স্মার্টফোন এবং আনস্মার্ট সিদ্ধান্ত
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:১৯ পিএম
নগরায়ন ও শিল্পায়নের এই যুগে এসে আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে অনেক মা-বাবাই শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। নিজেদের অনুপস্থিতির সময়টাতে শিশুকে শান্ত রাখতে তাই অনেকেই মোবাইল ফোনের শরণাপন্ন হচ্ছেন। আপনি হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। আপনার পাশে বসে ছোট শিশুটি খুব দুষ্টুমি করছে। শিশুকে শান্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব ধরিয়ে দিলেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও ছেড়ে দিয়ে তাকে নিমিষেই শান্ত করে আপনি আপনার কাজে মনোনিবেশ করলেন। আপনার-আমার সবার বাসাতেই এই চিত্র এখন নিত্যদিনের।
স্মার্টফোনের কল্যাণে শিশুদের শান্ত রাখা, খাওয়ানো, এমনকি বর্ণমালা ও ছড়া শেখানোর কাজটিও বাবা-মায়ের জন্য অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে। বিপরীতে স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে শিশুদের। আর এই নির্ভরশীলতাই হয়তো আমাদের অজান্তে শিশুদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। অথচ আমরা কি তা নিয়ে ভাবছি? কিন্তু ডাক্তারি গবেষণা মতে, স্মার্টফোনের অতি ব্যবহারে শিশুর মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুর চিন্তা ও কল্পনাশক্তি ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের রঙিন পর্দার গ-িতে আটকা পড়ে যায়। ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তির মতোই শিশুরা আক্রান্ত হয়ে পড়ে স্মার্টফোন আসক্তিতে। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের মানসিক বৈকল্য।
স্মার্টফোন আসক্তির কারণে শিশুর শুধু মানসিক বিকাশই যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, বরং তারা শারীরিকভাবেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে প্রযুক্তিগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার মধ্যে স্মার্টফোন অন্যতম। এটি যেমন দরকারি, তেমনি এর প্রতি আসক্তি আপনার সন্তানকে নানা বিপদে ফেলতে পারে। যেমন- খুব বেশি কম্পিউটার ও মোবাইল ব্যবহারের ফলে শিশুদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। শিশুকে আচরণগত সমস্যার ঝুঁকি থেকে দূরে রাখতে চাইলে সচেতনতার বিকল্প নেই। নিজেদের সুবিধা বা আরামের ফল পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর হতে পারে। বিশেষ করে একেবারে ছোট বয়সে মোবাইল হাতে দিলে শঙ্কাটা বেশি। যে শিশু নিয়মিত মোবাইল ব্যবহার করে, তাকে কয়েকদিন মোবাইল থেকে দূরে রাখুন। তার আচরণের পরিবর্তনটুকু নিজেরাই বুঝতে পারবেন। তবে ৭ বছর বয়সের শিশুদের দিনে আধ ঘণ্টা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টিভি বা ট্যাবলেট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি শিশু যখন একটি বই পড়ে বা ছবির বই দেখে, তখন কিন্তু সে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কখন সে বইয়ের পাতা উল্টাবে। অর্থাৎ শিশুটি তখন তার নিজের গতিতে চলতে পারে। ফলে তাকে তাড়াহুড়ো করতে হয় না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির দিনে ইন্টারনেট তথা তথ্যপ্রযুক্তি থাকবেই। একে এড়িয়ে জীবন চলার কোনো উপায় নেই। তবে এ কথা ঠিক যে, জীবনের প্রয়োজনে বিজ্ঞানের অবদান থেকে এই শিশু-কিশোররা কতটুকু গ্রহণ করতে পারছে।
মা-বাবার সঙ্গে দূরত্বের কারণে সন্তান ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। যার ফলে শিশু ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু, অসামাজিক ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তার সহজাত সামাজিক গুণাবলির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই শুয়ে বা বসে ফোন ব্যবহার করে। আর স্মার্টফোন আসক্ত শিশুরা ঘরের বাইরে খেলাধুলাতেও আগ্রহী হয় না। ফলে শৈশবকালীন অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির হার তাদের মাঝে খুবই বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, পরবর্তীতে এসব শিশুর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিলতা যেমন- হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে শিশুরা অপ্রাপ্ত বয়সেই না বুঝে বিভিন্ন অনৈতিক ও আপত্তিকর বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হয়। সহজেই এই বিষয়গুলোর মুখোমুখি হওয়াতে তারা এগুলোকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে। এ কারণে স্মার্টফোন-ইন্টারনেট আসক্ত শিশু ও তরুণদের মাঝে নৈতিকতার অভাব ও মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রবল হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
প্রবাসী লেখক।