×

বিনোদন

আমাদের সম্পর্কটা ছিল চার দশকের : ফোয়াদ নাসের বাবু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১১:৩৯ এএম

আমাদের সম্পর্কটা ছিল চার দশকের : ফোয়াদ নাসের বাবু
সর্বশেষ যে কনসার্টে গান করেছিল তখন মানুষটার হার্টের মাত্র ২৫ শতাংশ কার্যকর তবুও সে মঞ্চে উঠল গিটার হাতে। শরীরে ক্লান্তি থাকলেও গিটারের তারে স্পর্শ করতেই ভিতের অদ্ভুত প্রাণশক্তি এলো। মঞ্চের সামনের হাজারো জনতা তার মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা। কী অসীম তার জীবনীশক্তি! কেউ কি কল্পনা করতে পারবেন? মানুষটাকে আপনারা চিনেন আইয়ুব বাচ্চু নামে। আমার কাছে সে ‘ব্যাককাস’ গ্রিক পুরাণের এক দেবতা। তার কাছে আমি ছিলাম ‘বব’। বাচ্চুর মৃত্যুর পরে তার হার্টের এত বড় সমস্যার কথা ডাক্তারদের কাছে শুনেছিলাম। তারা মানা করেছিলেন। শুনেনি। শোনার রেকর্ড আছে বলে জানি না। মৃত্যুর তিন বছর আগেও একবার অসুস্থ হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তখন সোনারগাঁও হোটেলে শো ছিল। সে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে শো টা সে করবে। সোনারগাঁওয়ের জিএম এসে যখন তাকে জানায় তারা বিকল্প শিল্পীর ব্যবস্থা করেছে, তখন সে শান্ত হয়। এ ছিল আমাদের প্রিয় বাচ্চুর ‘কমিটমেন্ট’। কথা দিয়েছি মানে শো হবে। ঝড়, তুফান, বৃষ্টি কোনো সমস্যা না। এটা তো কোনো সাধারণ মানুষ পারবে না। সেই মাফের, সেরকম উচ্চতার না হলে পারবে না। যার রক্তে বহমান শিল্পের সত্তা। যার কাছে জাগতিক চাওয়া পাওয়ার চেয়ে বড় থাকে সৃষ্টির নেশা। যে কোনো শৃঙ্খলা মানে না। মুক্ত বিহঙ্গের মতো সে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখায়। ‘ফিডব্যাক’ থেকে তখন আমরা আমাদের প্রথম অ্যালবাম বের করেছি। শো করতে প্রায় চট্টগ্রাম যাই। বাচ্চু তখন ‘সোলস’র হয়ে বাজায়। শোয়ের ফাঁকে ফাঁকে তার সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। সে থেকে শুরু। এক সময় সে ঢাকায় এলো। সত্যি কথা বলতে কী আমরা যারা ঢাকায় বড় হয়েছি, বাড়ি আছে তাদের জন্য রক সঙ্গীত করাটা কিছুটা হলেও সহজ ছিল। কিন্তু আমি ওর সংগ্রাম দেখেছি। চট্টগ্রাম থেকে এসে কীভাবে ঢাকায় সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাকরি মতো করে তখন তারা (এলআরবি) প্রতিদিন প্র্যাকটিস করত। ঢাকায় তো তখন প্র্যাকটিস প্যাড বলতে সারগাম, শ্রুতি, আলভিস, জিপসা, উইন্ডো। শো থাকবে মানে সারাদিন প্র্যাকটিস করে রাতে তাতে অংশ নেয়া। এর ফলও তারা পেয়েছে। একটা সময় ওদের দলে কি-বোর্ডিস্টের অভাব পড়ে। ফলে ও গিটারে জোর দেয়। গিটারের সুরনির্ভর গান করতে থাকল। আমরা যারা ব্যান্ড গান করি তারা জানি কি-বোর্ড ছাড়া গান করা কতটা কষ্টসাধ্য। সে তো দেশের গিটারের কিংবদন্তি হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত নব্বইয়ের পরে যারাই গিটার শিখেছে তারা সবাই তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। ওর সঙ্গে অনেক শোতে বাজিয়েছি। সবশেষ ওর সঙ্গে বাজিয়েছি ‘সাউন্ড অব সাইলেন্সে’র ঢাকা ও চট্টগ্রামের শোতে। সম্পর্কের শুরু থেকেই রক গান নিয়ে ওর সঙ্গে আমার তর্ক-বিতর্ক হতো। তবে আমাদের সঙ্গীত ভাবনা এক ছিল বলে সম্পর্কটা হয়েছে। অসম্ভব মা ভক্ত একটা ছেলে ছিল বাচ্চু। উনার মৃত্যুর পর সে অনেক বেশি পরিমাণে ভেঙে পড়ে। প্রায়ই শুনেছি, বাচ্চু কই? ও তো চট্টগ্রাম। মায়ের কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকত। রাতে গিয়ে আবার সকালে চলে আসত। এ রকম মাতৃভক্তির কারণেই বা হয়তো সে ‘আম্মাজান আমার আম্মাজান’ গানটা গাইতে পেরেছিল। সম্ভবত তার প্রথম সিনেমা প্লে-ব্যাক ‘সাগরিকা’। ওই গানের রেকর্ডিংয়ের সময় আমি বাজিয়েছিলাম। আমি তখন আলাউদ্দিন ভাইয়ের সহকারী। শুনেছি একটা সময় ও নাকি সিনেমায় গান করা ছেড়ে দিয়েছিল। কারণটা অবশ্য তাকে কখনই জিজ্ঞেস করা হয়নি। খুব চাপা স্বভাবের ছিল। কাছের মানুষের কষ্ট সে নিতে পারত না। দ্রুতই অভিমান করত, আবার নিজ থেকে এসে কথা বলত। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার সঙ্গে কখনই তার এমন কিছু হয়নি। অথচ আমাদের সম্পর্কটা ছিল চার দশকের। আমি তাকে ভালোবাসতাম আর সে আমাকে শ্রদ্ধা করত। আরেকটা ব্যাপার ছিল শুরুর দিকে আমরা এক ব্যান্ড আরেক ব্যান্ড দলকে বাদ্যযন্ত্র, প্র্যাকটিস প্যাডসহ নানাভাবে সহায়তা করেছি। যা এখনকার দলগুলোর মাঝে দেখা যায় না। দোষ-গুণ মিলেই একটা মানুষ। আমার চোখে তার কোনো দোষ কখনই ধরা পড়েনি। মৃত্যুর পরে তো সবাই শুনেছেন তার মহানুভবতার কথা। কিন্তু সে কখনই চাইত না কাউকে সাহায্য করে তা সবাইকে জানাতে। মানুষ কত বিচিত্র হয়, তাই না! তাকে নিয়ে দুটা দুঃখবোধ নিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। মৃত্যুর ছয় মাস আগে তাকে আমি একটা গানের সুর পাঠাই। সে বলেছিল, বব ঠিক আছে। দেখা যাক। গানটা হলে সেটা হতো তার সঙ্গে আমার প্রথম গান। ‘ফিডব্যাক’র ত্রিশ বছর পূর্তি অ্যালবামে আমাদের ‘চিঠি’ গানটি ও নতুন করে গাওয়ার কথা ছিল। পরে তো অ্যালবামটিই হলো না। আমাদের সম্পর্কটা অনেক আত্মিক ছিল, তাই আমার সুরে গান করা না করা নিয়ে কখনো কোনো কিছু মাথায় আসেনি। এখন অবশ্য আফসোস হয়, কেন তার সঙ্গে একটা গান করলাম না। আরেকটা বড় আফসোস, রংপুরের শোটা নিয়ে। আমার একটা জিজ্ঞাসা, অসুস্থ জেনে তার কাছের মানুষরা কেন তাকে গাইতে দিল? কনসার্টটি শেষে বিমানেই নাকি সে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাধা ফেলে হয়তো সে রুপালি গিটার ফেলে এত তাড়াতাড়ি চলে যেত না। হাসতে দেখতাম, গাইতে দেখতাম আরো কয়েকটা বছর। আফসোস!  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App