×

মুক্তচিন্তা

সংকটাপন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৩৭ পিএম

সংকটাপন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী।

সংকটাপন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

গড্ডলিকা প্রবাহে ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৫০-এর অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যদিও সাম্প্রতিককালে এসব অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় খাবি খেতে শুরু করে। দেখা যায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অধিক হওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফি কমাবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়, সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য বিবিধ সুযোগ-সুবিধা বা বৃত্তি প্রদানে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হতে থাকে। তারপরও গড্ডলিকা প্রবাহ কমেনি।

১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু করে দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হলো কমপক্ষে ১০৭টি। অনেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই সময়ে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯টি। সরকারি নীতি মোতাবেক অচিরেই যেসব জেলায় সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় নেই, সেগুলোতেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। তার মানে দেশে কমপক্ষে আরো ১৫টি সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধাদি কিংবা শিক্ষার্থীর অভাব নেই, আছে দক্ষ, যোগ্য ও নিবেদিত শিক্ষকের অভাব। সাম্প্রতিককালে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকট সমস্যাটি হলো ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি। আমি এসবকে রাজনীতি বলছি না বরং অপরাজনীতি বলছি। এই অপরাজনীতির কৃপায় অতীতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে এবং আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটিসহ কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের অস্বাভাবিক বহির্গমন দৃশ্যমান হতে থাকে। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন যখন প্রথম দেয়া হয় তখন এমন পরিস্থিতি তুঙ্গে ছিল। তবে সে সময়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও ছিল কম এবং বাজারমুখী বিষয়ের শিক্ষাদান ছিল সীমিত। সে সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিকূলতা ছিল ৫ একর অখণ্ড ও নির্ভেজাল জমির ওপর স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের শর্তটি; তবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য স্থায়ী আমানতের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি টাকা। কিন্তু ৫ একর অখণ্ড ও নির্ভেজাল জমির ওপর স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার শর্তটি ছিল একান্তই কথার কথা। তাই ওই বিষয়ের প্রতি তোয়াক্কা না করে ১৯৯২ সাল থেকে শুরু করে ২০১০-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাস বিনির্মাণ ও স্থানান্তরে ছিল অমনোযোগী। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি হয়তো এ অসম্ভব শর্তটিকে পালন অযোগ্য ভেবেই তার বাস্তবায়নে তেমনি আগ্রহী ছিল না। ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে আওয়ামী লীগ স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ভূমির পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে স্থায়ী আমানতের পরিমাণ ৫ কোটি টাকা বেঁধে দেয়। হয়তো যার ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে মাত্র ১টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে ৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের বিধানসহ অন্যান্য শর্ত আগের মতো রাখলেও ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়। ১৯৯২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিবিধ অনুকূল পরিবেশে ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং বাজারে তাদের নিয়ে এবং তাদের আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে মুখরোচক গল্প কাহিনী প্রচারিত হতে থাকে। এসব গল্প কাহিনীর সত্যতা যে একেবারে ছিল না, তা হলফ করে বলা যায় না। তবে গড্ডলিকা প্রবাহে ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৫০-এর অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যদিও সাম্প্রতিককালে এসব অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় খাবি খেতে শুরু করে। দেখা যায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অধিক হওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফি কমাবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়, সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য বিবিধ সুযোগ-সুবিধা বা বৃত্তি প্রদানে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হতে থাকে। তারপরও গড্ডলিকা প্রবাহ কমেনি। এক সময় প্রবাদতুল্য কথা ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল বিত্তশালীদের সন্তানেরা পড়াশোনা করে। এখন এ কথা প্রমাণিত সত্য যে, ফি প্রতিযোগিতার কারণে সব ধরনের শিক্ষার্থীই উপকৃত হচ্ছে। এক সময় মুখে মুখে কথা প্রচলিত ছিল যে, ৩ হাজার শিক্ষার্থী পেলেই কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তার ব্যয় মিটানোর পরিমাণ আয় পেয়ে যেত। এখন এগুলো মিথ ও মিথ্যাচারিতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখন মুষ্টিমেয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যরা কঠিন সংকটের মুখোমুখি। যদিও দেখা যাচ্ছে এখন ১০৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০-১২টি তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুই করতে পারছে না। আর যারা কার্যরত রয়েছে তাদের মাত্র ১৫টি ছাড়া বাকি সবাই নিজস্ব ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না। যারা নিজস্ব ক্যাম্পাসে কার্যক্রম স্থানান্তর করেছে তারা বিবিধ সংকট ও অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধকতার কারণে নবতর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ফলত হাতেগোনা কিছু ছাড়া বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্রেক ইভেন পয়েন্টেই পৌঁছাতে পারছে না। আগামী কয়েক বছরে যদি একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হতে থাকে তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য অর্থনীতির গতানুগতিক সূত্র মিথ্যা প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে শিক্ষা খরচ যতই বাড়ানো হবে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী তাদের দিকে ততই বেশি ধাবিত হবে। এই অবস্থায় তারা আকর্ষণীয় অবকাঠামোগত সুবিধাদি এবং অতি মূল্যবান শিক্ষিত, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও নিবেদিত শিক্ষকের জোগান দিয়ে নিজেদের আরো আকর্ষণীয় করে তুলছে। ফলত অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫০০ শিক্ষার্থী পেতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে তারা কেউ কেউ ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থী পাচ্ছে। অর্থনীতির এই ঝহড়ননরংয তত্ত্বটিকে প্রতিহত না করা গেলে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা প্রলয়ংকরী অবস্থার উদ্ভব ঘটবে। আর্থিকভাবে দুর্বলতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিলীন হয়ে গেলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তার ফলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যয় কাটছাঁট করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় দিতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে বিশাল; যার ফলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হবে দুঃসাধ্য। এই সংকট থেকে মুক্তির অন্যতম পথ হচ্ছে শেখ হাসিনার নির্দেশিত পথ। তিনি বলেছেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিতে হবে। তার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০-৬০ হাজার শিক্ষার্থী এবং কোথাও ৫০০ শিক্ষার্থী থাকলেও উভয় জায়গাতেই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। আমি তার এই উক্তিটিকে গভীর তাৎপর্যময় মনে করছি। বিগত বছরগুলোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে প্রায় ৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে আসছে। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এখন কম। কারণ নবপ্রতিষ্ঠিত ও প্রতিষ্ঠিতব্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আরো কমতে বাধ্য। আগে প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ৪-৫ হাজার শিক্ষার্থী পাওয়া সহজ হলেও বর্তমানে সে সংখ্যায় টান পড়েছে। টান পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আয়-উপার্জনে। যার ফলে ঘূর্ণায়মান ব্যয় পরিশোধ করে উন্নয়নমূলক কোনো অর্থ হাতে থাকছে না। এর সমাধান হিসেবে কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা প্রদানে অধিকতর আগ্রহী হবে। লোক শ্রুতি আছে যে, বেসরকারি বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি বার কাউন্সিল এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা দেখেছে যে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয় সময়ের তুলনায় কম সময়ে ডিগ্রি প্রদান করেছে। সময়সীমার কথা বের করা যাচ্ছে কিন্তু একেবারে শিক্ষা কার্যক্রম ছাড়াই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই ডিগ্রি দেয়াটা কীভাবে বের করা যাবে? ইউজিসি একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। তারা সব ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর তালিকা পেশ বাধ্যতামূলক করেছে। তবে কতটা কার্যকর করতে পেরেছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আপাতদৃষ্টিতে কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ সিলিং বেঁধে দেয়া, যা সম্প্রতি করা হয়েছে বলে শুনেছি। এটা নির্মোহভাবে কার্যকর করলে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্নীতি ও অনৈতিক ব্যবস্থার আশ্রয় না নিয়েও ক্রমশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় যত সংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সে সংখ্যাকে অপ্রয়োজনীয় বলা যাবে না এবং সংকটাপন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংকটমুক্ত হতে পারবে বলে মনে করছি।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : শিক্ষাবিদ উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App