×

মুক্তচিন্তা

বোরো-ইরির পর আমনের মূল্য নিয়ে সংশয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৩৪ পিএম

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফলন-পূর্ববর্তী সরকারের নীতি-সহায়তা আগের তুলনায় ভালো। সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের জোগান কৃষকরা সময়মতো পাচ্ছেন। সেচের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেল পেতেও অসুবিধা হচ্ছে না। মূল সমস্যা হচ্ছে ধানের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তি নিয়ে। এ ক্ষেত্রেও সরকারের উদ্যোগ আছে, কিন্তু তার সুফল পাচ্ছেন না কৃষক। বিলম্বিত সিদ্ধান্ত, অপর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সংরক্ষণ সমস্যা এই বিফলতার প্রধান কারণ। এটি উতরাতে হবে।

খুব বেশি বিস্মৃতিপ্রবণ না হলে ভুলে যাওয়ার কথা নয় মাস পাঁচ-ছয়েক আগে বোরো-ইরির ফলন ঘরে তোলা নিয়ে কী রকম তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল দেশে। উৎপাদিত ধানের মূল্য অস্বাভাবিক হ্রাস পেয়েছিল, সেই তুলনায় বেড়ে গিয়েছিল শ্রমিকের মজুরি। লাভজনক বিবেচিত হচ্ছিল না বলে ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই ফেলে রাখার উপক্রম হয়েছিল কৃষকের। কৃষক সমাজের এই দুর্দশায় একাত্মবোধ করেছিল গোটা জাতি। সংবাদমাধ্যমেরও যথেষ্ট সহানুভূতি কুড়িয়েছিল ঘটনার গভীরতা। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন হেরফের হয়নি। কৃষক তার ধানের উপযুক্ত মূল্য পাননি। সরকারের দেয়া বিলম্বিত সুবিধা পকেটে গেছে দালাল-ফড়িয়াদের। সামনে আমন ধান গোলায় ওঠার বেলায় পরিস্থিতি ভিন্নতর হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য সরকার যদি দ্রুত কৃষককল্যাণমুখী পদক্ষেপ নেয় তাহলে আমার এই ধারণা অমূলকও হতে পারে।

মাসখানেকের ভেতর আমন ধান ঘরে উঠতে শুরু করবে। বিনা-৭ জাতের একটি আগাম ফলনের ধান ইতোমধ্যে ঘরে উঠতে শুরুও করেছে। কিন্তু তার দাম আশানুরূপ নয়, বিগত বছরের অনুরূপ প্রায়। ধান ব্যবসায়ীরাও ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন আশার বাণী শোনাচ্ছেন না। এ অবস্থায় ভালো ফলনও কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না, তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভর মৌসুমের দাম নিয়ে। এটি ঘরে বসে অনুমান করে বলা কোনো কথা নয়, গেল কয়েকদিন গ্রামের কিছু এলাকায় কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তাদের এই দুশ্চিন্তার কথা জেনেছি। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সবাই এক সুরে বলছেন- দেশে উৎপাদিত সব পণ্যের উপযুক্ত মূল্য আছে, মূল্য নেই কেবল ধানের।

আমন ধানের ফলন এ বছর বলতে গেলে সারাদেশেই ভালো হয়েছে। সুযোগ যারা নেবেন তারা এই ভালোর খবর ভালোমতোই রাখেন, তাদের জন্য এবার আরো উত্তম প্রেক্ষাপট তৈরি হলো কৃষক ঠকানোর। কৃষকদের একটা বড় অংশ ক্ষেতের ধান ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন ধারদেনা মেটানোর জন্য। ফড়িয়ারা এই সুযোগটি নেন একজোট হয়ে, কৃষকদের অসহায়ত্ব পুঁজি করে তারা কমমূল্যে ধান কেনেন। সরকার পারে এর পরিত্রাণ ঘটাতে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফলন-পূর্ববর্তী সরকারের নীতি-সহায়তা আগের তুলনায় ভালো। সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের জোগান কৃষকরা সময়মতো পাচ্ছেন। সেচের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেল পেতেও অসুবিধা হচ্ছে না। মূল সমস্যা হচ্ছে ধানের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তি নিয়ে। এ ক্ষেত্রেও সরকারের উদ্যোগ আছে, কিন্তু তার সুফল পাচ্ছেন না কৃষক। বিলম্বিত সিদ্ধান্ত, অপর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সংরক্ষণ সমস্যা এই বিফলতার প্রধান কারণ। এটি উতরাতে হবে।

এই উতরানোর ব্যাপারটি যে খুব কঠিন তা নয়। যে সিদ্ধান্তের কথা বলছিলাম তা হলো ফলন ঘরে ওঠার যথেষ্ট আগে ধানের মূল্য কী হবে তা পর্যালোচনা করে জানানো এবং সময়মতো সরকারি ক্রয় কার্যক্রম শুরু করা। এর ব্যত্যয়ের কারণে প্রতি বছর সমস্যা হচ্ছে, প্রতিবিধান না করলে ভবিষ্যতেও হবে নিশ্চিত। বোঝাই যাচ্ছে এ সমস্যা কঠিন কিছু নয়। দরকার শুধু কিছুটা সতর্কতার। পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রসঙ্গে বলতে হয়, দেশের সক্ষমতা এখন আর আগের পর্যায়ে নেই, বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহারও করতে পারছে না, ফেরত যাচ্ছে সরকারি কোষাগারে। বরাদ্দের এত ছড়াছড়ির ভেতর কৃষি খাতে বরাদ্দ নিয়ে কার্পণ্য কেন? ভুলে গেলে চলবে না ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র এ দেশে ভাত-মাছ দুটিরই পর্যাপ্ত জোগান দিচ্ছে এই কৃষক সমাজ। তাতে শত সমস্যার ভেতরও দেশ ঠাণ্ডা আছে। গরিব মানুষও তিনবেলা খেতে পারছে। কাজেই কৃষকের সমস্যাকে হালকা করে দেখা তো নয়ই, বরং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখতে হবে। বরাদ্দ বাড়াতে হবে ধানের সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে এবং তা হতে হবে সময়মতো। সুবিধা যাতে প্রকৃত কৃষক পান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে সংরক্ষণ সুবিধা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক গুদাম নির্মাণ জরুরি হবে।

দুই. সময়ের বিবর্তনে সমাজে নানা রকম পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন ঘটছে গ্রামীণ সমাজেও। কৃষির শনৈ শনৈ উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমস্যাও। এর একটি হলো কৃষি শ্রমিকের সংকট। শিক্ষার যত প্রসার ঘটছে, যত বাড়ছে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ, তত বৃদ্ধি পাচ্ছে কৃষি শ্রমিকের সংকট। এই সংকট মোকাবেলার প্রধান অবলম্বন হচ্ছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। সেটি শুরুও হয়েছে। হাল-চাষ বলতে গেলে উঠেই গেছে, প্রতিস্থাপক হয়েছে ট্রাক্টর। মাড়াইও সমস্যা নয়, স্থানীয়ভাবে তৈরি কম মূল্যের মাড়াই কল দ্বারা কাজ চালানো হচ্ছে, গরু-মহিষের ব্যবহার উঠে গেছে এ কাজে।

সমস্যা এখন রোপণ, বুনন ও কর্তনের। এ সমস্যা অপনোদনের উপযোগী বিভিন্ন যন্ত্র ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। হারভেস্টর বলা হচ্ছে এগুলোকে। সমতলভূমিতে এসবের ব্যবহারে কোনোরকম সমস্যা দেখছি না। সমস্যা হলে হতে পারে হাওর অঞ্চলে। হাওরের ফসল কাটতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় কৃষকদের। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেখানকার ফসল কাটতে হয়। বাতাসে ধানের গোছা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সমস্যা আরো প্রকট হয়। আমি জানি না ওই বিরূপ পরিবেশেও হারভেস্টর কার্যকর কিনা, না হলেও একে উপযোগী করা কঠিন হবে না বলে মনে করি।

সমস্যা হারভেস্টরের চড়ামূল্যের। আমাদের দেশে শক্ত আর্থিক বুনিয়াদসম্পন্ন কৃষকের সংখ্যা নগণ্য। তা ছাড়া অধিক জমির মালিক যারা তাদের অধিকাংশ এখন আর নিজের তত্ত্বাবধানে চাষাবাদ করেন না, বর্গা বা লিজ দিয়ে দেন; উৎপাদনের হিস্যাস্বরূপ যৎকিঞ্চিৎ যা পান তাতেই তুষ্ট থাকেন। তারা আয়ের অন্য উৎসও খুঁজে নিয়েছেন। প্রকৃত কৃষক যারা তাদের পক্ষে চড়া দামের হারভেস্টর কেনা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার সরকারের। দেশের সর্বত্র হারভেস্টরের জোগান বাড়ানোর কর্মকৌশল নির্ধারণ একান্ত আবশ্যক। গ্রামের যুবসমাজের একাংশ ট্রাক্টরকেন্দ্রিক ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে, চুক্তিভিত্তিক জমি চাষের কাজ করে যাচ্ছে তারা। তেমনি হারভেস্টর হতে পারে গ্রামের যুবাদের আয়ের নতুন উৎস। যন্ত্রটির দাম যেহেতু বেশি সেহেতু অর্থনৈতিক সহযোগিতা দরকার। উপরোক্ত কর্মকৌশলের অংশ হতে পারে এ বিষয়ক ভাবনা। মোদ্দা কথা, ধান চাষ কৃষকের জন্য লাভজনক রাখতে হবে। সরকারের নিখুঁত ক্রয় কার্যক্রমের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রচলন দ্বারা খরচ কমিয়ে যুক্তিসঙ্গত লাভ নিশ্চিত করা গেলে কৃষকসমাজ উপকৃত ও উৎসাহিত হবে।

মজিবর রহমান: লেখক ও ব্যাংকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App