×

সাময়িকী

কবির বেঁচে থাকা মানেই কবিতা লেখা; এর থেকে তাঁর মুক্তি কেবল মৃত্যুতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:৪১ পিএম

কবির বেঁচে থাকা মানেই কবিতা লেখা; এর থেকে তাঁর মুক্তি কেবল মৃত্যুতে
কবির বেঁচে থাকা মানেই কবিতা লেখা; এর থেকে তাঁর মুক্তি কেবল মৃত্যুতে

শেষের কবিতাটি অন্য কবিতা থেকে ভিন্ন তার নামকরণেও; অঙ্কের সংখ্যায় না হয়ে তার নাম দেয়া হয়েছে ‘জীবন, উৎসব’, যেটিতে ওয়াল্ট হুইটম্যানের সং অব মাইসেলফের (Song of Myself) ছাপ পাওয়া যায়; কবি বলেন, ‘না পুরুষ, না নারী, আমি ক্লীব! মৃত্যুর তারিখ, অনির্ধারিত।’ আমৃত্যু অপেক্ষমাণ সেই বহুকালের সত্তাটির যেন মৃত্যু নেই; শরীর থেকে শরীরে তার অনুপ্রবেশ; তবু জীবনের স্বাদ নেবার বাসনা তার ক্ষয়ে যায়নি।

কবি মোহাম্মদ রফিককে নতুনভাবে পরিচয় করানোর প্রয়াস নিয়ে নয়, বরং একজন পাঠক হিসেবে কবি মোহাম্মদ রফিকের ২০১৮ সালের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত আত্মজৈবনিক কাব্যাখ্যান এই স্বপ্ন এই ভোর প্রভাতের আলো কেমন লেগেছে, তা প্রকাশ করার নিমিত্তেই এই লেখা। মোট দু’শো চৌত্রিশটি কবিতা সংবলিত এই বইটির মধ্যে কবিতার আঙ্গিকে নতুনত্ব, কাঠামোগত কিছু প্রচলিত নিয়মের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। আর কবিতাগুলো পড়ার সময় যে দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা অদ্ভুতভাবে দু’টি ভিন্ন, কিন্তু সমান্তরাল অনুভূতির জন্ম দেয়। একদিকে মনে হয় এ যেন এক বহুশতাব্দীর ব্যক্তিমানস; যিনি নিষ্প্রাণ, নিঃস্পৃহ, নিথর, নিঃসাড় হয়ে পৃথিবীকে দেখে দেখে বেড়ে উঠে শেষজীবনে জীবনেরই প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জীবনের রস নিংড়ে নেয়ার অভিব্যক্তি পোষণ করছেন; অপরদিকে তৈরি হয় একেবারে ভিন্ন আরেকটি দৃষ্টিকোণ, যেটাতে কবিতাগুলোর ভেতর দিয়ে দেখা যায় একটি গ্রাম; একটি অজপাড়াগাঁ; যেটি তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াই লড়ে যাচ্ছে; এই ভূখণ্ডেরই কোথাও না কোথাও তার সত্তা প্রকাশের রয়েছে আপ্রাণ চেষ্টা। একেবারে প্রথম থেকেই প্রতিটি কবিতাতেই গ্রাম্যআবহ প্রতীয়মান; প্রাচীন বৃক্ষ, চৌরাস্তার মোড়, খেয়াঘাট, শ্যাওলা ধরা ইটে নুনে খাওয়া বাড়ি, নদী, নাও, কৃষকের চাষবাস, অসুস্থ গরু, ভাঙা কুটিরের দ্বার, প্রদীপের শিখা, টিনের চালের কুঁইকুঁই, পিদিমের আলো- সবমিলিয়ে তৈরি হওয়া সেই গ্রাম সাক্ষ্য দেয় বহু কাহিনীর; তা হতে পারে মানব-মানবীর প্রেম, যাকে কবি বলেন ‘লাইলীও নয়, মজনুও নয়’, তবু এই শ্রেণিবাদী সমাজব্যবস্থায় মৃত্যুই হয় যাদের নিয়তি (১৬ নম্বর কবিতা); হতে পারে দেশপ্রেম; হতে পারে দেশভাগ-পরবর্তী বাঙালি জীবনের অস্থিরতা; হতে পারে সেই কালের সাক্ষী বহুশতাব্দী পুরোনো সত্তার বেঁচে থাকার লোভ, বা কবির নিজের জীবনদর্শন। ‘সময়’ এবং ‘নিয়তি’কে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে সময়ের বহমানতা (বিশেষভাবে ৯৯ ও ১২১ নম্বর কবিতায়) ও নিয়তির অনিবার্যতা (বিশেষভাবে ৯৮ নম্বর কবিতায়) প্রায় প্রতিটি কবিতায়ই আছে; যার সাথে সাথে চলছে বহুশতাব্দীর সেই সত্তাটি যে চেয়ে চেয়ে দেখছে সেই গ্রামটিকে, সেই দেশটিকে, তার মানব-মানবীগুলোকে, প্রকৃতিকে; আর তারই সাথে চলছে লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই, জীবনের স্বাদ গ্রহণের লড়াই, নিয়তির সাথে লড়াই। যদিও প্রাথমিকভাবে কবিতাগুলোতে নিয়তিনির্ভর জীবনের প্রতি এক ধরনের নিরাসক্তি অনুভূত হয়, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে কবির নিজ জীবনদর্শন, কবির সৃষ্ট বহুকালের সাক্ষী সেই বহুশতাব্দী পুরোনো ব্যক্তিমানসের বেঁচে থাকার অদম্য কৌতূহল এবং সেই ছোট্ট গাঁয়ের টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্যেই প্রকাশ পায় যে, মানুষ বাঁচতে চায়, বেঁচে থাকার আনন্দ নিতে চায়। লেখার শুরুতেই বইটির আঙ্গিকের নতুনত্ব নিয়ে যা বলছিলাম তার একটু উদাহরণ না দিলেই নয়; প্রত্যেকটি কবিতার আলাদা আলাদা নামকরণ না করে কবি অঙ্কের সংখ্যায় কবিতাগুলোকে সাজিয়েছেন। ৩৮ ও ৭৯ নম্বর কবিতা দু’টি অন্য কবিতাগুলো থেকে আয়তনে অনেক দীর্ঘ হওয়ার কারণে কবি এই দুটি কবিতার স্তবকবিন্যাসে বাংলা স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার করেছেন, যা বেশ বৈচিত্র্যময়; যেমন, একটি স্তবকের শিরোনাম ‘ড’ আর তার ঠিক পরেরটি ‘ঢ’ না হয়ে হয়েছে ‘ড়’; তার পরেরটি ‘ঢ’, এবং তারপরেরটি আবার ‘ঢ়’। যদিও আধুনিক কবিতায় শৃঙ্খলিত কোনো নিয়ম নেই, তবুও বাঙালি পাঠকরা কবিতা পড়ার সময় মনে মনে যেন তার একটি নাম খোঁজে। তাই নতুনত্ব বা বৈচিত্র্যের বিষয় বিবেচনায় রেখেও একজন পাঠক হিসেবে বোধকরি, যে কবিতাগুলো অন্য কবিতা থেকে বেশি হৃদয়গ্রাহী, সেগুলোর অঙ্কের সংখ্যার চাইতে কবির দেয়া কোনো নামই হয়তো পাঠকের কাছে বেশি কাম্য হতো।

এবার আসা যাক কবিতার কিছু বিষয়ভিত্তিক আলোচনায়। প্রথম কবিতার প্রাচীন বৃক্ষটি যেন ইংরেজ কবি জন কিটসের Ode on a Grecian Urn (ওড অন এ গ্রেসিয়ান আর্ন) এর সেই ঝুষাধহ Sylvan Historian (সিলভান হিসটোরিয়ান) পাত্রটির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে; তবে পার্থক্য তার আছে নির্লিপ্ততায় ‘সে দেখে, দেখে না; বলে, বলে না।’ আয়তনে বেশ দীর্ঘ ৭৯ নম্বর কবিতাটি কবির দেশপ্রেম ও দেশভাবনা নিয়ে লেখা, যেটি পড়লে আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ১৩৭ নম্বর কবিতায় পাই সেই কালের সাক্ষীকে, যার চলছে নিরন্তর বেঁচে থাকার লড়াই। কবি বলেন, ‘মৃত্যুই হলো না কোনোকালে, হবে না জেনেও আমি মরি।’ ১৫৪ নম্বর কবিতাটি যেন বাকি কবিতাগুলো থেকে একটু আলাদা, হয়তোবা একটু সুতো কেটে যাওয়া; হঠাৎই ব্যক্তিকবির অনুপ্রবেশ, যেখানে সেই বহুশতাব্দীর ব্যক্তিমানসের সাথে কবিমানসের সাক্ষাৎ। কবি বলে ওঠেন, ‘কাব্যিক বিকার কবির না কবিতার’। শেষের কবিতাটি অন্য কবিতা থেকে ভিন্ন তার নামকরণেও; অঙ্কের সংখ্যায় না হয়ে তার নাম দেয়া হয়েছে ‘জীবন, উৎসব’, যেটিতে ওয়াল্ট হুইটম্যানের সং অব মাইসেলফের (Song of Myself) ছাপ পাওয়া যায়; কবি বলেন, ‘না পুরুষ, না নারী, আমি ক্লীব! মৃত্যুর তারিখ, অনির্ধারিত।’ আমৃত্যু অপেক্ষমাণ সেই বহুকালের সত্তাটির যেন মৃত্যু নেই; শরীর থেকে শরীরে তার অনুপ্রবেশ; তবু জীবনের স্বাদ নেবার বাসনা তার ক্ষয়ে যায়নি। কবি শেষ করেন, ‘আমি মুক্ত, আমি কবি নই, আমি কবিতা লিখি না’ পাঠক জেনে যায়- কবিজীবন কেবল ব্যক্তিক বা পারিবারিক বা সামাজিক নয়; তা রাষ্ট্রিক, জাগতিক, মহাজাগতিকও; কবির বেঁচে থাকা মানেই কবিতা লেখা; এর থেকে তাঁর মুক্তি কেবল মৃত্যুতে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App