×

জাতীয়

নদী রক্ষায় যত চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৩০ এএম

নদী রক্ষায় যত চ্যালেঞ্জ

নদীকে জীবন্ত সত্তা বা জুরিসটিক পারসন হিসেবে উচ্চ আদালতের স্বীকৃতি মিললেও এ সত্তাকে বাঁচানোর অনেক সংকট রয়ে গেছে এখনো। শুধু দখল বা দূষণ নয়, উজানে পানি কমে যাওয়া, পলি ভরাট, উন্নয়নের প্রয়োজনে বাঁধ, সেতু নির্মাণ প্রভৃতি ক্রমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে দেশের প্রায় প্রতিটি নদনদীকে। নদী রক্ষায় সাধারণ মানুষের দায়িত্ববোধের অভাবও রয়েছে প্রকটভাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদনদীর মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে গিয়ে হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার।

গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও মোংলার ঘাসিয়াখালী চ্যানেলসহ কয়েকটি নদনদী রক্ষায় সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা গেলেও সার্বিক বিবেচনায় তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নদনদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। রয়েছে দক্ষতার অভাব ও দুর্নীতি। নদী রক্ষা সংক্রান্ত আইনগুলোও যুগোপযোগী নয়। তাই নদী রক্ষা করতে হলে উজানে ন্যায্য পানির হিস্যা প্রতিষ্ঠা, সঠিক পলি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন পরিকল্পনায় নদী সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থাগুলোকে দক্ষ-দুর্নীতিমুক্ত করাই সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

উজানের পানি ও পলি ব্যবস্থাপনা : নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী তোফায়েল আহমদ বলেন, ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ৫৪টি অভিন্ন নদনদীর পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কিন্তু সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সে দেশে অনেক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টনে আমাদের ক‚টনৈতিক সাফল্য আশাব্যঞ্জক নয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের নদনদীতে। পানির প্রবাহ কমেছে, বেড়েছে পলি ভরাটের হার। প্রতি বছর কোটি কোটি টন পলি উজান থেকে এ দেশে আসে।

অন্যদিকে দেশে নদীর পলি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মাথায় না রেখের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অসংখ্য বাঁধ, সেতু ও উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মরে যাচ্ছে অনেক নদী। দখল-দূষণের চ্যালেঞ্জ সব নদীতে : দেশের প্রতিটি নদ-নদীই কমবেশি দখলের শিকার বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এলেও হাতে গোনা কয়েকটিতে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে দেখা যায় বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসনকে। পাশাপাশি রয়েছে দূষণ রক্ষার চ্যালেঞ্জ। এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত বাংলাদেশের নদীর পানি দূষণের ভয়াবহ শিকার ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের পার্শ্ববর্তী নদী।

গত বছর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে ১৩ ফুট পুরু পলিথিনের স্তর, কল কারখানার ৬০ ভাগ, ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের ৩০ ভাগ এবং নৌযানের শতভাগ বর্জ্যই নদীতে ফেলা হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘লিস্ট ডোজ’-এর সর্বশেষ (আগস্ট ২০১৩) সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের দূষিততম ১০টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গার অবস্থান চতুর্থ। প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজার টন কঠিন বর্জ্য এ নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর দূষণ রোধ করতে নেয়া পদক্ষেপগুলোকে ‘লেজেগোবরে’ অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে লিস্ট ডোজের প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইডিইবি) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, ফতুল্লাসহ বিভিন্ন এলাকার টেক্সটাইল, ডাইং, প্রিন্টিং, ওয়াশিং শিল্পসহ বিভিন্ন কলকারখানা থেকে প্রতিদিন ৬০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য যুক্ত হচ্ছে তুরাগ, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, বালু ও টঙ্গী খালে। আর খোদ ঢাকা ওয়াসা প্রায় ১২ হাজার ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে। এ ছাড়া নদী তীরবর্তী বিভিন্ন হাটবাজার, গৃহস্থালি বর্জ্যও কাছের নদীতে ফেলছে মানুষ। ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হলেও সেখানকার বর্জ্যও অপরিশোধিতভাবে নদীতে ফেলা হচ্ছে ভয়াবহভাবে।

সমন্বয়ের অভাব, রয়েছে অদক্ষতা ও দুর্নীতি : নদী রক্ষায় গত ১০ বছর ধরে সরকারের অনেক পদক্ষেপই সফল হয়নি শুধু বাস্তবায়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির জন্য। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের তলদেশ থেকে পলিথিনসহ অন্যান্য কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ২০০৯ সালে। ২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্পের আওতায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা হয় বলে দাবি করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু আইডিইবির এক প্রতিবেদনে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গী খাল ও বালুর নদীর পানির ভৌত অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়, প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ‚ত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ দশমিক ৫ থেকে দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। যা আগের মতোই প্রায়। স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম থাকার কথা। পানিতে অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদনও স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ১০ থেকে ১০০ গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া যায় ওই পরীক্ষায়।

২০১১ সালের ১ জুন উচ্চ আদালত বুড়িগঙ্গায় সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালির লাইন ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণ লাইন এক বছরের মধ্যে বন্ধ করতে ওয়াসার চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন। একই আদেশে নদীতে বর্জ্য ফেলা রোধে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও নদী তীরের বর্জ্য অপসারণের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু এসব আদেশের কোনোটিই বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি।

নদীর সীমানা নির্ধারণ নিয়েও দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায় অনেক। বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, সরকার নদী রক্ষায় অনেক উদ্যোগ নিলেও সে অনুযায়ী সাফল্য আসেনি। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত থেকে নদী রক্ষায় একটি যুগান্তকারী রায় দেন। তাতে নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত করতে বলা হয়। কিন্তু অনেক দখলদারকে সুবিধা দিতে ভুল সীমানা পিলার স্থাপন করে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এ কাজটি বিতর্কিত করেন।

প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য : নদী রক্ষায় সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকার ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। নদী রক্ষা এখন সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দখল-দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি দখলদারদের কয়েক হাজার স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী রক্ষায়ও উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়েছে। নদীর দখল রোধে দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়ন হলে নদনদী রক্ষা পাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App