×

সাময়িকী

ঘুমন্ত সত্তাকে জাগ্রত করাই প্রকৃত লেখকের কাজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:৩৪ পিএম

ঘুমন্ত সত্তাকে জাগ্রত করাই প্রকৃত লেখকের কাজ

এ কথাটি আমাদের সকলেরই জানা যা ধর্মে আছে সেটি হলো আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অথচ মানুষই মানুষকে ধ্বংস করছে, মানুষ সৃষ্টিকে ধ্বংস করছে। আমাদের চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় আমরা কতটা অমানুষ। অথচ এই মানুষকেই বলা হয়েছে ‘মানুষ সবার উপরে সত্য।’ এই চিরন্তন সত্য কথাটার বাস্তবতা কতটুকু তা আমরা নিজেরাই সাক্ষী। যে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে আজ তাদের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক নেই, নেই মানুষে মানুষে মমত্ববোধ। অথচ আমরা ভালো করে লক্ষ করলে দেখতে পাই পশু-পাখিদের মধ্যেও যতটা নিবিড় প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে মানুষের মধ্যেও ততটা সম্পর্ক নেই। আমাদের সমাজে সহনশীলতার বড্ড অভাব দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো শিশু জন্ম থেকে সহনশীল। আবার শিক্ষার মাধ্যমেও শিশু সহনশীলতা আয়ত্ত করতে পারে। কিন্তু কোথাও সহনশীলতার স্থান নেই, নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, নেই রাজনীতিতে। ব্যস্ত জীবনের স্বল্প পরিসরে সহনশীলতা শেখানো বা শেখা কোনোটার উপাই নেই। আমরা আমাদের শিশুদের কাঁধে জ্ঞানের বোঝা তুলে দিচ্ছি জ্ঞান অর্জনের তাগিদে। কিন্তু ঐ শিশুরা নিজেদের জ্ঞানকে, সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে মুখস্থ বিদ্যায় শিক্ষিত হচ্ছে বটে। তবে তারা কতটা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তা ভেবে দেখার বিষয়। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক আর মানুষ গড়ার কারখানা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর সেই কারিগর আর কারখানায় যদি গাদা গাদা বই মুখস্থ করে হুবহু অনুসরণ করেন শিক্ষার্থীদের তাহলে কীভাবে জ্ঞানার্জন হবে। উপায় নেই তাদের। কারণ বইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীরা কিছু লিখলেই তাদের নম্বর কেটে দেয়া হয়। পাখির মতো অন্যের বুলি আওড়াতে অভ্যস্ত শিক্ষকেরা আর তার অনুকরণ করে শিক্ষার্থীরা এভাবেই নিজ সত্তা হারিয়ে ফেলছে। বাইরের জগতের নতুন কিছু দেখার বা ভাবার সময় সুযোগ নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হয়েছে যে, বুঝি বা না বুঝি বইয়ে যা লেখা আছে তাই লিখতে হবে। আমাদের ভেতরের কথা, ভেতরের বিশ্বাসকে হত্যা করে পাখির বুলি আওড়াতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু কারা এই ব্যবস্থার জন্য দায়ী? আজকের সমাজে মূর্খরাই জিন্দাবাদ, মূর্খরাই জ্ঞানী, মূর্খরাই আমাদের পথপ্রদর্শক। কেননা, আমাদের দেশের অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক আছেন যাদের একাডেমিক সার্টিফিকেট নেই অথচ আমরা তাঁদের আজো অনুসরণ করে চলি, তাঁদের নাম ইতিহাসের খাতায় লেখা আছে। কারণ তাঁরা সমগ্র জাতির ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, পাহাড়-পর্বত, আকাশ, নদী, পশু-পাখি, অরণ্য এবং সব মানুষের কথা বলে গিয়েছেন। শিকার করতে হবে তারা প্রকৃত জ্ঞানার্জন করেছেন এবং জাতিকে অনেক কিছু দিয়ে যেতে পেরেছেন। কারণ তাঁরা নিজ সত্তাকে বিক্রি করেননি কারো কাছে। তাঁরা তাঁদের অন্তর্গত জীবনে খোঁজ করেছেন তারা কী পছন্দ করেন আর করেন না। অন্তর্গত জীবনে বাধ্যবাধকতা নেই বলে ভালো-মন্দ বিচার করতে পেরেছেন এবং নিজেদের মতো করে একটি জগৎ তৈরি করেছেন যে জগতে সবশ্রেণির মানুষের কথা বলেছেন, সম্পর্কের কথা বলেছেন। আমাদের সমাজের ভদ্র শিক্ষিত লোকেরা মনে করেন ইংরেজি না জানাটা মূর্খতা। ইংরেজি জানা মানেই তিনি জ্ঞানী ব্যক্তি। অথচ এই আমাদের বাংলাভাষা রক্ষার্থেই দেশের তাজা তাজা ফুলগুলো ঝরে পড়েছিল অকালে। অনেক জীবন, অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের পাওয়া বাংলাভাষাকে অবমাননা করা হচ্ছে। এমনো অনেক পরিবার আছে যারা তাদের বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন যখন তারা আধো আধো বোলে কেবলি কথা শিখছে। অথচ দেখেছি তারা বাংলাটা ভালো বলতেই পারে না। বাংলা শব্দের অর্থ ইংরেজিতে বোঝাতে হচ্ছে। সত্যি বাঙালি জাতি হিসেবে খুবই লজ্জার বিষয়। এমন ইংরেজি বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে যে তারা তার মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলতে বসেছে। অথচ শিশু কিন্তু জন্ম থেকে তার মায়ের মুখে বাংলা শিখেই বড় হয়। যখন আমাদের ধর্মান্তরিত করা গেল না, ভাষাকে কেড়ে নেয়া গেল না তখন বাঙালিদের মধ্যে কায়দা করে ইংরেজি ঢুকিয়ে দেয়া হলো। আমাদের বাঙালিদের ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি বিশেষ প্রেম ও টান আছে বলেই ইংরেজি সাহিত্য জায়গা করে নিতে পেরেছে বাঙালিদের মধ্যে অথচ কী পেয়েছি এই ইংরেজি থেকে? বরং হারিয়েছি অনেক কিছু ইংরেজি সাহিত্যে দেশের সব কথা বলে না। এখন বুঝতে হবে কারা এর জন্য দায়ী? আফসোস হয় বাঙালি জাতির জন্য, কষ্ট হয় শহীদদের জন্য যাদের দাবি ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। আমরা সর্বক্ষণ হীনমন্যতায় ভুগি। আমরা আমাদের দেশের কবি, সাহিত্যিকদের ভুল ধরতে অভ্যস্ত আর বিদেশি লেখকদের গুণগান করতে। আমাদের দেশের প্রথিতযশারা কী দিয়েছেন দেশের জন্য, কী পেয়েছি আমরা সেটা ভাবার চেয়ে ভাবি তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, দোষ খুঁজে বেড়াই তাদের গুণকে উপরে না উঠিয়ে তাদের নিচে নামাতে সর্বদা ব্যস্ত থাকি। খুঁজে বেড়াই কার লেখায় কার ছাপ, কার চেয়ে কে বেশি উন্নত মানের লেখক ইত্যাদি ইত্যাদি। একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কৃপণতা বোধ করি, শ্রদ্ধা করতে কুণ্ঠাবোধ করি। আমরা জানি, ঊষালগ্নেই দিবসের প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ প্রভাতের আকাশ দেখলেই বুঝতে পারি আজকের দিনটি কেমন যাবে। অতএব, একজন মানুষকে ইতিবাচক ধ্যান-ধারণা নিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষ হতে হলে, সাহিত্যিক হতে হলে, সমাজ গড়ার কারিগর হতে হলে তাকে শৈশব থেকেই তৈরি হতে হবে, প্রত্যেকটি শিশুকালকে গুরুত্ব দিতে হবে, দিতে হবে উপযুক্ত পরিবেশ। প্রত্যেকটি শিশু সৃষ্টিশীল হয়ে জন্মায় আর সেই সৃষ্টিশীলতা ধরে রাখতেই তাকে উন্মুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। শৈশবটাকেই যদি গড়তে না পারা যায়, ভালো কিছু ভাবার, শেখার এবং জানা না যায় তাহলে আজকের শিশু কীভাবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হবে, কীভাবে লেখক হয়ে উঠবে। সাহিত্য সাধনের বীজ শৈশব থেকেই মানুষের মধ্যে বিরাজ করে। প্রকৃতিগতভাবেই তার জন্য আলাদা একটি মন তৈরি হয়। চারপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে শৈশব থেকেই একটি মানুষ নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করে লেখক সত্তায়। আর এভাবেই শৈশব থেকে ধীরে ধীরে একজন লেখক তৈরি হয়, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরি হয়। একজন সত্যিকারের সাহিত্যিক বা সৃষ্টিশীল মানুষ হতে হলে তিনি যখন যেভাবে, যে অবস্থায় থাকবেন ঠিক সেই অবস্থাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টিশীল কিছু তৈরি করবেন। ইতিবাচক ধারণা নিয়ে কিছু লিখবেন। সমাজে যা মানুষ নেতিবাচক চোখে দেখে, উপেক্ষা করে এমন কিছু বিষয় বা বস্তু আছে যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইতিবাচক খুঁজে বের করে তুলে ধরতে পারলে তখনই একজন সত্যিকারের লেখকের পরিচয় পাওয়া যায়। একজন লেখক মানে সমাজের একজন পথপ্রদর্শক। অতএব, এমন হতেই পারে যে, একজন লেখকের লেখা পড়ে সমাজের কিছু একগুঁয়ে মানুষও সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে। আমাদের প্রত্যেক মানুষের ভেতরে একটা ঘুমন্ত সত্তা বাস করে সেটাকে জাগ্রত করাই একজন প্রকৃত লেখকের কাজ। আর সেটা করতে হবে তিনি যেখানে যেভাবেই থাকেন না কেন। একজন লেখকের বাধ্যবাধকতা নেই। লেখক ক্রীতদাস নয়। লেখক মানে তিনি স্বাধীন, মুক্ত সৃষ্টিশীল মানুষ। তিনি তার সত্তাকে কখনো বিক্রি করেন না। এ কথাটি একজন লেখক ও পরিবেশের সকল স্তরের মানুষকে বুঝতে হবে। আমাদের এ কথাটিও মনে রাখতে হবে আমরা যাই-ই হই না কেন সবার আগে আমরা সবাই এক একজন এক একটি মানুষ। তাই সবার আগে প্রকৃত মানুষ হতে হবে। তাহলে পৃথিবী সুন্দর হবে, সমাজ সুন্দর হবে, সুন্দর হবে প্রতিটি মানুষের জীবন। (ঢাকা বাতিঘরে বইয়ের ফেরিওয়ালা আয়োজিত ‘আমার জীবন আমার রচনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে কবি মোহাম্মদ রফিকের বক্তব্যের অংশবিশেষ) শ্রুতিলিখন : তুলি আলম

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App