×

সাময়িকী

তিনি সীতার দুঃখ বোঝার আদর্শজন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:৩২ পিএম

তিনি সীতার দুঃখ বোঝার আদর্শজন
তিনি আমাদের প্রধান সই। নবনীতা দেবসেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথ। তিনিই তো সীতার দুঃখ বোঝার আদর্শজন।
‘বিণাপাণি বিপণী’ কি সুন্দর গানের মতন ছন্দ মেলানো নাম। এই নামটাই গোখেলে পড়বার সময় কোনো দোকানের হোর্ডিংয়ে দেখে ভাবলেন বেশ হয়, যদি এটা তার নিজের নাম হয়। এমন চিন্তা সাত বছর বয়সে কারো মাথায় কি কখনও আসে? না কি আসা সম্ভব। তারও আগে যখন তিন বছর বয়স তাঁর পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কারো নাম নবনীতা নয় বলে শেষে কাজের মেয়ে নির্মলার নাম পছন্দ হলো। কি সুন্দর ছন্দময়। কুচবিহারে তখন মামাবাড়ি বেড়াতে গেছেন। লুকিয়ে কোলকাতায় বাবাকে রিকোয়েস্ট জানিয়ে চিঠি লিখলেন। তিনি যেন নির্মলা নামে ডাকেন। চিঠির উত্তর এলো ডাকে। সবাই জেনে গেলো। অভিমান হলো তার বাবার ওপর। ভাবুন। মাত্র তিন বছর বয়সে বাংলা ইংরেজি লিখতে ও পড়তে পারতেন তিনি। তার ওপর ঐ বয়সে লুকিয়ে চিঠি পোস্ট! ভাবা যায়? আসলে তিনি যে তখন ভবিষ্যতের নবনীতা দেবসেন। একে একে গোখেল মেমোরিয়াল, লেডি ব্রাবোর্ন, প্রেসিডেন্সি কলেজ, পেরিয়ে কম্প্যারিটিভ লিটারেচারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি কমপ্লিট করলেন প্রথম হয়ে এশিয়ার মধ্যে প্রথম মহিলা হয়ে। তারপর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি, ক্যামব্রিজ, পিএইচডির পর পোস্ট ডক্টরাল করলেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। দীর্ঘদিন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কম্প্যারিটিভ লিটারেচারে অধ্যাপনা করেছেন। দেশ-বিদেশে বারংবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গেছেন। তার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। তিনি নবনীতা দেবসেন। হ্যাঁ। তাঁর এই নবনীতা নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয়া। না ঠিক তাঁকে প্রথমে নয়। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কবি দম্পতি নরেন দেব ও রাধারানী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাধারানী দেবী প্রথমে বাল্যবিধবা হন তেরো বছর বয়সে। পরবর্তীতে তিনি যখন কবি হিসেবে পরিচিত হলেন এবং নরেন দেবের সংস্পর্শে আসেন। দুজনে স্বইচ্ছেতে বিবাহ করেন। এই বিবাহে রাধারানী দেবীর আগের শ্বশুরবাড়ির পূর্ণ সমর্থন ছিল। কিন্তু তিনি নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করেন। কারণ একবার তাঁকে তাঁর বাবা সম্প্রদান করেছিলেন পূর্বে। এত সূক্ষ্ম বোধ। তাই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বললেন তুমি তো নতুন জীবনে আনীত হলে। তাই তোমার নাম থাক নবনীতা। কিন্তু ততদিনে রাধারানী দেবী ঐ নামেই পরিচিত হয়ে গেছেন। নামটা তাই তোলা থাকলো। পরবর্তীতে নবনীতা জন্মানোর সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি মারফৎ মনে করিয়ে দিলেন এবার যাকে নামটা দিতে চাই সে তো এখন কোনো পরিচয় পেয়ে ওঠেনি তাই এই নামটা তার থাক। কী অপূর্ব পূর্ব পরিকল্পনা হয়ে থাকে সবকিছু! ওদিকে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দিদির স্বামী। বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও তাঁরা বন্ধু ছিলেন শেষদিন অবধি। আর রাধারানী দেবী অপরাজিতা নাম নিয়ে কবিতা লিখতে লাগতেন। সে এক মজার ব্যাপার। এই দুই নামেই রাধারানী দেবীর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি আসতো। কিন্তু তিনি জানতে পারেননি এই দুজন আসলে একজন। কী ভীষণ সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছিলেন আমাদের বাংলা সাহিত্যের আমানত। ১৩ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে দিদির জন্ম। মাত্র বারো বছর বয়সে নিজে লিখে কবিতা পাঠিয়েছিলেন দপ্তরে। তারপর কবিতা কবিতা ..১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম প্রত্যয়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনা নটী নবনীতার জন্য ভারত সরকার তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস আমি অনুপম। তাঁর প্রকাশিত বই আশিটির বেশি। শিশু সাহিত্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ সমস্ত বিষয়েই তিনি শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। এই ভার্সেটাইল লেখিকার অন্তরের স্পর্শ যারাই পেয়েছেন তারাই জানেন কী ভীষণ শিশুমানবী ছিলেন তিনি। কী ভীষণ স্নেহপ্রবণ। তিনিই পারেন ভালো-বাসা বাড়ির বারান্দায় বসে চেনা গণ্ডির রেফারেন্স টেনে এক লহমায় গোটা বিশ্বের হাল হকিকত পাঠকের মনের দরবারে প্রকাশ করাতে। ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ বাংলা সাহিত্যের এক ক্লাসিক ভ্রমণকাহিনী। সত্যি এককথায় বলতে কি দিদির সাথে মনের মধ্যে ডুব দিয়ে বিশ্বের আনাচ-কানাচে আধুনিক রুচিশীল রসিক মননশীলতায় শুধু পাঠ নয়, মানসিক ভ্রমণ হয়ে যায়। সে এক অনন্য অনুভূতি। তাঁর সাহিত্য কীর্তি তাঁকে এনে দিয়েছে পদ্মশ্রী, সাহিত্য আকাদেমি, ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণপদক, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, মহাদেবী ভার্মা পুরস্কার, কমল কুমারী ন্যাশনাল আওয়ার্ড, হারমনিসহ বহু পুরস্কার। কিন্তু পুরস্কার দিদিকে তাঁর সাবলীল সহজ সরলতা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এক অদ্ভুত হৃদয় অনুসরণকারী মন তাঁর। সাক্ষাতে হোক, ফোনে হোক, হোয়াটস অ্যাপে হোক দিদির সংস্পর্শ যখনই এসেছে তখনই এক আকাশ মননশীল আনন্দ। খুঁটিনাটি সবার সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর ওপর দিদির ভীষণ তীক্ষ্ম লক্ষ্য ছিল। কত গভীর রাত অবধি দিদি লিখতেন। এতটুকু ফাঁকি নেই। শরীর সঙ্গ দিতো না। তবু শরীরের যন্ত্রণাকে পাত্তাই দিতো না দিদি। দিদির বাড়ির নাম ভালো-বাসা। ৭২নং হিন্দুস্তান পার্ক। সেই বাড়িতে শরৎচন্দ্র এসেছেন, সুচিত্রা সেন, পি ভি নরসিংহ রাও, মনমোহন সিংহ, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও উল্লেখযোগ্য বহু বিদগ্ধ গুণীজন। খুব খাওয়াতে ভালোবাসতেন দিদি। তাঁর ভালোবাসায় সদস্য হয়ে থেকে গেলেন কানাই দা, ঝর্না বৌদি, নীলুদি, অমিত দা, বাবুসোনা, শিবু, কেলটুস (পোষা কুকুর), দুটো মোরগ, বারান্দার গাছেরা। এক জায়গায় দিদি বলেছেন ...‘জীবনে আমার যা কিছু প্রাপ্তি, সবেতেই একটা চরম ব্যাপার থেকে যায়। কিন্তু শিল্পে? শিল্পেও কি তাই? হাসি হাসি চোখটা দিয়ে লিখি খোশগল্প। দুঃখী চোখটা তাকিয়ে থাকে কেবল ভিতর পানে, কবিতা লেখে আর দুটো চোখ সামনে করে ভেতর বাইরে পাশাপাশি মেলে রেখে লিখি প্রবন্ধ উপন্যাস।’ আমি তাঁর সই। তিনি আমাদের প্রধান সই। নবনীতা দেবসেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথ। তিনিই তো সীতার দুঃখ বোঝবার আদর্শজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App