×

জাতীয়

তিনটি সিগন্যাল না মেনে ছুটে যায় তূর্ণা নিশীথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৪২ এএম

পরপর তিনটি সিগন্যাল না মেনে তূর্ণা নিশীথা প্রায় ৭০ কিলোমিটার বেগে আঘাত করে উদয়ন এক্সপ্রেসকে। যে কারণে গত সোমবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সিগন্যালগুলো কেন ত‚র্ণার চাকলদের চোখ এড়িয়ে গেল, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। দুর্ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছেন ট্রেনটির গার্ড, চালক ও তার সহকারী। এদিকে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর এ খাতের সংস্কারের আলোচনা আবারো সামনে চলে এসেছে। বিশেষজ্ঞারা বলছেন, চোখে দেখা মান্ধাতার আমলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাবে। রেলমন্ত্রী ও রেলের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। গতকাল বুধবার সকাল থেকেই জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিগুলো আলাদা আলাদাভাবে কাজ শুরু করে। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল, ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গে কথা বলেন। দুর্ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও কথা বলেন তারা। এ ছাড়া তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বক্তব্য নেয়া হয়। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিয়া জাহান জানান, কুমিল্লা থেকে আখাউড়া রেললাইনটি সিঙ্গেল হওয়ায় সোমবার রাতে উদয়ন ট্রেনকে স্টেশনে অপেক্ষায় রেখে তূর্ণা নিশীথাকে যেতে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত ছিল উদয়ন এক্সপ্রেস স্টেশনে প্রবেশের আগ পর্যন্ত মন্দভাগ স্টেশনের আউটার লুপে থাকবে তূর্ণা নিশীথা। সে অনুযায়ী সিগন্যাল দেয়া হয়। কিন্তু আমরা জানতে পারি, পরপর তিনটি সিগন্যাল অমান্য করে ৬০-৭০ কিলোমিটার বেগে উদয়নকে আঘাত করে তূর্ণা নিশীথা। তিনি বলেন, তূর্ণা নিশীথার চালক ও সহকারীর দায়িত্বহীনতার কারণে এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ঘটনার পর থেকে তূর্ণা নিশীথার লোকোমাস্টার তাছের উদ্দিন, সহকারী লোকোমাস্টার অপু দে ও ওয়ার্কিং গার্ড আব্দুর রহমান পলাতক রয়েছেন। তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি : গতকাল সকালে কসবার মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে যান জেলা প্রশাসনের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্ত কমিটির প্রধান মিতু মরিয়ম বলেন, মঙ্গলবার থেকেই আমরা তদন্ত কাজ শুরু করেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তদন্ত চলছে। তিনি জানান, এরই মধ্যে নিহত সবার পরিচয় পাওয়া গেছে এবং মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে গতকাল বিকেল ৪টার দিকে অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে মন্দভাগ রেলস্টেশনে যান রেল মন্ত্রণালয়ের চার সদস্যের তদন্ত কমিটি। তারা দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। পাশাপাশি মন্দবাগ স্টেশন মাস্টার জাকের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে স্টেশনের প্যানেল বোর্ড ও রেজিস্টার থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন তারা। আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা জানিয়েছে এই কমিটি। পরিদর্শন শেষে রেল মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) ও তদন্ত কমিটির প্রধান মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এখানে যে তথ্য-উপাত্ত আছে সব আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আরও যেসব তথ্য পাওয়া যাবে সেগুলো পর্যালোচনা করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। কান্না থামছে না স্বজনহারাদের : বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেও ছোট্ট মেয়ে সোহাকে বাঁচাতে পারেননি মা নাজমা আক্তার। দুর্ঘটনায় দুই পায়ের হাড় ভেঙে গেছে নাজমা আক্তারেরও। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) বাতাস এখন সন্তানহারা মায়ের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে। ক্ষণেক্ষণেই মাতম করে উঠছেন তিনি। দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তার দুই বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে আদিবা আক্তার সোহাকে। নাজমা বলেন, অনেক শান্ত ছিল আমার মেয়েটি, কিছু পেলেই অনেক খুশি হতো। শান্ত স্বভাবের বলে সবাই তাকে আদর করত। দুই ছেলেমেয়ে আর স্বামী সংসার নিয়ে অনেক সুখে ছিলাম। ট্রেন দুর্ঘটনা আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে। দুর্ঘটনার সময় শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেও মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর দেখি তার শরীর অর্ধেক চাপা পড়ে গেছে। এ সময় বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকি। পরে শুনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি হাসপাতালে মারা যায় সোহা। ওই দুর্ঘটনায় নাজমা আক্তারের স্বামীর বাম পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। একই হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে তাকে। চার বছর বয়সী ছেলে নাফিজুল হক নাফিজ ডান হাতে বাঁধা ব্যান্ডেজ নিয়ে একবার মায়ের কাছে, আরেকবার বাবার কাছে ছুটে আসছে। নাজমা আক্তারের পাশের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন সুরাইয়া খাতুন। তারও দুই পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। দুর্ঘটনায় মেয়ে জাহিদা খাতুনকে হারিয়েছেন তিনি। ওই দুর্ঘটনায় আহত আবুল কালাম, হাসান আলী, ইমন, নিজাম, সোহেল মিয়া, মফিজ ও রায়হানসহ নয়জন একই হাসপাতালে ভর্তি হন। অপমৃত্যুর মামলা দায়ের : দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় গত মঙ্গলবার রাতে একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে আখাউড়া রেলওয়ে থানায় মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার জাকের হোসেন চৌধুরী মামলাটি দায়ের করেন। আখাউড়া রেলওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শ্যামল কান্তি দাস বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, স্টেশন মাস্টার থানায় একটি ইউডি (অপমৃত্যু) মামলা করেছেন। ফলে এতে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। তদন্তে যদি এটি অবহেলাজনিত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে পাওয়া যায়, তবে মামলাটি পরে হত্যা মামলাও হতে পারে। রেল খাতে সংস্কার প্রয়োজন : তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় রেল খাতের সংস্কারের বিষয়টি আবারো সামনে চলে এসেছে। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, সিগন্যাল অমান্য করার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনেও অনেকটা স্পষ্ট যে, তিনটি সিগন্যাল না মেনে এগিয়ে গিয়েছিল তূর্ণা নিশীথা। কিন্তু কেন এমনটি ঘটল? এ প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চালকদের অতিরিক্ত পরিশ্রম এর একটি কারণ হতে পারে। ক্লান্ত চালক হয়তো তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে, দুুর্ঘটনা প্রতিরোধে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা না থাকাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক কর্মকর্তা জানান, দুর্ঘটনার সময় ‘তূর্ণা নিশীথা’ ছিল অটো ব্রেকে। মূলত বিরতিহীন ট্রেন হওয়ায় অটো ব্রেকে রেখেই লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। একটা নির্ধারিত দূরত্বের পর ট্রেনটি থেমে যেত। কিন্তু এর আগেই ট্রেনটিকে থামার সিগন্যাল দেয়া হয়। এর বাইরে আউটার, হোম, স্টার্টারসহ বেশ কিছু কারিগরি প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু সবগুলোও তাদের চোখে পড়েনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, রেলওয়েতে এখন অবকাঠামো এবং ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু জনবলের ঘাটতি রয়ে গেছে। সে কারণে চালকদের বাড়তি চাপ দুর্ঘটনার বড় কারণ হতে পারে। রেল দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আবু সাঈদ বলেন, ট্রেনের দুর্ঘটনার এড়াতে উন্নত বিশ্বে জিপিএস নির্ভর অনেক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতেও রয়েছে। এতে কোন লাইনে কোন ট্রেন কত গতিতে যাচ্ছে সব মনিটরে দেখা যায়। চালকের সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের রেডিও যোগাযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এত বছরেও সে ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে মন্ত্রীসহ রেলের ঊর্ধ্বতনরা কেউই এর দায় এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App