×

মুক্তচিন্তা

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আমাদের প্রতি সদয় ছিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৫০ পিএম

ঘূর্ণিঝড় যে আশঙ্কা নিয়ে ধেয়ে আসছিল সেটি শেষ পর্যন্ত ঘটেনি- এটি আমাদের জন্য মস্তবড় স্বস্তির বিষয়। আমাদের সুন্দরবনকে সত্যি সত্যি সুন্দর করে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, উপকূলবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলকে দ্রুতই সজীব করে তুলতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে, প্রকৃতিকে আবার সাজিয়ে তুলতে হবে। তাহলে বুলবুল বা অন্য কোনো ঘূর্ণিঝড় এই ভূখণ্ডে চোখ ফেলে এর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ফিরে যেতে পারে। সেভাবেই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ নিয়ে প্রতিবারই আমরা কমবেশি মজা খুঁজে পাই। এর আগে ফণী রুদ্রবেশে ধেয়ে এসেও কেন যেন আমাদের কুপোকাত করতে চাইল না সেটা ফণী বাবুই ভালো বলতে পারবেন। এ রকম প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম থেকে একেক ধরনের অনুভূতি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করতে আমাদের নামতে হয়েছিল। এবার বুলবুলের কথা শুনে কয়েকবার বুঝতে হলো এ আবার কোন বুলবুল? মানুষ আর পাখির নাম বুলবুল হয় জানি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের নাম বুলবুল শুনে কিছুটা সুখানুভূতি পেয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছি বুলবুল তো আমাদেরই কোনো সহজাত হতে পারে। সুতরাং যতই তাণ্ডব নিয়ে ভারত মহাসাগর থেকে ধেয়ে আসুক না কেন কূলে এসে বুলবুল মানুষের আর্তনাদ দেখে হয়তো দ্রুতই সমুদ্রে মিলে যেতে পারে অথবা এদিক ওদিক করে নিজের শক্তি বিলীন করে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত বুলবুল তাই করল। যদিও আবহাওয়া দপ্তর আমাদের ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জানিয়ে ১৯৭০ সালের মহাজলোচ্ছ্বাসের আতঙ্ক পাইয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের ৩০-এর অধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেল যেভাবে মহাসংকেত ঘন ঘন প্রচার করছিল, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল থেকে নানা ধারা বিবরণী প্রচার করে যাচ্ছিল তাতে শনিবার দুপুর পর্যন্ত আতঙ্কেই সবার কেটেছিল। কিন্তু দুপুরের পর থেকে যখন বুলবুল এদিক ওদিক গতিপথ হারাতে থাকে তখন মনে মনে বুলবুলের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতার কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠতে থাকে। যখন শোনা গেল বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উড়িষ্যা বিহার পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের দিকে মুখ দেবে তখন নিশ্চিত হলাম দক্ষিণ-পশ্চিমের সুন্দরবন বুলবুলকে হয় আগলে ধরবে নতুবা জড়িয়ে ধরে নিস্তেজ করে দিবে। এ ধরনের নানা অনুভূতি মনের মধ্যে শনিবার রাতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেই অনুভূতি নিয়েই যখন ঘুমুতে যাই তখন জানতে পারি কলকাতায় আঘাত হানলেও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের তাণ্ডব বুলবুল সেখানে দেখায়নি। বুলবুল ক্রমেই মানুষের প্রতি দুর্বল হয়ে উঠেছিল। বলা হলো রাতের দিকে সুন্দরবন এবং দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল দিয়ে বাংলাদেশে শেষ রাতে বা সকালে উঁকি দেবে। ফলে অনেকটাই নিশ্চিন্তে ঘুমুতে যেতে পারলাম। রবিবার সকালে ঢাকার আবহাওয়া বৃষ্টি আর হালকা দমকা হাওয়ায় যা জানান দিল তাতে মনে হলো বুলবুল আমাদের প্রতি যথেষ্ট সদয় হয়েছে। টিভি খুলে সেরকমটি জানা গেল। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে কয়েকটি অঞ্চলে বুলবুলের ঘূর্ণিবায়ু, বৃষ্টিপাত তখন চলছিল। তবে তেমন ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের আর কোনো সংখ্যা কেউ প্রকাশ করল না। সারাদিন বুলবুলের ধেয়ে আসার তেমন কোনো ভীতিকর খবর আবহাওয়া অধিদপ্তর বা টিভি চ্যানেলগুলো জানালো না। আবহাওয়া অধিদপ্তর সকালেই ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সংকেত জানিয়ে দিল। আমরাও বুঝতে পারলাম বুলবুল বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের চাইতেও অনেক বেশি নমনীয় হয়ে পড়েছে। তারপরেও সন্ধ্যে নাগাদ জানা গেল বুলবুলের ঝড়ো হাওয়া দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চলে বেশকিছু জায়গায় গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, বাড়িঘর কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে অগ্রসর হয়েছে। তাতে বেশকিছু অঞ্চলে গাছের নিচে পড়ে কমপক্ষে তেরোজন মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকেই আহত হয়েছেন। কোথাও কোথাও রাস্তার পাশে গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিছু কিছু জায়গায় বাঁধ ভাঙার উপক্রম হয়েছে। পানি ঢুকেছে। ফসলের হানি ঘটেছে। মাছ ও ঘের চাষের কিছু ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এবার সরকারের দুর্যোগ প্রতিরোধ উদ্যোগ ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি গোছানো। প্রায় ২১,০৬,০০০ মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আগেই নিয়ে এসেছিল। এর ফলে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমে এসেছে। আশ্রয় শিবিরে যারা ছিলেন তাদের খাবারসহ দেখভালে প্রশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবীরা যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। সেই রাতেই মোংলার মিঠাখালী গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রে হনুফা বেগমের কোল আলো করে জন্ম নিয়েছে এক কন্যা সন্তান। সবাই আদর করে তার নাম দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের নামানুসারে বুলবুলি। বুলবুলির জন্মের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ডাক্তার নার্স সেই রাতেই যে ব্যবস্থা করেছিল তা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। আমাদের মানুষজন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তেও কীভাবে একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়ায় সেটি বুলবুলির জন্মেতে নতুন করে দেখা গেল। বস্তুত এবার মহাবিপদ সংকেত পাওয়ার পর সরকারের শীর্ষ মহল থেকে গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা, মানুষ ও প্রাণী সম্পদ রক্ষা করা, খাদ্য, পানি, ইত্যাদি সরবরাহ করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল সেটি আবারো প্রমাণ করে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অনেক বেশি সক্ষম। সেখানে বুলবুল ১০ নম্বর মহাসংকেত নিয়ে ধেয়ে এসে বোধহয় আমাদের প্রস্তুতি দেখে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় যে আশঙ্কা নিয়ে ধেয়ে আসছিল সেটি শেষ পর্যন্ত ঘটেনি- এটি আমাদের জন্য মস্তবড় স্বস্তির বিষয়। তবে উপকূল অঞ্চলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো আমরা সঠিক জানি না, আগামী ৪/৫ দিনের মধ্যে এর একটি সঠিক পরিসংখ্যান জানা যেতে পারে। আমরা এও জানি না সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের সবাই নিরাপদে ফিরে এসেছেন কিনা। কী পরিমাণ ফসল নষ্ট হয়েছে তা হয়তো আগামী ৩/৪ দিনের মধ্যেই জানা যাবে। শুধু উপকূলবর্তী অঞ্চলই নয় দেশের মধ্যবর্তী জেলাগুলোতে পর্যন্ত যেভাবে বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতে রবিশস্যের বেশ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষত এবার পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির এই সময়ে সবাই আশা করে বসে আছেন দেশি পেঁয়াজের ফলন আর দেড় দুই সপ্তাহের মধ্যে বাজারে উঠে এলে এবার পেঁয়াজ নিয়ে যে ভোগান্তি মানুষের ঘটে চলছে তার কিছুটা অবসান ঘটবে। কিন্তু গত ২/৩ দিনে ভারি ও মাঝারি ক্রমাগত বৃষ্টিপাতে পেঁয়াজের ফলন যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমাদের ভোগান্তি কতটা বাড়বে সেটি ধারণা করাই বেশ কঠিন। দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় ফসল নষ্ট হওয়ার কথা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে উচ্চারিত হচ্ছে। রবিশস্যের ক্ষেত প্রস্তুতিও বুলবুলের বৃষ্টিপাতে নষ্ট হয়েছে বলা হচ্ছে। মাছ এবং ঘেরের অবস্থা যদি খারাপ হয় তাহলে অনেকেই পথে বসবেন। নির্দ্বিধায় বলা যায় যেসব পরিবার ঘরবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে হারিয়েছেন তাদের পাশে হয়তো সরকার শিগগিরই দাঁড়াবে। তারপরও গাছপালা, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ইত্যাদি হারিয়ে বেশকিছু পরিবার আর্থিক সংকটে কমবেশি পড়বেই। তারপরও বলতে হয় বুলবুল যেমন মহাসংকেত জানিয়ে ধেয়ে আসছিল সেটি যদি ঘটত তাহলে আমাদের কী হতো আমরা জানি না। কত মানুষ, প্রাণী, পশুপাখি, সুন্দরবন, গাছপালা ইত্যাদি আমাদের ধ্বংস হতো সেটি আমরা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারার কথা নয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বুলবুল আমাদের প্রতি সদয় থেকেই চলে গেল। এখন আমাদের সুন্দরবনকে সত্যি সত্যি সুন্দর করে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, উপকূলবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলকে দ্রুতই সজীব করে তুলতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে, প্রকৃতিকে আবার সাজিয়ে তুলতে হবে। তাহলে বুলবুল বা অন্য কোনো ঘূর্ণিঝড় এই ভূখণ্ডে চোখ ফেলে এর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ফিরে যেতে পারে। সেভাবেই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App