জিপি-রবিকে ছাড় নয়
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১১:০১ এএম
দেশের শীর্ষ দুই মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোন (জিপি) ও রবির কাছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির পাওনা আদায়ে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। সমঝোতার উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ায় আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি জানান, দুই কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতিটি টাকা আদায়ের পরই তারা ফেরত আসবেন।
বিটিআরসির দাবি অনুযায়ী, জিপির কাছে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের। যদিও টাকার এ পরিমাণ নিয়ে আপত্তি রয়েছে অপারেটরদের। এ নিয়ে জিপির একটি মামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার পাওনা আদায়ে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
এদিকে সরকারের সঙ্গে বড় দুই অপারেটরের এ দূরত্বে দেশের টেলিকম খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কেউ কেউ বলছেন, শেয়ারবাজার ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এটি একটি খারাপ বার্তা দিবে। তবে মোস্তাফা জব্বার বলছেন, এর মাধ্যমে একটি সংকেত পৌঁছে দিতে চায় সরকার। এ টাকা মূলত জনগণের টাকা। যত বড় বা প্রভাবশালী কোম্পানিই হোক, জনগণের পাওনা পরিশোধ না করে পার পাবে না।
জিপি ও রবির সঙ্গে পাওনা নিয়ে বিটিআরসির বিরোধ অনেক দিনের। ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত অডিট আপত্তি অনুযায়ী ওই টাকা পাওনা রয়েছে বলে দাবি বিটিআরসির। পাওনা টাকা আদায়ে চাপ সৃষ্টি করতে গত ৪ জুলাই জিপি ও রবির ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দিয়েছিল বিটিআরসি। ১৩ দিনের মাথায় সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এরপর ২২ জুলাই থেকে গ্রামীণ ও রবির নতুন কোনো সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র দেয়া বন্ধ করে বিটিআরসি। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় গত ৫ সেপ্টেম্বর অপারেটর দুটির লাইসেন্স বাতিলের জন্য নোটিস পাঠানো হয়। এদিকে বিটিআরসির এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যায় অপারেটর দুটি।
এমন পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মধ্যস্থতায় সব পক্ষকে নিয়ে সম্প্রতি কয়েকটি বৈঠক হয়। তাতে জিপি ও রবি কয়েক দফায় টাকা পরিশোধে সম্মত হয়। কিন্তু পরে আর সে অনুযায়ী কাজ না করায় গত মঙ্গলবার দুই অপারেটরে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। এখন বিটিআরসি প্রশাসক নিয়োগের চিঠি ইস্যু করলেই প্রশাসকরা জিপি ও রবির কার্যালয়ে কাজ শুরু করতে পারবেন। তবে আদালতের সিদ্ধান্তও এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, জিপি আর রবি তো কথা রাখেনি। আমরা তাদের ৭ দিন সময় দিয়েছিলাম। প্রথম দফায় জিপির দেয়ার কথা ছিল ১০০ কোটি, আর রবির ২৫ কোটি। কিন্তু দেখা গেল, রবি মাত্র ১৫ কোটি টাকা নিয়ে আসল। আর জিপিতো কোনো যোগাযোগই করেনি। এ অবস্থায় সরকার ‘কাহাতক’ (কতক্ষণ) অপেক্ষা করবে। এর আগেই আমরা তাদের বলেছি, আমাদের টোকেন একটা টাকা দাও, যাতে বুঝতে পারি তোমরা টাকা দিতে ইচ্ছুক। এই ইচ্ছা প্রকাশের জায়গাতেও ওরা আসেনি। এখন যদি আমরা ব্যবস্থা না নেই তবে টাকা আদায় করব কীভাবে। এখন হিসাব করে দেখতে হবে তারা কত টাকা মুনাফা করেছে আর কত টাকা এ দেশ থেকে নিয়ে গেছে।
মন্ত্রী বলেন, প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। তাই টাকা আদায় আমাদের করতেই হবে। টাকা আদায় হয়ে গেলে একদিনও প্রশাসক সেখানে থাকবে না। তিনি আরো বলেন, অপারেটরদের মধ্যে একটা প্রবণতা কাজ করছে। তারা মনে করে, আমাদের সিদ্ধান্তগুলো আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে ৫ বছর ঝুলিয়ে রাখবে। কিন্তু আমি শুধু এটুকুই বলব, ২০১২ সালে তারা এ রকম করেছে। এখন আর সে সময় নেই। এটা ২০১৯ সাল। আমার ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নাই।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্র অনুযায়ী, বাজার মূলধনের ১২ শতাংশ বা প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে গ্রামীণফোনের। তাই জিপির লাইসেন্স বাতিল বা প্রশাসক নিয়োগের খবরে এ কোম্পানির শেয়ারের দরপতন ঘটছে। গতকালও এ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এটা শেয়ারবাজারের জন্য খুবই খারাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটা সমঝোতার দিকে যাচ্ছিল। সে সময় শেয়ার মার্কেট কিছুটা উপরে উঠেছিল। এখন যে নতুন করে আবার প্রশাসক নিয়োগের কথা বলছে এতে করে বাজার আবার নিম্নধারায় প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, আমি জানি না কেন একসঙ্গে একটা আপসে যেতে পারছে না দুই পক্ষ। যেখানে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর স্বার্থ জড়িত।
তিনি বলেন, আশা করি এটা সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসা হবে। মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকার জন্য দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আসলে কি বার্তা দিচ্ছি- এটা আমাদের ভেবে দেখা উচিত। এই টাকার জন্য আমরা এর ১০ গুণ বেশি টাকার ক্ষতি করে ফেলছি কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ অবশ্য মনে করেন এ ঘটনা শেয়ার মার্কেটে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, শেয়ার মার্কেট তো নেই বললেই চলে। সেখানে এখন বড় কোনো সমস্যা হলেও প্রভাব পড়বে না। শেয়ার মার্কেট ধস নামার কারণ তো ভিন্ন। একের পর এক পড়ছে। এখন এই কোম্পানি দুটির জন্য পড়বে। তবে কোম্পানি দুটির সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব সমঝোতার বিষয়। এ ধরনের সমস্যায় কোম্পানি তো আর দেশ ছেড়ে চলে যাবে না।
মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের সঙ্গে এসব দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহক। যেখানে সেবার মান নিয়ে সংকট রয়ে গেছে, সেখানে সেগুলো নিশ্চিতে মনোযোগী হতে পারছে না সরকার। বরং টাকা আদায় নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাদের।