×

সাময়িকী

দোহারের ছদ্মবেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:১৬ পিএম

এই সব ভাবতে ভাবতে সাবিত্রীর মনে হয়, মা কালীর সামনের হাঁড়িকাঠে ওর গলাটা দিতে পারত যদি। দুর্বল মানুষের অসহায়ত্ব বেশি! আর তারপরই ভাবে ওই পার্বতী নিজেই তো মাকালী! মাকালী ছাড়া এইভাবে পুরুষ মানুষ নড়াইয়া খায় কোনো মানুষ! যদিও পার্বতী যতই মাকালী হোক, ওর কথাও তো সে শোনে নাই।

পর্ব: ৮

চোখে মুখে রাগ নেই। স্রেফ বলার জন্যে বলা। সাবিত্রী জানে, সে বলে কিছু করতে পারবে না। বরং ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে টানা গালমন্দ করে যাবে পার্বতী। কোনোভাবেই কেউ ঠেকাতে পারবে না। তা শুনে মুখখানা শুকিয়ে বেরিয়ে যাবে কৃপাসিন্ধু। পরে সেই ঝাল কোনো সুযোগে ঝাড়বে ওই বুড়ো মানুষ কেষ্টর ওপরে। আজকাল বলা শুরু করেছে লালদালানের ভাত খাওয়াবে। কোন জোরে যে বলে, তা যদিও সে বুঝতে পারে না। তবে, সুনীল আসলে একসময় জানতে চাইত যে কোন জোরে আজকাল এই কথা বলা শুরু করেছে! এ কথা শুনে সত্যি বুক কাঁপে সাবিত্রীর। গরিব ঘরের অসহায় মেয়ে সে। একটা পা ওই অবস্থা। পর পর তিনটে মেয়ে। আর পার্বতী উপজেলা সদরের। সত্যি যদি কোনো দিন লোকটাকে থানায় নিয়ে কিছু করে। যদি কোনো দিন জেল খাটায়? তখন এই মেয়েদের নিয়ে সে থানায় যাবে? কার কাছে যাবে? এই সব ভাবতে ভাবতে সাবিত্রীর মনে হয়, মা কালীর সামনের হাঁড়িকাঠে ওর গলাটা দিতে পারত যদি। দুর্বল মানুষের অসহায়ত্ব বেশি! আর তারপরই ভাবে ওই পার্বতী নিজেই তো মাকালী! মাকালী ছাড়া এইভাবে পুরুষ মানুষ নড়াইয়া খায় কোনো মানুষ! যদিও পার্বতী যতই মাকালী হোক, ওর কথাও তো সে শোনে নাই। চেয়েছিল একটা মেয়ে, হয়েছে ছেলে। হ্যাঁ, পার্বতী দ্বিতীয় বাচ্চাটা পেটে আসলে বছর দুয়েক আগে কালী পূজার সময় মানত করেছিল, এবার তার মেয়ে হলে পাঁঠা বলি দেবে। কিন্তু হয়নি, দ্বিতীয়টা ছেলেই হয়েছে। ফলে পার্বতীর এই অপ্রাপ্তি সাবিত্রীর জন্যে সাহস! ওর কথাও তাহলে শোনে না ঠাকুর। না, শুনুক তাই সে চায়। কিন্তু এখন খুদি আর কী বলে। সে বরং বলে, ‘ঘরে যাও বউ! উঁচুগলায় কথা কইয়ে ঝগড়া বাদাইয়ে না!’ আজকাল খুদিকে বড়ো অমনোযোগী লাগে সাবিত্রীর। সব কিছুতেই। যেন খুদি এই সবকিছুতে থেকেও নেই।

৬. বাড়িতে ঢুকেই সুনীল গলা চড়ায়। প্রথমে দাঁড়ায় অবিনাশের ঘরের সামনে। তাকেই সবার আগে জানাতে হবে। কিন্তু এখন অবিনাশ ঘরে নেই। মনে হয় বাড়ির পিছনের দিকে কোথাও গেছে। পিছনের পুকুরের পাড়ে গিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে থাকার স্বভাব আছে তার। অথবা বিবিসি ভালোমতো না-ধরলে রেডিয়োটা নিয়ে পুকুর পাড়ে যায় সে। অবিনাশকে এইভাবে ডাকায় ঘরে থেকে বেরিয়ে আসে অংশুমান। কলেজপড়ুয়া অনির্বাণ এখনও অমলের দোকানের কাছে। সুনীলের এখন অবিনাশকেই দরকার। বাড়িতে ভাইদের ভিতরে সে-ই বড়ো। তাকে জানিয়ে দেবুর দরজায় যাবে। অবিনাশ এমনিতে প্রায় কথাবার্তা বলেই না, কারও সাথে পাছে কখনওই ছিল না, কিন্তু গুষ্টির মানসম্মান বিষয়ে তার জেদ বড়ো টনটনে। এখন সুনীল যে বিষয়টি নিয়ে এসেছে, তাতে তার সায় থাকবে ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা- তা সুনীল জানে। কিন্তু সে যে তৎপরতায় এখানে এসেছে তা প্রায় ভেস্তে যায়। অবিনাশ এখন ঘরে নেই। তাই সুনীল একই গলায় অবিনাশের ছোটভাই লালমোহনকে ডাকে। এদিকে পুবমুখী বড়ো টানা ঘর। দক্ষিণ অংশে স্বপন থাকে। কচুয়া থেকে এলে থাকে সঞ্জয়, আর কখনও সুনীল এলে। উত্তর অংশে থাকে অবিনাশ আর লালমোহন। দুই ঘরেই দুইভাই দেশ ছেড়েছে। লালমোহনের ছোট জীবন বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন বাগেরহাট খুলনা আর ঢাকায় থেকে চলে গেছে পশ্চিম বাংলার চন্দননগরে; আর সঞ্জয়ের বড়ো স্বপনের ছোট টুনু এসএসসি পাসের পরে হঠাৎ বহরমপুরে চলে যায়। একেবারেই নিজের সিদ্ধান্তে। তাতে অবশ্য হালদারদের পারিবারিক শক্তি খানিকটা খাটো হয়েছে। তবে সবচেয়ে কমেছে দেবুর বাবা মারা যাবার পরে। দেবুদের ঘর এই উঠারেই উত্তর দিকে, দক্ষিণমুখী। দেবুর বাবা স্থানীয় প্রাইমারিতে পড়াত। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা গুষ্টির নানান প্রয়োজনে সে কথা বলতে পারত। অবিনাশের বাবা মারা যারা পরে সুনীলের বাবাই সে কাজ করত। কিন্তু সুনীল সঞ্জয় এখানে থাকে না। বীরেন্দ্রনাথের বয়েস হয়েছে, ওদিকে দেবু-শিবুর বাবা মারা গেছে হঠাৎ। তারাও আগে দেবুর জেঠামশাই দেশ ছাড়ে হঠাৎ। কেউ বলে, দেনার দায়ে। কেউ বলে, তার বড়ো মেয়েটা গলায় দাড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে, তারপর সেই মেয়ে যখন সময়ে অসময়ে বাড়ির সামনের চাপকলটা চাপত, তখন সেই মায়া কাটানো তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন সে দেশত্যাগ করে। যদিও আজকাল আর স্বপনের সেই বিজলি দিদি চাপকল চাপে না। স্বপন যখন ধানের কারবার করত, ধানভরতি নৌকা নিয়ে বাড়ি সামনের খালে ঘুমাত, সে সময়ে শুনেছে সেই কলচাপার শব্দ! সে কথা লালমোহনকে বলত, লালমোহনও শুনেছে। তবে তখন বীরেন্দ্রনাথই প্রথম তাদের জানায় এটা বিজলির কাজ। এখনও পর্যন্ত মনে হয় পরীক্ষিৎ মেয়েটার নামে সেই মুর্শিদাবাদে দুটো ডালভাত খাওয়ানি মানুষকে। তবে এই গুষ্টির ভাইদের ভিতরে সে-ই পরীক্ষিৎই ছিল সবচেয়ে অদ্ভুত। খেয়ালি মানুষ। আর চৈতন্য ভাগবতের এমন পাঠক, এই তল্লাটে প্রায় ছিলই না। জমিদারি ব্যবস্থার শুরু দিকে হলে হয়তো ওই পরীক্ষিতের কারণেই তাদের গুষ্টির পদবিই বদলে হয় যেত পাঠক কিংবা বাগচি। এ কথা এখনও বীরেন্দ্রনাথ বলে, সে প্রবীণ মানুষ। এই সুনীল হয়তো সে কথা শুনতেও পারে, কিন্তু অবিনাশের ছেলেমেয়ে অনির্বাণ অংশুমান কিংবা পারুলের কাছে এ সাহিত্য অর্থহীন। অর্থহীন বীরেন্দ্রনাথ খুড়তো ভাইর ছেলে দেবুর কাছেও। তার জেঠামশাই ভাবগৎ পাঠক হিসেবে কতটা খ্যাতিমান ছিলেন, তা ধুয়ে জল খেলেও কোনোভাবেই তার দিন চলবে না। যেমন এও সত্যি, এভাবে সেভাবে আর জুয়ো খেলে দেবু যে নিজেকে ঋণগ্রস্ত করে ফেলেছে, তাও তার বাবার এই সমাজে কী পরিমাণে গুরুত্ব ছিল তা দিয়েও দিন চলবে না। তাই এখন তাকে বিভিন্ন সুযোগের খোঁজ নিতে হয়। এসবই সুনীল জানে। কিন্তু আজকের ঘটনায় বিষয় একটু আলাদা। লালমোহন বের হয়। সুনীলকে দেখেই বলে, ‘এ সুনীল, হইচে কী?’ ‘হবে আর কী? সবাই আমাগে ভাইগ্যো। এরপর সবাই চাটি দেবে বোঝলা ও মোহনদা?’ বলে, সুনীলের মনে হয় এই উত্তেজনা দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। লালমোহনকে মানুষ হিসেবেই কেউ গোনে নাকি? সে আজকে দেবুরে একটা ধমক দিল তো কয়দিন বাদে তালেশ্বরের হাটে ওই দেবুই তাকে উলটো ধমক দেয় তো সে কোনো কথা বলতে পারবে না। এমন ঘটেছে। দেবুর মতো ছোট কেউ তা করেনি, কিন্তু বৈরাগীর হাটে ওই বড়ো আন্ধারমানিকের নির্মল কিছু একটা বললে, সে-কথার বিচার নিয়ে সে এসে সুনীলের কাছে কচুয়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিল লালমোহন। সুনীল তখন বলেছিল, ‘মোহনদা, এই এত্তখানি পথ হাঁইটে আইসে তুমি আমারে নালিশ করতিচো, এই কথাডা তুমি সামনাসামনি নির্মলরে ক’লা না কেন?’ সে-কথাটা সুনীলের চেয়ে নির্মলই ভালো জানে। ফলে সুনীল গলা নামিয়ে বলে, ‘বড়দা, কই, মোহনদা?’ মোহন বলে, ‘আছে মনে হয় আশেপাশে। রেডিয়ো নিয়ে পুকুর পাড়ে গেছে নাকি?’ এই সময়ে অবিনাশ আসে। সে রেডিয়ো নিয়েই গিয়েছিল, সেখানে খবর হচ্ছে না। হচ্ছে গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বলে দিবস গেলে-’ সেই তালে অবিনাশ মাথা নাড়ছে। বলে, ‘আহ্ কী বাণী!’ আর লাগে পূজা দেয়া। ঠাকুর ঠাকুর (এই ঠাকুর অনুকূল ঠাকুর)!’ তারপর রেডিয়োটা একটু কমিয়ে বলে, ‘কী হইচে, ডাকাতিচস কী জন্যি।’ এট্টু রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনব তোগো ঠেলায় সে উপায়ও নেই।’ সুনীল কিছু একটা বলবে। লালমোহন সামনের বারান্দায় একটা হারিকেন এনেছে। কিন্তু তার আগেই অবিনাশ আরও বলে, ‘সুনীল, তুই আসলি কহোন?’ ‘সেয়া মেলা আগে। বিকেলে। আইসে কততা করলাম।’ ‘চেতলি কী জন্যি?’ ‘কতিচি, শোনো।’ এরপর সুনীল বিস্তারিত জানায়, দীনেশ মলঙ্গির সঙ্গে দেবু কীভাবে ঘোট পাকিয়েছে। তাকে পুরোটাই বলে দিয়েছে রণজয়। যদিও দেবু ভেবেছিল, রণজয়ের মেয়ে রচনার সঙ্গে সঞ্জয়ের ঘটনায় দেবুও জড়িত, সেই কারণে সে যদি এখন ওই হরিসভা মন্দিরের বিষয়ে স্বপন কিংবা লালমোহন অথবা অবিনাশের পক্ষ নেয় তাহলে হয়তো দীনেশ তাকে ধার দেবে না। দীনেশ তাকে ধার এমনিও দিত না, ওমনিও দিত না, যদি রণজয় বলে না দেয়। কিন্তু বিষয়টা সেখানে নয়, দীনেশ এই খেল যে খেলবে তা তো তারা সবাই জানত। দেবু কি তা জানত না। নিশ্চয়ই জানত। আগের বার যখন মলঙ্গিবাড়িতেই মিটিং হয়েছিল, সেদিন সুনীল ছিল না। তখন কতবার চেষ্টা করেছে আপাতত যেন মন্দিরটা না হয়। একবার অনিমেশের কথা বলেছে, তাতে সায় দিয়েছে খাঁবাড়ির সর্বজিৎ; যদিও সে সবে ব্যাগড়া দিয়ে দেয় সুনীলের মামাতো ভাই কমলেশ। অনিমেশের এক চিঠির খবরে জানায় যে গ্রামের গুরুজনরা যে সিদ্ধান্ত জেনে সেই জায়গায়ই হবে মন্দির, আপাতত তা রসিকের দেওয়া, সে জায়গা বদলে যদি মল্লিকরা সামনের বড়ো রাস্তার পাশে জমি দিতে চায় তো আরও ভালো। সে কথায় মন্দিরের জায়গা তো তাদের মন মতোই স্থির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে দীনেশ এই যে খেলটা খেলল। সেটা খেলল কেন? অবিনাশ ভিতরের সব খবর জানে না। জানে না যে, দীনেশই দেবুকেও লাগিয়েছিল রাঘবকে বোঝাতে, পারলে পাবর্তীকেও একটু ইঙ্গিত দিতে। অথচ ওদিকে রণজয়কে দীনেশ বলেছে, তার দেবুর পক্ষে কিছুই বলা লাগবে না। দেবুর যদি টাকা লাগে সে দেবে। এখন তো সব কথা সুনীল স্বপন কিংবা শ্রীধর বা পরিতোষের কাছে ফকফকা। সুনীল এসব এখন অবিনাশকে বোঝতে চায়। যদিও অবিনাশ বোঝার চেয়ে সুনীলের এখন দরকার দেবুর কাছ থেকে কথা আদায় করা। যদি সবার কাছে প্রমাণ করতে পারে যে দীনেশ এই কাজ করেছে, তাহলে রণজয়ের মেয়ে রচনার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে হালদারদের যে সামাজিক ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারবে। এই সঞ্জয় বাড়িতে আসে না। সুনীলই তাকে মানা করেছে। এরও একপ্রকার সমাধান হয়। সঞ্জয়ের কথা তাদের মা বারবার জিজ্ঞাস করে। তার ছোট ছেলেটা বাড়ি আসে না কতদিন। অবিনাশ রেডিয়ো বন্ধ করে দিয়েছে। লালমোহন দাঁড়িয়েছিল ঘরের দাওয়ায়, তার হাতে রেডিয়োটা দিয়ে অবিনাশ সুনীলের কাছে এগিয়ে আসে। অন্ধকার কেউ কারও মুখ দেখতে পারছে না। তবে অবিনাশ সুনীলের উত্তেজনাটা পড়তে পারছে। ওদিকে সুনীলের মনে হয়, এমনভাবে এসে সে বলছে, এই যে গুষ্টি-গোত্রের মান ইজ্জতে প্রশ্ন, এই যে গোড়াখালের মলঙ্গি আর ওপারের খাঁ-ঘরামি-মালি আর মাঝিদের কাছে তাদের এতদিনের সম্মান আর প্রভাব প্রায় যায় যায়, এ নিয়ে তাদের গুষ্টির বড়োভাই এই মাস্টারমশাইর কোনো বিকার আছে বলে মনে হয় না। যদিও সুনীল যেমন জানে, জানে এই বাড়ির সবাই যে, অবিনাশ অমনই। গায়ে জল ঢেলে তারপর তাকে কথা শোনাতে হয়। অবিনাশ সুনীলের কাছে আসে। এ সময়ে দক্ষিণের ঘর থেকে সুনীলের বাবা বীরেন্দ্রনাথ গলা বাড়িয়ে, উঁচু গলায় জানতে চায়, ‘ও সুনীল, দেবু করছে কী?’ এ কথার ভিতরে একই সঙ্গে দুটো ইঙ্গিত আছে। কিন্তু সুনীল ভাবে, আজও আছে তার বাপের সচেতনতা, ক-বললেই কলকাতা বোঝে। বীরেন্দ্রনাথের কথায় দুটো ইঙ্গিত আছে। তার একটি হলো, দেবু যে এমন কাজ করতে পারে তা সে জানে। আর সুনীল অবিনাশের সঙ্গে কথা বলে দেবুরে যেন বেশি কিছু না বলে, ছেলেটার বাপ নেই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্ট করছে। গুষ্টির বড়োভাই হিসেবে তাদের উচিত দেবুকে যত দূর সম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করা। অবিনাশ বীরেন্দ্রনাথের উলটো। সুনীল তাই তার এই বড়োভাইকে হাত ধরে টেনে খাল পাড়ে নিয়ে যায়। তারপর বলে, ‘বড়দা, আমি বাড়িঘরে থাহি না, দেবু এই যে করলি গুষ্টির ইজ্জত বাঁচে?’ অবিনাশ জানায়, সে সবই জানে। এই ঘটনা আজকের এক দিন দুই দিনের নয়, অনেকদিন ধরেই এচেষ্টা চলছে ভিতরে ভিতরে। এই দেবু হলো দীনেশের তুরুপের তাস। সুনীল অবিনাশের কাছে জানতে চায়, ‘তাইলে দেবুরে কিছু কব না?’ ‘কব না কী জন্যি? অবশ্যই কব।’ ‘তালি চলো, এট্টু আগে দেখলাম ও ঘরে আইচে। ‘কী করি?’ ‘কব আর কী? ওরে জিগব যে, ও দীনেশদার বুদ্ধিতে এই কাজ করছে না নিজের বুদ্ধিতে?’ অবিনাশ সুনীলের সঙ্গে যায়। তার যেতে অনিচ্ছা। কারণ, সুনীল বাড়িঘরে থাকে না। কাল সকালে উঠে চলে যাবে। কিন্তু একবাড়ির ভিতরে থেকে এই কাজিয়া ক্যাচাল ভালো লাগে না। কিন্তু সুনীল যখন এই ঘটনাটি নিয়ে ভেবেছে, এর তো তল সে দেখেই ছাড়বে। অবিনাশ তার সঙ্গে না গেলে তাও ভালো দেখায় না। তাই সে দেবুদের দক্ষিণমুখী ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সুনীল দেবুকে ডেকেছে, ‘এ দেবু, এট্টু উঠোনে আয়। তোর সাথে কথা আছে।’ দেবু বের হয়। নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো দরকার, নয়তো অবিনাশ তার দরোজার সামনে আসত। সুনীল হয়তো আসত, এমনিতে ঘরে ঢুকে দুটো কথা বলেও যেতে পারত, কিন্তু অবিনাশের তো আসার কথা নয়। কিন্তু উঠোনে এই অন্ধকারে বের হয়েই দেবু বোঝে নিশ্চয়ই তাকে জরুরি কিছু বলবে। আর অবিনাশ সঙ্গে থাকলেও যা বলার বলবে সুনীল। তার মুখটাকে বড়ো ভয় দেবুর। কথা বেযুক্তির বলে না। কিন্তু এমন জায়গায় এমনভাবে এমন সময়ে বলে যে উত্তর দেয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। অবিনাশকে উদ্দেশ্য করে দেবু বলে, ‘কী কন ও বড়দা-’ বলেই তাদের ঘরের ভিতরে যাওয়ার জন্যে ডাকে, ‘আসেন, ভিতরে আইসে বসেন। না, এই উঠোনে দাঁড়াইয়ে কথা কবেন?’ অবিনাশ কিছু বলার আগেই সুনীল বলে, ‘না ভিতরে বসপো না। অল্প কথা। ওই খালপাড়ের দিক চল-’ খালের পাড়ে যাওয়ার আগেই সুনীল বলে, ‘এ দেবু, কাকা মারা গেছে পরদে তোরে এই বাড়ির এই গ্রামের কোনো কাজে আমরা এই কয় ভাই কোনো দিন পৃথক ভাবিচি? তুই কতি পারবি?’ দেবু যেন বুঝতে পারে তাকে গুরুতর কিছু বলার জন্যেই এইভাবে ডেকে এনেছে এবাড়ি অন্য শরিকের বড়ো দুই ভাই। তাই সে প্রায় মিনমিনিয়ে গলায় বলে, ‘কেন ওদা, আপনার কতা কোনো জায়গায় আমি কোনো দিনও খারাপ কইচি নিকি? আর নয়, ক’তি পারবেন এমন ঘটিচে কোনো দিন আপনে গো কতা শুনিনি এমন হইচে?’ ‘না, হইনি।’ অবিনাশ বলে। অবিনাশের এ কথায় শুরুতেই যেন বল দেবুর কোর্টে দিয়ে দেওয়া হলো। সেখান থেকে নিজের বা নিজেদের কাছে ফিরিয়ে আনার জন্যে সুনীল বলে, ‘শোন দেবু কাজের কথায় আসি- এই হরিসভা মন্দির নিয়ে গোড়াখালের দীনেশদা তোরে কী কইচে?’ কথাটা বরং উলটো দিক দিয়ে জানতে চাইলে দেবুর জন্যে উত্তর দেওয়া সোজা হতো। কিন্তু সুনীল শুরু করল একেবারে বিপরীত দিক থেকে। এদিক থেকে সহসা দেবুর মতো মানুষের পক্ষে হালে জল পাওয়া খুব সোজা কথা নয়। আর বলতে গেলে দেবুর সঙ্গে দীনেশ মলঙ্গির কোনো কথাই হয়নি। তবে হ্যাঁ, যা কথা হয়েছে, সে গোমড়ও তো দেবু ফাঁস করতে পারবে না। দীনেশ দেবুকে দায়িত্ব দিয়েছিল রাঘবকে একটা কথা বোঝানোর। দেবু রাঘবকে বুঝিয়েছে। এখন সে কথা তো এখানে বলতে পারবে না। দিন কয়েক আগে বড়ো আন্ধারমানিকের দিক থেকে হেঁটে আসছিল দেবু। সেদিকে তার মামাবাড়ি। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App