×

মুক্তচিন্তা

নৈতিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণের উপায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ১০:১৪ পিএম

মানুষের মধ্যে যখন পশুশক্তি প্রবল হয়ে ওঠে তখন এসব সদাচার আনুপাতিক হারে লোপ পায়। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে হলে নৈতিকতার লালন ও কর্ষণ করতে হবে। ব্যক্তি ও সমাজকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে হলে নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে তো তা অনেক বেশি প্রযোজ্য।

বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির কারণে আজ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। যার ফলে জীবনযাত্রার মানেও অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে মানুষ যেমন উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করছে তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আধুনিক নগর সমাজের সার্বিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, শিশু-কিশোররা যে পরিবেশে লালিত-পালিত হচ্ছে সেখানে তাদের খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ নেই, স্কুলগুলোতে মাঠের অপ্রতুলতা, বিনোদনের অভাব, ঘুরে বেড়ানোর জায়গার সীমাবদ্ধতা, সর্বোপরি অভিভাবকদের কাজের ব্যস্ততা। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা এবং বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমরা তাদের সে চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। যার ফলে ভিডিও গেমস, মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে। এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করছে। বর্তমানে কিশোর সমাজের এক বিরাট অংশ কাল্পনিক ভিডিও গেমসের অতিভক্তে পরিণত হয়েছে। ভিডিও গেমস গ্রুপ বানিয়ে মারামারি করছে। হারজিত নিয়ে উত্তেজিত হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে সহনশীলতা একেবারেই কমে যাচ্ছে। অল্প বয়সেই তারা হিংস্র হয়ে উঠছে। নানাভাবে গ্যাং তৈরি করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে। একই এলাকায় বিভিন্ন গ্যাং পার্টির মধ্যে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষ। গ্যাং পার্টির অনেক সদস্য মাদক সেবন, ছিনতাই, রাহাজানি কিংবা বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে সামাজিক অবক্ষয়, বিশৃঙ্খলা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোতে হিংস্রতা, সন্ত্রাসবাদ ও আধিপত্যবাদকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, মানুষকে তুচ্ছ কারণে হত্যা করা দেখানো হচ্ছে সেসব সিরিয়ালে। যেহেতু শিশু-কিশোররা অনুকরণপ্রিয় হয়। সেহেতু সেসব দেখে রোমাঞ্চ অনুভব করে। ক্রমেই তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক। তাদের উচ্চাভিলাষ বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিহীন হয়ে পড়ছে। নীতি-নৈতিকতাকে পুরনো বলে মনে করছে। বিত্ত বাড়াতে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোতে আস্থা ও প্রীতি উঠে যাচ্ছে। স্বস্তি নেই জীবনে, পরিবার, ঐতিহ্য উত্তরাধিকার, মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয় না থাকায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্ট হয়ে পড়ছে। তাই শিশু-কিশোররা জড়িয়ে যাচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। গান বাদ্যের মধ্যে রক, ব্যান্ড, রিমিক্স ঢুকে আমাদের শিশু-কিশোররা নিজ সংস্কৃতি ভুলে যাচ্ছে। আচার অনুষ্ঠানে ঢুকেছে অন্য দেশের নিয়মনীতি। কৃষ্টি কালচারের কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। অনাচার ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আকাশ সংস্কৃতির অন্যতম উপজীব্য। জরিপ অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ফেসবুক, স্কাইপি, টুইটার, ফ্লিকার, মাইস্পোস, ডায়াসপোরো, অরকুট ইত্যাদি যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ সময় ব্যয় করে। এসব মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ, ব্যক্তিগত তথ্য ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করা যায়। লগইন অবস্থায় একজন অন্যজনের সঙ্গে চ্যাট করা, প্রোফাইল দেখা, মেসেজ ও ছবি পাঠানো, ছবিতে মন্তব্য লেখা ও ছবিযুক্ত করতে পারা যায়। ফেসবুকের এ সুযোগ প্রতিদিন ভোগ করছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে আমাদের শিশু-কিশোররা এর অপব্যবহারই করছে। এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সামাজিক অবক্ষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলছে। স্মার্টফোন ও ট্যাব নিয়ে বেশি সময় কাটানো শিশুরা অন্যদের চেয়ে কম ঘুমায়। গবেষকরা বলছেন, এসব ডিভাইস থেকে নীল রংয়ের এক ধরনের আলো বিচ্ছুরিত হয়, যা মানুষের ঘুমানোর ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। দীর্ঘক্ষণ গেমস খেলার কারণে চোখের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব প্রযুক্তির রেডিয়েশনের ফলে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হয়, ব্রেইন টিউমারের মতো বড় ধরনের সমস্যাও হতে পারে। প্রযুক্তি আসক্তির ফলে এর ব্যবহারকারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে বলে দাবি করছেন যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক। উত্তরণের উপায় : উপরোক্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের পাশাপাশি শিক্ষিত তথা সচেতন জনগোষ্ঠীকে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন শিশু-কিশোরদের সর্বোত্তম আশ্রয়স্থল হচ্ছে পরিবার। তাই পরিবারের সদস্যদের শিশুদের আচরণ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বিল গেটসের মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশ মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তার সন্তানদের বয়স ১৪ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেননি। তেমনিভাবে অ্যাপল প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসও তার সন্তানদের আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। আমাদের অভিভাবকরা আদর করে সন্তানদের দামি মোবাইল হাতে তুলে দেন। প্রযুক্তির ওপর ভর করেই যাদের পরিচিতি সারাবিশ্বে, তাদের আচরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। শিশু-কিশোরদের জন্য মাঠে খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিকল্প হিসেবে ঘরে কেরাম বোর্ড, লুডু, দাবা, ছবি আঁকা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। পিতা-মাতাকে সন্তানদের সময় দিতে হবে। ছুটির দিনে পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া ও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। তথ্য ও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করা। প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করা। শিক্ষার্থীদের বইমুখী করতে হবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানের পাঠাগারসমূহ সমৃদ্ধ করতে হবে। বাড়িতে ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে। অতিরিক্ত কিংবা লাগামহীন শাসন করা যাবে না। সন্তান যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা। দরজা বন্ধ একটা রুম স্থায়ীভাবে সন্তানকে বরাদ্দ দেয়া যাবে না। সন্তানের কাছে প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা, কতটুকু ব্যবহার করা উচিত তার ধারণা দেয়া। প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধ নয় বরং ফেসবুক কী? এটা কী কাজে ব্যবহার করা উচিত তা সন্তানকে বুঝিয়ে দিতে হবে। সর্বোপরি সামাজিক অবক্ষয় থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শিশুকালে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। সত্য কথা বলা, মিথ্যা থেকে বিরত থাকা, কারো ক্ষতি না করা, কপটতা ও প্রতারণা পরিহার করা, কারো অসম্মান না করা, বড়দের শ্রদ্ধা করা ও ছোটদের স্নেহ করা ইত্যাদি গুণাবলি নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হয়। মানুষের মধ্যে যখন পশুশক্তি প্রবল হয়ে ওঠে তখন এসব সদাচার আনুপাতিক হারে লোপ পায়। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে হলে নৈতিকতার লালন ও কর্ষণ করতে হবে। ব্যক্তি ও সমাজকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে হলে নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে তো তা অনেক বেশি প্রযোজ্য।

মোহাম্মদ সাইফুল হক সিরাজী : শিক্ষক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App