×

জাতীয়

জেলা পরিষদের কাজ কী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ১১:০২ এএম

জেলা পরিষদের কাজ কী

ঢাকঢোল পিটিয়ে জেলা পরিষদ নির্বাচন করা হলেও এখনো এর কর্মপরিধি নির্ধারণ করা হয়নি। ভোটের মাধ্যমে গঠিত পরিষদ সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাদের ‘পদ-পদবির’ পুনর্বাসন কেন্দ্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দুর্বলতার কারণে জেলা পর্যায়ে ডিসি-এসপির ফ্রি-স্টাইল শাসন কায়েম হয়েছে। এ কারণে মাঠ প্রশাসনে জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। অথচ গোটা জেলার জন্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত শীর্ষ প্রতিনিধি হচ্ছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। কিন্তু বাস্তবে তিনি ‘নিধিরাম সর্দার’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পরিষদকে ক্ষমতায়িত করা হলে মাঠ প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যেত। স্থানীয় সরকারও শক্তিশালী হতো। যেভাবে উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী হওয়ায় সেখানে আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য কমে এসেছে। গড়ে উঠেছে একটি জবাবদিহিতার সংস্কৃতি।

জামালপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরের নৈতিক স্খলনের বিষয়টি সামনে আসার পর জেলা পরিষদকে কার্যকর করার বিষয়টি ফের আলোচনায় উঠে এসেছে। এতদিন ঠিকঠাকভাবে নজরদারি করা না হলেও জামালপুরের ঘটনার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সব জেলার মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের খোঁজখবর নেয়া শুরু করে। এমনকি মাঠ প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা স্ত্রী বা স্বামী নিয়ে থাকছেন, কারা থাকছেন না সে তথ্যও নেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে মাঠ প্রশাসনের নজরদারিতে জেলা পরিষদকে কিভাবে কাজে লাগালো যায় তা নিয়েও ‘টেবিল টক’ চলছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সমন্বিত স্থানীয় সরকার আইন বলবত থাকলে মাঠপ্রশাসনে জবাবদিহিতা অনায়াসে চলে আসত। উপজেলা পরিষদের মতো জেলা পরিষদকেও শক্তিশালী করা গেলে জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তাদের ‘ফ্রি-স্টাইল’ চলাচল বন্ধ হতো। তাদের মতে, উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী হওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা উপজেলা পর্যায়ের অন্য কোনো কর্মকর্তা চাইলেই যে কোনো কাজ করতে পারেন না। কিন্তু জেলা পরিষদ শক্তিশালী না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসনকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে জেলা প্রশাসনই জেলা পর্যায়ে ‘দণ্ডমুণ্ডের কর্তা’।

উপজেলা পরিষদের মতো জেলা পরিষদকেও কার্যকর করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, এটি বলার সময় এখনো আসেনি। তবে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কি জেলা পরিষদের আইনের পরিবর্তন হবে- এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ মিলেমিশে কিভাবে কাজ করবে তার কৌশল বের করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক কি-জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেলাতে কি করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, জেলা পরিষদ আইন একটি বিচ্ছিন্ন আইন। এ আইনের অধীনে যতদিন জেলা পরিষদ থাকবে ততদিন সরকারের বিভাগগুলোর সঙ্গে জেলা পরিষদের সম্পর্কই থাকবে না। তিনি বলেন, বর্তমানে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদের জন্য আলাদা আলাদা আইন রাখা হয়েছে। এই আইনগুলো যতদিন পর্যন্ত একটি সমন্বিত আইনে পরিণত হবে না; ততদিন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারও শক্তিশালী হবে না। আর স্থানীয় সরকার শক্তিশালী না হলে মাঠ প্রশাসনেও জবাবদিহিতা আসবে না। বিষয়গুলো অনেক দিন ধরে সরকারকে বলা হলেও কার্যকর হচ্ছে না, জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান বাংলাদেশে ব্রিটিশদের শাসনের শুরুর দিকেই অর্থাৎ ১৭৭২ সাল থেকে মাঠ প্রশাসনের একটি ইউনিট হিসেবে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। অথচ সংবিধান অনুযায়ী এটির পরিচালনা করবে জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানসহ প্রতিনিধিরা। কিন্তু তা না হওয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে লাগামহীন হয়ে পড়ছে জেলা প্রশাসন। এরকম পরিস্থিতিতে জেলার সব দপ্তরকে মনিটরিং ও জবাবদিহিতার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের আওতায় এনে স্থানীয় সরকার পদ্ধতিকে আরো শক্তিশালী করার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার ‘জেলায় জেলায় সরকার’ বইয়ে লিখেছেন, নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের পদবি পরিবর্তন করে উপমন্ত্রী পদমর্যাদায় ‘জেলা গভর্নর’ এবং নির্বাচিত দুই জেলা ভাইস-চেয়ারম্যানকে (একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান) ডেপুটি গভর্নর পদমর্যাদা দিয়ে জেলা পরিষদ/গভর্নর পরিষদ করা যেতে পারে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে সারাদেশে প্রতিটি জেলায় জেলা গভর্নর নিয়োগ দিয়ে জেলা পর্যায়ে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন সরকার চাইলে এই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের পদবি জেলা গভর্নর করে দিতে পারেন। একইসঙ্গে আইনের পরিবর্তনও করতে পারেন।

জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি কোন ধরনের সরকার ব্যবস্থা চান- এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশে দুটো সরকার থাকবে। একটি জাতীয় সরকার, অন্যটি স্থানীয় সরকার। আমি এখন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি অর্থাৎ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এই জেলা পরিষদটি যাতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয় সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছি। এও বলেছি, জেলা পরিষদ যাতে সেবামূলক কাজ করতে পারে তার ব্যবস্থা করে দিতে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন জেলা পরিষদের প্রতিদ্ব›দ্বী নয়। জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ যাতে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা উচিত।

বিভিন্ন নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, সংসদ সদস্যরা আইনসভার সদস্য। আর উপজেলা চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব হচ্ছে যার যার উপজেলায় কাজ করা। গোটা জেলার জন্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত শীর্ষ প্রতিনিধি হচ্ছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। জেলায় জেলা প্রশাসক নামে এখন যে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা কর্মরত আছেন; তাকে এই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের কাছেই জবাবদিহি করার কথা। ডিসির এসিআর দেয়ার কথা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের। উপজেলা পরিষদ যখন চালু হয়েছিল, তখন তো ইউএনওর এসিআর লিখতেন উপজেলা চেয়ারম্যান। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা- যাদের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন হয়; তারা জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করবেন, সংবিধান এটাই বলে।

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউছুফ খান পাঠান ভোরের কাগজকে বলেন, কর্মপরিধির সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা অনেক কাজ করতে পারি না। যদি আমাদের জেলা প্রশাসনের কাজের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হত- তাহলে সরকারের যে কাজগুলো জেলা প্রশাসন বাস্তবায়ন করছে তা ঠিকঠাকভাবে করছে কিনা তা মনিটরিং করতে পারতাম। এতে জেলাবাসী উপকৃত হত।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে, জেলায় কারো কাছে ডিসি-এসপির জবাবদিহিতা নেই। দূরের বিভাগীয় শহরে থাকেন বিভাগীয় কমিশনার; যিনি ডিসির ক্যাডার বস এবং মাঝেমাঝে জেলা পরিদর্শনে আসনে। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসকরা কোনো কিছুর ধারধারেন না বা তোয়াক্কা করেন না। এ ছাড়া জেলায় যে ভবনটিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বলা হয় এটিকেই জেলা পরিষদ ভবন করা উচিত। এই অফিসই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের অফিস হতে হবে। একইসঙ্গে ডিসির পদবি হতে হবে জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। একটি আলিশান বাংলো বাড়ি আর সার্বক্ষণিক দুটি গাড়ি পেয়ে এই কর্মকর্তাদের কেউ কেউ দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ ও অসদাচরণে জড়িয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের ডিসির নিয়ন্ত্রণ করাটা দরকার হয়ে পড়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App