×

জাতীয়

গ্যাস সিলিন্ডারের দায়িত্ব নেয় না কেউ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫১ এএম

গ্যাস সিলিন্ডারের দায়িত্ব নেয় না কেউ
গ্যাস বেলুন ফুলানোর মেশিন বানাতে কারো অনুমতি নিতে না হলেও তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। লোহার জারের হাইড্রোজেন তৈরির রিয়েক্টর হিসেবে ব্যবহার করায় তা বিস্ফোরণের ঝুঁকি থাকে। এসব সিলিন্ডারের দায়িত্ব নেয় না কেউ। ভ্রাম্যমাণ বেলুন বিক্রেতা আটকাতে বিস্ফোরক পরিদপ্তর কয়েক বছর আগে পুলিশকে চিঠি দিলেও কাজ হয়নি। এরই মধ্যে গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর রূপনগর ১১ নম্বর সড়কে শিয়ালবাড়ী আবাসিক এলাকায় বেলুন ফোলানোর একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৬ শিশু নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন ১২ শিশুসহ ২৫ জন। বিস্ফোরণে অনেকের হাত পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বেরিয়ে গেছে অনেকের পেটের নাড়িভুঁড়ি। চিকিৎসাধীন অনেকে হাসপাতালে রক্ত সংকটে পড়েন। ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। আহতদের মধ্যে ১৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে সাত জনকে। স্থানীয় সুরক্ষা হাসপাতাল এবং ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন কয়েকজন। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম ভোরের কাগজকে বলেন, বেলুন ফুলাতে যে মেশিন ব্যবহার করা হয় তা মূলত সিলিন্ডার না। এটি নিজস্ব উদ্যোগে লোহার জারে হাইড্রোজেন তৈরির রিয়েক্টর। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে ওই জারের ভেতরে পাতলা হয়ে বিস্ফোরিত হয়। যারা এ কাজ করে তারা স্থির নয়, বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। সে জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তিনি বলেন, ওই জার ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় কয়েক বছর আগে সব থানাকে এ ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয়েছে যাতে এ ধরনের বিক্রেতা দেখলে তাকে আটক করা হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন এন্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেছেন, বিচারিক ক্ষমতা না থাকায় আমরা এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে সিটি করপোরেশনের কোন ওয়ার্ডে কি ধরনের ব্যবসা হয় তা তারা জানেন। তাদের বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে। ঘটনার পর আলোচনা না করে আগে থেকেই এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার একযোগে কাজ করা উচিত। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহম্মেদ জানান, নিহত চার শিশুর বয়স ৮-১০ বছরের মধ্যে। আর নারীর বয়স ৩৫ বছর। আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ, হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মনিপুর স্কুলের রূপনগর শাখার বিপরীতে দুর্ঘটনায় বিকট শব্দে আশপাশের লোকজন বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়েছে বলে ধারণা করলেও মুহূর্তে ঘোর কেটে যায়। আহতদের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠে পরিবেশ। ভয়ে দিগি¦দিক ছুটোছুটি শুরু করেন অনেকে। খবর পেয়ে পুলিশ, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সেখানে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এ ঘটনায় নিহতরা হচ্ছেন শাহীন (১০), রুবেল (১০), রমজান (৮), নুপূর (৭), ফারজানা (৬) ও রিয়া (৭)। নিহত শিশুদের বেশিরভাগই পাশের ফজর আলী মাদবর বস্তির বলে জানা গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. আলাউদ্দিন জানান, ১৫ জনের মধ্যে তিন শিশু এবং জান্নাত নামে এক নারীর অবস্থা গুরুতর। ২৪ ঘণ্টা পার না হলে তাদের ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না। শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ড. উত্তম কুমার বড়–য়া জানান, নিহত ৫ শিশুর লাশ মর্গে রয়েছে। চিকিৎসা নিয়েছে ৭ জন। এদের মধ্যে দুইজনকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। বিস্ফোরণে আহত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৫ জন হলেন জুয়েল (২৫), সোহেল (২৬), জান্নাত (২৫), বোন তানিয়া (৮), ভাই বায়েজিদ (৫), জামেলা (৭), অজ্ঞাত পরিচয় শিশু (৫), মীম (৮), ওজুফা (৯), মোস্তাকিম (৮), মোরসালিনা (৯), নিহাদ (৮), অর্নব ওরফে রাকিব (১০), জনি (১০)। এ ছাড়া সিয়াম নামে ১১ বছর বয়সী একটি শিশু হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া আহত জুবায়ের (৮), সাদেকুর (১০), নাহিদ (৭), জামিল (১৪), আরিয়ানসহ (৯) কয়েকজনকে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আব্দুল খান বিকেলে বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় ১১ জন এসেছেন। অজ্ঞাত শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। সোহেলের অবস্থা গুরুতর। অন্যদেরও শরীরে জখম রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা যা দেখেছেন : প্রত্যক্ষদর্শী আনিসুর রহমান জানান, রূপনগরের ১১ নম্বর সড়কে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় বস্তিও রয়েছে। দুপুর ১২টা থেকে সেখানে রাস্তার ওপর ভ্যানে গ্যাস বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করছিলেন এক ব্যক্তি। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই ভ্যানের পাশে থাকা কয়েকজন শিশুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বেলুন বিক্রেতার এক হাত বিচ্ছিন্ন হয়েছে। মুহূর্তে ঘটনাস্থলে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ভ্যানে করে গ্যাস সিলেন্ডার নিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করছিলেন এক বিক্রেতা। পাশেই বস্তি এলাকা হওয়ায় অনেকেই ভ্যান ঘিরে এবং আশপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউবা বেলুন কিনছিল। এ সময় হঠাৎ করে বিস্ফোরণ ঘটে। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রূপনগরের ১১ নম্বর সড়কের ফজর আলী মাদবরের ছেলে কামরুল মাদবরের বস্তির সামনে বসে ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলেন। তিনি বলেন, বিকেল সাড়ে ৩টা হবে। ভ্যানে করে বেলুন নিয়ে আসে এক লোক। আমার ঝালমুড়ির পাশে এসে দাঁড়ায়, আমি তাকে সরিয়ে দেই। এরপর সে ১১ নম্বর সড়কের মুখে লোহার গেটের সামনে দাঁড়ায়। এ সময় কয়েকটা বাচ্চা এসে তাকে ঘিরে ধরে। এর ৫/৬ মিনিট পরেই বিকট শব্দ। সব অন্ধকার হয়ে গেল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ছাইয়ের মতো ধোঁয়া। আমি দৌড়ে উত্তর দিকে যাই। পরিষ্কার হতে প্রায় ৩/৪ মিনিট লাগে। শিশুদের চিৎকার শুনতে পাই। ধোঁয়া শেষ হলে এসে দেখতে পাই, লোহার গেটের সামনে রক্ত। শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ লাফাচ্ছে। আমি চিৎকার দিয়ে মানুষ ডাকি। এরপর ১৫/২০ মিনিট পর দেখি পুলিশ আসে। তারপর ফায়ার সার্ভিস। তারা এসে লাশ তুলে নিয়ে গেছে।’ ঘটনার পর বেলুনওয়ালা ভ্যানের কাছ থেকে ছিটকে প্রায় ২০ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পাশের টিনসেড ঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই পিঠা বিক্রি করছিলেন রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি ঘরে আসছি, এর মধ্যে ঠাস করে শব্দ। সব ধোঁয়া হয়ে যায়। আমার ছেলে আমাকে ডাকতে থাকে। আমি অন্ধকারে বের হতে পারছিলাম না। এরপর আমি নেমে দেখি রাস্তায় বাচ্চাদের লাশ পড়ে আছে। কেউ আহত হয়ে পড়ে আছে। জান্নাত পড়ে আছে, সে ধড়ফড় করতেছে। তার হাত ছিঁড়ে গেছে। আমি গিয়ে ধরলাম। এরপর আরও লোক আসে। মোস্তফা নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়ে কালো রংয়ের ছাইয়ের মতো ধোঁয়া হয়ে যায়। এসে দেখি শিশুদের লাশ পড়ে আছে। সড়কে সিলিন্ডারের ভাঙা অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শিশুদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। চুল পুড়ে গেছে। শরীর ঝলসে গেছে। অনেকের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। সিলিন্ডারের বিস্ফোরিত অংশ, টিন, ইট ভাঙা শিশুদের শরীরে গেঁথে ছিল। আহত জান্নাতের দেবর মনির হোসেন জানান, জান্নাত বাসা বাড়িতে কাজ করেন। মাদবরের বস্তিতে থাকেন। জান্নাত কাজ থেকে ফেরার পথে ঘটনার শিকার হন। আরেক আহত শিশু সিয়ামের মামা আরিফ জানান, সিয়ামের বাবা তোফাজ্জল কাঁচামাল বিক্রেতা, ঘটনাস্থলের পাশে রাস্তায় বসে সবজি বিক্রি করেন। সিয়াম স্থানীয় স্কুলের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী, সে তার বাবার দোকানে গিয়েছিল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App