×

সাময়িকী

ফ্লাইটস ও ওলগা তোকারচুক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:২৩ পিএম

ফ্লাইটস ও ওলগা তোকারচুক

মানুষের জীবন যে নানা ধরনের সীমানা অতিক্রমের কাহিনী, সেটাই ওলগা তাঁর লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রতি মুহূর্তে। তাঁর এই উপন্যাসকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিশ্বের কাছে আরো একধাপ আলোড়িত করেন জেনিফার ক্রফট। উপন্যাসটি যদিও ফিকশনের ওপর রচিত, কিন্তু তারপরেও এখানে থিওরি, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব এবং স্মৃতিচারণের উল্লেখ পাওয়া যায়।

পৃথিবীতে কাজের জন্য নোবেল পাওয়া মুখগুলোর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কেউ লেখালেখির জন্য, কেউ তার মহৎ কাজের জন্য, আবার কেউ বা পায় সমাজসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে। পোলিশ লেখিকা ওলগা নাওয়াজা তোকারচুক, যিনি তাঁর বিখ্যাত নভেল ‘ফ্লাইটস’ এর জন্য ২০১৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান। ওলগা নাওয়াজা তোকারচুক-এর জন্ম হয় ১৯৬২ সালের ২৯ জানুয়ারি, পোল্যান্ডের সুলেখোফ নামক একটি শহরে। তাঁর উপন্যাস ‘বাইগুনি’ ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে ‘ফ্লাইটস’ নামকরণ হয়, যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তাঁকে একাধারে একজন লেখক, প্রগতিশীল, মানবাধিকারকর্মী ও নারীবাদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর প্রজন্মের অন্যান্য সমালোচক এবং সাহিত্যপ্রেমীরা ওলগা তোকারচুকের লেখার প্রশংসা করেন ও বাণিজ্যিকভাবে সফল লেখক হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতিও দেন। ‘ফ্লাইটস’ উপন্যাসের জন্যে তোকারচুককে ‘ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’ও দেয়া হয়। কোনো পোলিশ লেখক সর্বপ্রথম এ পুরস্কার অর্জন করেন। মানুষের জীবন যে নানা ধরনের সীমানা অতিক্রমের কাহিনী, সেটাই ওলগা তাঁর লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রতি মুহূর্তে। তাঁর এই উপন্যাসকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিশ্বের কাছে আরো একধাপ আলোড়িত করেন জেনিফার ক্রফট। উপন্যাসটি যদিও ফিকশনের ওপর রচিত, কিন্তু তারপরেও এখানে থিওরি, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব এবং স্মৃতিচারণের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেহেতু বাবা ছিলেন একজন গ্রন্থগারিক, সেহেতু শৈশব থেকেই তাঁর বইয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং অগাধ টান থাকা অস্বাভাবিক ছিল না। তিনি ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং একজন মনোসমীক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষিতও হন। কবিতার হাত ধরে সাহিত্যের জগতে পা রাখা তাঁর প্রথম উপন্যাস দ্য জার্নি অব দ্য বুক-পিপল প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। যদিও তাঁর রচনার সংখ্যা বিপুল নয়, কিন্তু সেগুলো বেশ মূল্যবান। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই- দ্য বুকস অব জ্যাকব, নয়শ পৃষ্ঠার এক মহাকাব্যিক উপন্যাস যার পটভূমি হচ্ছে অষ্টাদশ শতকের পোল্যান্ড এবং তার পরিস্থিতি। তিনি তাঁর লেখাতেই গোটা পোল্যান্ডকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলেন। নোবেল কমিটি ওলগা তোকারচুককে বলেছেন তাঁর প্রজন্মের পোল্যান্ডের সবচেয়ে মেধাবী লেখক। তাঁর আলোচিত উপন্যাস বাইগুনি সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, বাইগুনি মূলত একটা উপজাতির নাম, সপ্তদশ শতক থেকে একটা রুশ উপজাতি ছিল যারা বিশ্বাস করতো মানুষদের অবশ্যই সর্বদাই চলাচলের ভেতর থাকা উচিত, কেননা, থেমে গেলেই শয়তান তাদের পাকড়াও করবে। তাদের কাছে পরিব্রাজ্যা ছিল এক ধরনের প্রার্থনার মতো, আর এটা তাঁর কাছে সাম্প্রতিক সময়ের পরিব্রাজকদের একটি প্রতীকী চিত্রকল্প বলে মনে হয়েছে। তিনি এই উপজাতি এবং তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে খুব সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন এই উপন্যাসে। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, একটি উপন্যাস গঠনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। এটি ছাড়া উপন্যাস প্রায় অসম্পূর্ণ বলে তিনি ধারণা করেন। একটি উপন্যাসের প্রতিটি প্লট মস্তিষ্কে ধারণা করতে সাহায্য করে একটি আদর্শ বিবরণ। তিনি গভীরভাবে তাই করেছেন এবং মানুষের মনে তা পৌঁছে দিতে সফল হয়েছেন। তিনি জানান, ‘যেসব বইয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নেই সেসব বই আমাকে টানে না; অভিযাত্রী মানুষের কাহিনী যেখানে ক্ষুদ্র সকল বিষয়ের, যেমন যে-ধরনের চেয়ারে তারা বসে, বা যে-ধরনের বস্ত্র তাদের পরিধানে, তার বর্ণনা ছাড়া পড়তে ভালো লাগে না।’ যখন দ্য বুকস অব জ্যাকব লিখছিলেন তিনি, তখন অষ্টাদশ শতকের পোল্যান্ড, যে পটভূমিতে উপন্যাসটি রচিত, আর খুঁটিনাটি ও সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে বেশ অবসেসড ছিলেন তিনি। তাঁর মনোজগতে ছিল অনেক প্রশ্ন। সে সময়ের লোকেরা দেখতে কেমন ছিল বা তারা কী খেত, এটা না জেনে তিনি একটি দৃশ্য রচনা করতে পারতেন না। তিনি তার বর্ণনা সম্পর্কে আরো বলেন, ‘একটি দৃশ্যের কথা, যেখানে একদল নারী বসে আছে, সেলাই করতে করতে তারা পরস্পরের সাথে কথা বলছে। সেখানে একটি মনোহর বাক্য আছে, তাদের সুচের উপর মোমবাতির আলোর চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে। বাক্যটি লেখার পরেই আমার মাথার ভেতর একটি সতর্কঘণ্টা বেজে উঠেছিল, আমি অনুসন্ধান করে পেলাম যে ঐ সময়ে তারা ধাতব সুচ ব্যবহার করেনি, তখন ছিল কেবল কাঠের সুচ। আমাকে তখন ঐ দৃশ্যের পুরো বর্ণনাটি পাল্টাতে হয়েছিল। এটি একটি তুচ্ছ বিষয়, কিন্তু আমি আমার কল্পনায় নেই জগৎটিকে পুনর্গঠন করার চেষ্টায় আনন্দ খুঁজে পাই।’

এ থেকে বোঝা যায় তিনি পরিলক্ষিত একটি দৃশ্যপটকে নিজের কল্পজগতে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারতেন। যা কিছু আনন্দদায়ক, যা কিছু স্বস্তিদায়ক তার জন্মই হয় কল্পজগতে, তার প্রমাণ তিনি নিজেই। তিনি বাস্তবতা আর কল্পনার মিশ্রণে উপন্যাস লেখেন। তবে, এক্ষেত্রে কল্পনাগুলোর সূত্রপাত হয়ে থাকে বাস্তবতা থেকেই।

তোকারচুক নিজেকে কার্ল জাঙের একজন শিষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন এবং জাঙের মনস্তত্ত্ব তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তোকারচুক নোয়া রুদার নিকটবর্তী একটি ছোট গ্রামে বসবাস করছেন এবং সেখান থেকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রকাশনা কোম্পানি রুটা তত্ত্বাবধান করেন।

তোকারচুক ফ্লাইটস রচনা করেন একটি সমাবেশমূলক উপন্যাস হিসেবে : ভ্রমণে বহনযোগ্য টয়লেট্রিজ থেকে মানব হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালন পর্যন্ত সঞ্চরণশীল সকল চিন্তার একটি আদর্শ গঠন এটি। একটি চরিত্রের ফিকশনাল রহস্য এটি, যার স্ত্রী ও পুত্র এক ছুটির দিনে হাওয়া হয়ে যায়, এটিতে আছে শপ্যাঁর বন্ধুরা কীভাবে তার আত্মাকে পোল্যান্ডে গোপনে ফিরিয়ে আনে তার ঐতিহাসিকভাবে নিখুঁত বর্ণনা এবং ফ্লেমিশ শারীরতত্ত্ববিদ ফিলিপ্পো ভেরহেয়েনের জনপ্রিয় কিংবদন্তি যেখানে গুজব আছে যে তিনি নিজেই তার কেটে ফেলা পায়ের ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। নিজের পঞ্চম উপন্যাস ফ্লাইটস-এর মাঝপথে গিয়ে ওলগা তোকারচুক তাঁর পাঠকদের সেই সব বেচারাদের করুণা করতে বলেন, ইংরেজি যাদের ‘মূল ভাষা’। পোল্যান্ডের সবচেয়ে বহুল অনূদিত মহিলা লেখক খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘একবার ভাবুন তো! দুনিয়ায় কেমন পথহারা অনুভূতির মুখোমুখি হতে হয় ওদের, যেখানে সকল শিক্ষাব্যবস্থা, চরম অর্থহীন গানগুলোর কথা, দুঃসহ সব প্রচারপত্র ও ব্রোশিওর এমনকি লিফটের বোতামগুলোও- সবকিছুই তাদের নিজস্ব ভাষায়... সেসব সবার কাছে এবং সবকিছুর জন্য সুগম।’ তিনি তার চিন্তাধারাকে অকপটে প্রকাশ করতে কখনোই দ্বিধা করেননি। কোনো এক প্রসঙ্গে তাঁকে একদা প্রশ্ন করা হয় যে তিনি রাজনীতিবিষয়ক লেখা লেখতে পছন্দ করেন কিনা। সহাস্য ভঙ্গিতে অকপটে উত্তর দেন তিনি, ‘আমি জীবন, প্রকৃতি নিয়েই লিখতে ভালোবাসি। রাজনীতি আমাকে টানে না কখনোই।’ তিনি মানুষের জীবন, প্রতিটি মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা পৃথিবীর ভিন্ন রূপ বর্ণনা করতে ভালোবাসেন। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন, প্রতিটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা এই চিরচেনা জগতের প্রতি। তিনি সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো থেকে অনুভব করতে চান, লিপিবদ্ধ করে রাখতে চান প্রতি মুহূর্তে।

জানা যায়, তোকারচুক নিজেকে কার্ল জাঙের একজন শিষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন এবং জাঙের মনস্তত্ত্ব তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তোকারচুক নোয়া রুদার নিকটবর্তী একটি ছোট গ্রামে বসবাস করছেন এবং সেখান থেকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রকাশনা কোম্পানি রুটা তত্ত্বাবধান করেন। ওলগা তোকারচুক একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে গত বছরই মনোনিত হয়েছিলেন। কিন্তু যৌন অসদাচরণের এক অভিযোগের তদন্ত নিয়ে জটিলতায় গত বছর সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়নি। বৃহস্পতিবার তাই একসঙ্গে দুই বছরের পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিকের নাম ঘোষণা করা হয়। রয়টার্স লিখেছে, দুই লেখককেই বিভিন্ন সময়ে তাঁদের অবস্থানের কারণে বিতর্কিত হতে হয়েছে। তোকারচুক বিতর্কে জড়িয়েছেন পোল্যান্ডের ইতিহাসের সেই অন্ধকার অতীত নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে, যে ইতিহাস দেশটির ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রচারিত ভাষ্য থেকে আলাদা। কিন্তু তাদের দুজনই এবার নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সুইডিশ অ্যাকাডেমি। আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে এ দুই সাহিত্যিকের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয়া হবে নোবেল পুরস্কারের ৯০ লাখ ক্রোনার, মেডাল আর ডিপ্লোমা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App