×

মুক্তচিন্তা

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে গোয়েবলসের ভূমিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৪৯ পিএম

যুদ্ধ ও জাতি, ধারণা ও মানুষের মাঝখানে একমাত্র সমন্বয় মাধ্যম রেডিও। গোয়েবলস এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, জনগণ রেডিও শোনে বিনোদনের জন্য, পাশাপাশি সংবাদ জানার জন্য। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ জানার জন্য। তাই তিনি রেডিওতে খবরের পাশাপাশি জার্মান সামরিক সঙ্গীত প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। নাৎসি আন্দোলনের শুরুতেই বীরত্বগাথা সঙ্গীত বাজানো হতো।
হিটলারের পাবলিক এনলাইটমেন্ট এবং প্রপাগান্ডা মন্ত্রী ড. পল যোশেফ গোয়েবলস বলতেন, সাফল্য লাভের জন্য ভালোবাসার ন্যায় প্রপাগান্ডায়ও সবকিছুই অনুমোদনযোগ্য। প্রপাগান্ডার সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই বরং এটাই সত্য যে, আমরা জার্মানির বিজয়ের জন্য কাজ করছি। মিথ্যা বলতে হবে যতদূর সম্ভব পরোক্ষভাবে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করে যাতে শত্রুর কাছে এ মিথ্যা ধরা পড়লে অস্বীকার করা যায়। কেউ মিথ্যা দিয়ে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত তার এ অবস্থানে অনড় থাকত হবে, মতামত পরিবর্তন করে সত্য স্বীকার করা যাবে না। তিনি আরো বলেন, জনমত গঠনের তত্ত্বাবধান করা রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার। তিনি বলতেন, একটি মিথ্যা বারবার বলতে হবে, একপর্যায়ে সেটিই সত্যে পরিণত হবে। নাৎসি একনায়ক এডলফ হিটলার বলতেন, জনগণের বুদ্ধিমত্তা ক্ষুদ্র এবং ভুলে যাওয়ার প্রবণতা প্রবল। এ জন্য তাদের একই জিনিস হাজারবার বলে যেতে হবে। এসব উক্তি থেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে নাৎসি প্রপাগান্ডার দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যোশেফ গোয়েবলস বিশ্ববাসী ও জার্মান জনগণকে তাই বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছেন, যা নাৎসি সরকার বিশ্বাস করত। গোয়েবলস জার্মানি ও জার্মান শাসিত ইউরোপের সব প্রকাশনা, রেডিও, চলচ্চিত্র ও শিল্পকলা নিয়ন্ত্রণ করতেন। গোয়েবলসের দায়িত্ব ছিল জার্মান জনগণের সামনে হিটলার ঘোষিত যুদ্ধের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা। প্রপাগান্ডা কর্মীরা গণমাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্টি ও রাষ্ট্রীয় চ্যানেল ব্যবহার করত। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল রেডিও, চলচ্চিত্র, পত্রপত্রিকা, বইপত্র, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, লিফলেট, ব্রুশিওর, দলীয় প্রচারাভিযান ইত্যাদি। ১৯৪০-৪৪ সময়কালে যুদ্ধের নাৎসি লক্ষ্যগুলো ও রাইখ প্রশাসনের শত্রুদের ওপর ব্যাপক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এসব চলচ্চিত্র বিপুলসংখ্যক জার্মান জনগণ প্রত্যক্ষ করত এবং এসব চলচ্চিত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জার্মান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করত। যুদ্ধের সময় প্রচার করা হতো হয় জয়লাভ কর নতুবা মৃত্যুবরণ কর, জয়লাভ কর নতুবা বলশেভিজমকে মেনে নাও। জার্মানরা টিকে থাকবে নতুবা ইহুদিরা, সামগ্রিক জয় নয়তো সামগ্রিক পরাজয়, আমৃত্যু লড়ে যাও, নতুবা জার্মান জাতির ধ্বংস অনিবার্য। এগুলো ছিল জার্মান জনমত গঠনে খুবই শক্তিশালী স্লোগান। সার্বিক যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হেলরি মাইকেল বলেন, এখন সার্বিক কৌশলে অনেক বেসামরিক উপাদান রয়েছে। যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব রাখছে- প্রথমে আমি বলছি গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা। বিশেষ করে রেডিওর কথা উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধে নিয়োজিত সৈনিকদের মনোবলের ওপর যার প্রভাব অনস্বীকার্য। যখন হিটলার যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরাজিত হচ্ছেন, তখন গোয়েবলস তাকে শোনাচ্ছেন ভিন্ন রকম বিজয়ের কথা। যদিও ১৯৪৩ সালের দিকে জার্মানি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছিল তখনো গোয়েবলস জনগণকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করছেন যে, বিজয় এখনো সম্ভব। জার্মান শহরগুলো একের পর এক যখন বার্লিন, লুবেক ও হামবুর্গের মতো পরাজয় বরণ করে তখন গোয়েবলস বলেন, ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে নতুন নতুন সড়ক নির্মিত হবে, আমরা নতুন ধরনের শহর গড়ে তুলব। যুদ্ধের পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলো আবার নতুনভাবে অভূতপূর্ব সুন্দর নগরী হিসেবে গড়ে উঠবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের জায়গায় নতুন স্মারক ভবন নির্মাণ করা হবে, নতুন, প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে এবং আরো পরিচ্ছন্ন, সুপরিসর অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মিত হবে। নাৎসি শাসনের পতনের দুই সপ্তাহ পূর্বেও জনগণের সামনে গোয়েবলস এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল মিছিল, মিটিং, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, স্লাইড শো, রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ে আলোচনা, চলচ্চিত্র অফিস কর্তৃক বিশেষ উপস্থাপনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা, পোস্টার, সপ্তাহের স্লোগান, সপ্তাহের ছবি এবং মৌখিক প্রচারণা। স্লাইড লেকচারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- বিট্রেড সোসালিজম, জার্মান উইমেন ইন দ্য ওয়ার, ইউএসএ দ্য ডিস্টার্বার অব দ্য ওয়ার্ল্ড পিস, দ্য মেডিটারিয়ান, দ্য এরিয়া অব ডিসিশন, দ্য জার্মান মিশন ইন ইউরোপ এবং পলিটিকস এন্ড ওয়ার ইন দ্য ক্যারিকেচার। উল্লেখযোগ্য স্লোগান ছিল- মুক্তির জন্য যে কোনো ত্যাগ, মুক্তিকামী জাতিকে দাবিয়ে রাখা যায় না, কাপুরুষতা হচ্ছে একমাত্র পাপ, কঠোর পরিশ্রমের কথা ভেবো না লক্ষ্যে অবিচল থেকো। যোশেফ গোয়েবলস প্রেসের তুলনায় রেডিওর ওপর অধিক ও সরাসরি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতেন। তিনি স্বীকার করেন, রেডিও এবং যুদ্ধবিমান ব্যতিরেকে সার্বিক যুদ্ধ এবং সার্বিক জয়লাভ অকল্পনীয়। যুদ্ধ ও জাতি, ধারণা ও মানুষের মাঝখানে একমাত্র সমন্বয় মাধ্যম রেডিও। গোয়েবলস এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, জনগণ রেডিও শোনে বিনোদনের জন্য, পাশাপাশি সংবাদ জানার জন্য। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ জানার জন্য। তাই তিনি রেডিওতে খবরের পাশাপাশি জার্মান সামরিক সঙ্গীত প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। নাৎসি আন্দোলনের শুরুতেই বীরত্বগাথা সঙ্গীত বাজানো হতো। জার্মান তরুণ সমাজ এসব সঙ্গীত দ্বারা উজ্জীবিত হতো, আকৃষ্ট হতো। এ সময় এর বাইরেও ব্যাপক হারে পুস্তক প্রকাশনা, প্যামফ্লেট, লিফলেট, স্লাইড শো, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টাল স্ট্যাম্প ইত্যাদির মাধ্যমেও প্রচারণা চালানো হতো। ১৯৪১ সালের মধ্যে দলীয় ও বেসরকারিভাবে ২৫ কোটি যুদ্ধবিষয়ক বই ও প্যামফ্লেট ছাপানো হয়েছিল। যুদ্ধকালীন পোস্টার দেখা যেত সর্বত্র। এসব পোস্টারে বলশেভিকদের চিত্রায়িত করা হতো ধর্ষক ও খুনি হিসেবে। স্ট্যালিনগ্রাদ বিপর্যয়ের পর ১৯৪৩ সালে ব্যাপকভাবে পোস্টার ছাপানো হয়। এসব পোস্টার ও প্ল্যাকার্ডে থাকত এ রকম স্লোগান- ‘কঠিন সময়, কঠিন শ্রম ও কঠিন হৃদয়’। এ রকম হাজার হাজার পোস্টার শোভা পেত বাস, ট্রেন, বাড়িঘরের দেয়ালে এবং সর্বত্র। একটি পোস্টারে লেখা হয়েছিল- ‘এডলফ হিটলার ইজ ভিক্টরি’। যুদ্ধচলাকালে পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও প্রপাগান্ডা চালানো হতো। এ সময় খামের ওপর স্লোগানের সিল মারা হতো। ১৯৪০-৪৪ সময়কালে ‘জার্মান উইকলি নিউজ রিল’ ছিল সবচেয়ে কার্যকর প্রপাগান্ডা মাধ্যম। উইকলি নিউজ রিল নির্মাণে গোয়েবলস বিশেষ ফর্মুলা অনুসরণ করতেন। নিউজ রিলে দেখানো হতো রণসঙ্গীতের তালে তালে দৃপ্ত মার্চ পাস্ট স্কোয়ার অতিক্রম করছে। শেষ দৃশ্যে দেখানো হতো তরুণদের মুখচ্ছবি, যা ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক আদর্শবাদের প্রতীক এবং আত্মত্যাগের দৃপ্ত শপথের প্রতিচ্ছবি। ব্যান্ডে বাজানো হতো ‘আমাদের সামনে আমাদের ব্যানার উড়ছে’, ‘হিটলার তরুণদের সঙ্গীত, সুখস্মৃতির দিনের কথা’। হিটলার যুগের শেষ দিকে কোনো অফিসার বা সৈনিক আত্মহত্যা করলে তা গোপন রাখা হতো। বিশেষ করে উচ্চ পদবির অফিসার আত্মহত্যা করলে সে বিষয়টি গোপন করে বরং রাষ্ট্রীয় ভাবগাম্ভীর্যে তার শেষকৃত্য করা হতো। আর এগুলো দেখানো হতো উইকলি নিউজ রিলে। নূর ইসলাম হাবিব : সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App