের ঘটনা ও সমকামিতাকে মিশিয়ে লিখলেন উপন্যাস ‘বামাবোধিনী’ (১৯৯৬)। এর আত্মায় মিশে গেছে সীতার মিথ ও ময়মনসিংহের কবি চন্দ্রাবতীর জীবন এবং বিংশ শতাব্দীর নারী। নারীত্বের এক অবাক মেলবন্ধন। এই উপন্যাসে দ্বিপদী পদ্যে বিভিন্ন গানের সমাহার আছে উপন্যাসজুড়ে। এই উপন্যাসে তিনি নারীর সমস্যা তুলে ধরছেন, কিন্তু ২০০৪ সালে তার বিখ্যাত কবিতা ‘নাজমা’য় দেখি অন্য ছবি। গুজরাট দাঙ্গার প্রেক্ষিতে লেখা এই কবিতায় প্রকাশিত তার বিক্ষুব্ধ অভিমান, ব্যথিত হৃদয়। তিনি লিখছেন- ‘নাজমা, ওটাই শেষ নয়, শেষ কথা/ আমরা আছি হাত ধরে তোর পাশে/ পাপের ভরা পূর্ণ পৃথিবীতে/ এবার বাঁচার একটাই পথ, ওঠা।/ অধঃপাতের ঠাঁই আর কোথা?’ এখানে সমস্যার সাথে উত্তরণের পথও বর্ণিত। এখানে নাজমাদের প্রতিজ্ঞা- ‘হার মেনো না, শক্ত হয়ে থাকো/ এই পৃথিবীর বদল হতেই হবে’। নবনীতা একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং অবশ্যই প্রাবন্ধিক। ২০০৩ সালে তার প্রবন্ধ ‘রাজ্যটাকে ধরেছে জ্বরে’ প্রবন্ধে তিনি সংবাদমাধ্যমের ওপরে প্রকাশ করেছেন তার বিরক্তি। তিনি লিখছেন- ‘কাগজ পড়তে ভাল লাগে না, কেবলই নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়ে যায় কাগজ পড়তে পড়তে- কিন্তু ওখানেই দেশের নাড়ীটা তো টেপা যায়’। তার লেখায় স্বতঃস্ফূর্ততার স্বাদ পাই ‘ভালো-বাসার বারান্দায়’ (২০১০)। এখানে তার বারান্দায় বসে আমরা পরিচিত হই তার সমকালীন বিশ্বের সাথে। ১৯৯৯ সালে তার রচনা সংকলন ‘নটী নবনীতা’ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় প্রকাশিত নানারঙের টুকরো লেখা একসঙ্গে বুনে এই রচনা সংকলন। সূক্ষ্ম হিউমারে রসসিক্ত। জীবনে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি এসেছে তার ঝুলিতে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৯৯), পদ্মশ্রী (২০০০), আকাদেমি জীবনকৃতি পুরস্কার (২০০৩) এবং বিদ্যাসাগর পুরস্কার (২০০৮)। কিন্তু তার মতে তার সেরা পুরস্কারলাভ হলো নীরদ সি চৌধুরীর কাছে ‘দজ্জাল মেয়ে’ উপাধি লাভ। অক্সফোর্ডে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছেন নবনীতা। ‘কোথায় পড়াও’ প্রশ্নের উত্তরে নবনীতার জবাব, যাদবপুর। নীরদবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘ওটা একটা ধাপ্পা। কী পড়াও?’’ নবনীতার উত্তর, ‘‘তুলনামূলক সাহিত্য।’’ নীরদবাবুর ফের মন্তব্য, ‘‘ওটা আর একটা ধাপ্পা।’’ নবনীতা শান্ত স্বরে বললেন, ‘‘আমি ওটা পড়াই তো! ফলে জানি, ওটা ধাপ্পা নয়।’ এই আলোচনায় সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন অক্সফোর্ডবাসী ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। নবনীতা উঠে আসার পরে নীরদবাবুর জিজ্ঞাসা, ‘‘মেয়েটা খুব দজ্জাল, না?’’ তপনবাবু হেসে বলেছিলেন, ‘‘বিলক্ষণ! সে আর বলতে!’’ নবনীতা যে কতটা দজ্জাল তা আমরা গত ৯ অক্টোবর তার নিজেকে নিয়ে একটি লেখায় পাই। তিনি লিখেছেন- ‘ঠিক আছে। না হয় ক্যান্সারই হয়েছে। ক্যান্সার এখন অলক্ষ্মীর ঝাঁপির মতো ঘরে ঘরে গুছিয়ে বসেছে। আমিই বা বাদ যাই কেন!... হঠাৎ অশীতিপর নবনীতার জন্যে এত শোক কীসের! তার তো যাবার সময় এমনিতেই হয়েছে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কচি বাচ্চার মহাপ্রয়াণ হতে চলেছে।... এই যে এত লম্বা জীবন কাটালুম তার একটা যথাযথ সমাপন তো দরকার। পাঁজিপুঁথি দেখে শুভদিন শুভলগ্ন স্থির করে স্বজনবান্ধবকে নেমন্তন্ন খাইয়ে তবে তো শুভযাত্রা।... দ্যাখো বাপু, এই বিশাল পৃথিবীতে কতরকম বড় বড় লড়াই যুদ্ধ চলছে সেখানে তোমার ওই লাঠিসোঁটায় ভোয় পাব ভেবেছ? ওসব তো তুচ্ছু। ‘আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি- জানিস আমি স্যান্ডো করি?’ (সংবাদ প্রতিদিন- ৯ অক্টোবর, ২০১৯। এটাই তার শেষ লেখা)। কবি জয় গোস্বামী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন- ‘মাস তিনেক আগে কাবেরী আর বুকুনকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে দেখা করতে যাই। দেখা হতেই আমাকে বললেন, ‘‘তোরা কি আমার ক্যান্সার হয়েছে বলে দেখা করতে এসেছিস? ধুস্স, ওতে ভয় পাওয়ার কী আছে?’’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় স্মৃতিচারণ করলেন এভাবে- ‘দুরারোগ্য রোগে ভুগছে জেনেও এখানে ওখানে চলে যেত। আসলে ও অকুতোভয় মেয়ে। হাঁটতে খুব অসুবিধা হতো। লাঠি নিয়ে ঘুরত। কিন্তু শরীর নিয়ে ওর আলাদা কোনও ‘আহা উহু’ ছিল না। কোনও অভিযোগও করত না।...ও পাশে বসলে এক এক সময় মনে হতো যেন ডায়ানামোর পাশে বসে আছি! এমনই ওর প্রাণশক্তি। প্রচণ্ড কথা বলত। কোনও আজেবাজে কথা নয়, আসলে ওর কথা শুনতে আমি ভালবাসতাম। ও যেমন হাসত, হাসাতেও পারত।’ ওতপ্রোতভাবে তিনি জড়িয়ে ছিলেন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সাথে। আর তার সৃষ্ট একটি সংগঠন ‘সই’। ২০০০ সালের ৩০ নভেম্বর জন্ম নিয়েছিল ‘সই’ নবনীতা দেবসেন যার সভানেত্রী, যেখানে বন্ধুত্বের বাঁধনে জড়িয়ে আছেন সারা ভারতের মহিলা লেখকরা। মেয়েদের লেখা, সম্পাদিত, প্রকাশিত বই নিয়ে করতেন সই মেলা। সেখানে কেনা ও দেখার জন্য কি কি থাকে? বাংলার মেয়েদের হাতে আঁকা ও ক্যামেরায় তোলা ছবি, তাঁদের তৈরি ভাস্কর্য। জমজমাট মেলায় গল্প-কবিতা-নাটক পড়েন মহিলা কবি, শিল্পী, অভিনেতা। পরস্পরকে জানান আপন জীবনের বিচিত্র সব কাহিনী। আলোচনা করেন, কেন লেখেন। বলেন মেয়েবেলার ভয়েদের কথা। আলোচনা চলে একক মাতৃত্বের সুখদুঃখ নিয়ে। মেয়েদের নিয়ে তিনি তীব্র সংরাগে লেখেন- গহন মালতী কেন স্তব্ধ?/ এক কাপড়ে বসে আছো, একবেণী, রজোলিপ্তা?/ ওঠো, ওঠো, মেয়ে/ এ নহে প্রেতিনীজন্ম, তুমি/ অর্ধেক মানুষী আর/ অর্ধেক মনসাঝোপ নও ওঠো, ওঠো/ রঙ্গিনী যক্ষিণী হয়ে/ শৈলমূলে দাঁড়াও কঠিন/ জীবন আগলাও/ সমস্ত প্রস্তর, সব বর্ণহীন থান/ লণ্ডভণ্ড করে, ঐ দ্যাখো/ কাঁটাঝোপে ফুটে আছে ফুটফুটে/ গহন মালতী চিনে নাও/ কবি মেয়ে/ ও তোমারি স্পর্শনে ফুটেছে- নবনীতার আরেক দিক তার ভ্রমণ সাহিত্য। বেড়ানোর গল্প বলে নবনীতা দেবসেন শিক্ষিত বাঙালিকে একেবারে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। ‘শিক্ষিত বাঙালি’ কথা আমি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম। তার বাক্য, শব্দ চয়ন, ঘটনার উপস্থাপনা সাধারণ বেড়ানোর লেখাগুলোর মতো নয়। রস অনুধাবনের জন্য পাঠককে প্রস্তত থাকতে হয়। বেড়ানোকে কীভাবে গল্প করে তোলা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন নবনীতা। সেই বেড়ানোয় অ্যাডভেঞ্চারকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল রসবোধ। আমি কীভাবে ট্রাকে চেপে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেটা বড় কথা নয়, সে কথা কীভাবে পাঠকদের রসে সিঞ্চিত করে বলেছি সেটাই বড় কথা। বাঙালির ভ্রমণসাহিত্য অতি সমৃদ্ধ। দিক্পালরা লিখেছেন। নবনীতা সেই ধারা গৌরবের সঙ্গে রক্ষা করেছেন। নবনীতা দেবসেন তো শুধু একজন ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠানও বটে। কবিতা-গল্প-উপন্যাস তো বটেই, ও ছোটদের জন্যও গল্প লিখেছে প্রচুর। অনেকেই জানেন না, তিনি অসাধারণ রূপকথা লিখতে পারতেন। শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য এ বছর সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেতে চলেছেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। ‘জগমোহনবাবুর জগৎ’, ‘খগেনবাবুর পৃথিবী’, ‘পলাশপুরের পিকনিক’, ‘বুদ্ধিবেচার সওদাগর’ যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে গল্পগুজব, অন্যান্য গল্প, বসন মামার বাড়ি, মসিয়ে হুলোর হলি ডে, স্বাগত দেবদূত, তিন ভুবনের পারে’র মতোও অসাধারণ কিছু কাব্যগ্রন্থ। সবশেষে একটা ব্যক্তিগত ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। কলকাতার বাংলা অ্যাকাডেমিতে বছর দেড়েক আগে একটি অনুষ্ঠান। পায়ের সমস্যায় নবনীতা’দি ও স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের দোতলায় অনুষ্ঠান মঞ্চে যাওয়া বেশ কষ্টকর। ধরে নিয়ে আসার জন্যে আমাকে এবং আরেক ক্ষীণতনু বিখ্যাত কবিকে নিচে পাঠানো হলো। আমাদের দেখেই চিৎকার করে বললেন- বাহ, আমাদের নিতে এলেন এক দুবলা আরেক হাতভাঙা (আমার ঢাকায় হাত ভেঙেছিল ও অস্ত্রোপচার হয়েছিল)। আজকাল কি সুনীলের মতো তাগড়া কবি তৈরি হয় না? বলে নিজেই হেঁটে হেঁটে উঠে গেলেন ওপরে। একেবারে একা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App