×

সাময়িকী

মানবমুক্তির মহান দার্শনিক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:১৬ পিএম

মানবমুক্তির মহান দার্শনিক

লালনের আখড়া, যেখানে তাঁর সমাধি অবস্থিত

ফকির লালন সাঁই’র পরিচয় প্রকাশে ভূমিকার প্রয়োজন হয় না। ‘লালন’ নামটির মধ্যেই তাঁর পরিচয়। তিনি বাউল। যদিও এই পরিচয় তাঁর যথার্থ পরিচয় নয়, বরং তাঁকে একপেশে করে রাখবার একটা চেষ্টামাত্র- এমন মত অনেক গবেষকের। বাউল বাউল বলে তাঁকে একটা সম্প্রদায়ভুক্ত করে রাখবার জোর চেষ্টা চললেও এই শ্রেণির গবেষকরা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন, যে অর্থে ‘বাউল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, সেই অর্থে তিনি বাউল ছিলেন না। বরং তাঁর সামাজিক অবস্থান, সাংসারিক দায়িত্ববোধ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন এবং সমাজে তাঁর ব্যক্তিপ্রভাব তাঁকে একজন প্রভাবশালী প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লালন সাঁইজী ব্যক্তিজীবনে ঘোড়ায় চলাফেরা করতেন। তাঁর দুটি তেজি ঘোড়া ছিল। ‘বাউল’ শব্দটি দিয়ে যা বোঝায় বা ‘বাউল’ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, তাতে কোনো বাউলের ঘোড়া থাকা তো দূরের কথা, এমনকি ঘোড়ায় চড়ার নজিরও মেলা ভার। এ প্রসঙ্গে লালন গবেষক মো. সোলায়মান আলী সরকার তার ‘লালন শাহের মরমী দর্শন’ গ্রন্থে বলেছেন- ‘যিনি ঘোড়ায় চড়ে দেশ-বিদেশে ধর্ম প্রচার করেন, তিনি বাউল নন। বাউলরা একতারা হাতে পায়ে হেঁটে গান গেয়ে বেড়ান। দীর্ঘকাল অনুসন্ধান করেও কোনো বাউলকে ঘোড়ায় চড়ে ধর্ম প্রচার করতে দেখা যায়নি’ [পৃঃ-৫]। লালন গবেষণার প্রথম দলিল হিসেবে খ্যাত রাইচরণ দাস (মতান্তরে রাইচরণ বিশ্বাস) কর্তৃক কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ শিরোনামের লিখিত নিবন্ধে শুধু লালনকে নয়, লালন অনুসারীদেরও বাউল সম্প্রদায় থেকে আলাদা বলে অভিহিত করা হয়েছে। গবেষক তপন কুমার বিশ্বাস তার ‘লোককবি লালন’ নিবন্ধে লিখেছেন- ‘সাধুসেবা হইতে লালনের শিষ্যগণের না হউক, নিজের মতবিশ্বাস অনেকাংশেই ভিন্ন ছিল। সাধুসেবা ও বাউলের দলে যে কলঙ্ক দেখিতে পাই, লালনের সম্প্রদায়ে সে প্রকার কিছু নাই’ [পৃঃ-১৩৬]। তপন কুমার বিশ্বাসের মতে- ‘মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথের মতো লালন শাহও কবি, ভাববাদী লোককবি’ [ঐ, পৃঃ-১]। ড. আবুল আহসান চৌধুরী তার ‘লালন সাঁই : প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ’ গ্রন্থে লালনকে ‘সমাজমনস্ক সাধক কবি’ বলে অভিহিত করেছেন। সনৎ কুমার মিত্র সম্পাদিত ‘বাউল লালন রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে সংকলিত ‘গ্রাম্য সাহিত্য’ প্রবন্ধে সুবোধচন্দ্রের ভাষায় দেখতে পাই- ‘লালন ফকির নাম শুনিয়াই হয়তো অনেকে মনে করিতে পারেন ইনি বিষয়হীন ফকির ছিলেন; বস্তুত তাহা নহে; ইনি সংসারী ছিলেন, সামান্য জোতজমা আছে; বাটিঘরও মন্দ নহে। জিনিসপত্র মধ্যবর্তী গৃহস্থের মতো, নগদ টাকা প্রায় ২ হাজার রাখিয়া মারা যান’ [পৃঃ-১০২]। আবার বিপরীতক্রমে লালনের গান, তাঁর সাধনা, দর্শন- এসবে তাঁকে বাউল ধরে নেয়াই সঙ্গত বলে মনে করেন অনেক গবেষক। ব্যক্তিগতভাবে আমার মত হলো- ফকির লালন সাঁই ব্যক্তিজীবনে কতো সম্পত্তির মালিক ছিলেন, ঘোড়ায় চড়তেন কি চড়তেন না, সংসারী ছিলেন কি ছিলেন না, মৃত্যুকালে কী পরিমাণ অর্থসম্পদ রেখে গেছেন- এগুলোর চাইতে অধিক মূল্যবান হলো তাঁর দর্শন, তাঁর সমাজচিন্তা, তাঁর সাম্যচিন্তা। তিনি নিঃসন্দেহে বাউল ছিলেন। তবে হয়তো অন্যসব বাউলের মতো তিনি সংসারবৈরাগী হননি। সাধুসেবা বা বাউলের কলঙ্কতিলক তিনি কপালে চড়াননি। এতে তাঁর বাউল সাধক পরিচয় ঘুচিয়ে দেয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। ফকির লালন নিজের বাউল পরিচয় নিজেই দিয়ে গেছেন তাঁর গানে। বাউল ধর্মে গুরুআশ্রয় বড় গুরুত্বের বিষয়। গুরু ধরে, গুরু আরাধনা করেই বাউলরা সিদ্ধিলাভের পথে চলতে চান। সাঁইজীর গানে- ‘গুরু বিনে কী ধন আছে কী ধন খুঁজিস ক্ষ্যাপা কার কাছে। বিষয়-ধনের ভরসা নাই ধন বলতে ধন গুরু গোঁসাই যে-ধনে দিয়ে দোহাই ভব তুফান যাবে বেঁচে...।’ যাই হোক, এ বিতর্ক নিয়ে আর আগ বাড়াতে চাই নে। এই লেখায় যে বিষয়টি আলোকপাত করার জন্য প্রয়াসী হতে চাই, তা হলো লালন সাঁই’র সাম্যবাদী দর্শন। যা তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন নারী-পুরুষে, ধনী-দরিদ্রে, হিন্দু-মুসলমানে। ধর্মের চাইতেও মানুষ পরিচয়কেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তাঁর গানে এই সাম্যবাদী চিন্তা নিয়ে নিশ্চয়ই বিতর্কের অবকাশ নেই। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, বাংলা মুলুকে সৃষ্টিশীল যতো প্রাণ আছে, লালন তার মধ্যে অন্যতম। কেবল অন্যতম মাত্রই নয়, বরং বলা যায়, তাঁর সৃষ্টি সর্বাধিকজনের এবং সাধারণের কান ও প্রাণের কাছে অধিক পৌঁছেছে। বলা চলে, তিনি গণমানুষের গীতিকবি। সাঁইজী’র গানে বহুল ব্যবহৃত ‘সহজ’ শব্দের মতোই তিনি শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কার ও রস সহজ সাধারণভাবে প্রয়োগ করতেন এবং তাতে করে তিনি সহজেই পৌঁছে গেছেন বাংলার মাটি ও মানুষের প্রাণের কাছে। যদিও ব্যক্তি লালন ও তাঁর ভাব ছিল অসাধারণ ও বেশ খানিকটা রহস্যময়। বিশেষত তাঁর বাণী-নিঃসৃতভাবে ছিল আধ্যাত্ম, ভাবালুতা, দ্বৈততা ও দুর্বোধ্য অস্পষ্টতা। তা সত্ত্বেও লালন হয়ে উঠেছেন বাংলার মানুষ, মাটি, জল, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও দর্শনের প্রতিশব্দ ও সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানের স্রষ্টা। ফকির লালন সাঁই’র ধর্মীয় পরিচয় খুঁজতে গিয়ে গবেষকরাও বিভ্রান্ত হয়েছেন। কারণ লালন নিজে তাঁর পরিচয় কখনো প্রকাশ করেননি। বরং তিনি তাঁর গানে নিজেকে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ‘মানুষ লালন’ রূপে তুলে ধরেছেন এবং সাথে সাথে হিন্দু-মুসলিম জাতভেদকে তীব্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। লালনের জন্ম আর জীবনযাপন সম্পর্কে এতো বিচিত্র তথ্য পাওয়া যায় যে তার মধ্য থেকে আসল তথ্য উদঘাটন করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অনেকে বলেন, লালন ১১৬ বছর জীবিত ছিলেন। কেউবা বলেন ১০৬ বছর। লালনের জাত সম্পর্কে কেউ বলেন, তিনি কায়স্থ বর্ণীয় হিন্দু ছিলেন, কেউ বলেন তিনি মুসলমান ছিলেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ফকির লালন সাঁইজী মৃত্যুবরণ করার পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক ‘হিতকরী’র ৩১ অক্টোবর সংখ্যায় লালনের মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছিল এবং তার সাথে যে নিবন্ধ [লেখক অজ্ঞাত] ছাপা হয়েছিল, তাতে বলা হয়- ‘সাধারণে প্রকাশ লালন ফকির জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। কুষ্টিয়ার অধীন চাপড়া ভৌমিক-বংশীয়েরা তাদের জ্ঞাতি। তাহাদের কোন আত্মীয় জীবিত নাই। ইনি নাকি তীর্থগমনকালে পথে বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হন। মুমূর্ষু অবস্থায় একটি মুসলমানের দয়া ও আশ্রয়ে জীবনলাভ করিয়া ফকির হন। তাহার মুখে বসন্তরোগের দাগ বিদ্যমান ছিল।’ পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার ধর্মপাড়ার বাসিন্দা বসন্তকুমার পাল এককভাবে সারাজীবন ধরে লালনের জীবন ও রচনা সম্পর্কে বহুতর খোঁজখবর করেছেন। তার গবেষণালব্ধ তথ্যাবলি প্রথমে খণ্ডখণ্ডভাবে স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় এবং পরবর্তীতে ‘মহাত্মা লালন ফকির’ [১৯৫৫] নামে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে বসন্তকুমার পাল লালনকে অবিভক্ত নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত কুমারখালীর কাছাকাছি গড়াই নদীর ধারে ভাঁড়ারা (চাপড়া-ভাঁড়ারা) গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে জাত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পারিবারিক পদবি ছিল কর অথবা রায়। বাবার নাম মাধব এবং মায়ের নাম পদ্মাবতী। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন নামে অপর এক দরদি লোকসঙ্গীত সংগ্রাহকও বসন্তকুমার পালের এই মতকে সমর্থন করেন।

লালনের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের মতো তাঁর জীবিতকালেও সাঁইজী’র জাত পরিচয় নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল। ফকিরজী নিজেই এ উৎসাহকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সে সময়কালে যে বসন্তরোগ মানুষকে করতো প্রাণহীন শব, তা-ই লালনকে করেছিল জাতহীন মানব। তিনি লিখে গেছেন- ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে...।’ প্রশ্ন জাগে মৃত্যুর পর লালনের মৃতদেহের কী গতি হয়েছিল? শ্মশান না কবর? যদি লালন মৃত্যুর পূর্বে তার অনুসারীদের কোনো তথ্য দিয়ে যেতেন, তাহলে তাঁর মৃতদেহকে সে রূপেই অন্ত্যেষ্টি করা হবে। কিন্তু সাঁইজী এখানেও রহস্য রেখে গেছেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত সংখ্যায় পাক্ষিক ‘হিতকরী’ লিখেছে- ‘মৃত্যুকালে কোন সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাঁহার অন্তিমকার্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছুই লাগে নাই। ...তাঁহারই উপদেশ অনুসারে আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাঁহার সমাধি হইয়াছে। শ্রাদ্ধাদি কিছুই হইবে না। বাউল সম্প্রদায় লইয়া মহোৎসব হইবে, তাহার জন্য শিষ্যমণ্ডলী অর্থসংগ্রহ করিতেছে।’ মূলত লালন সাঁই ধর্ম-জাত-বর্ণের বিলোপ শেষে সাম্যের ভাবধারায় এক মহান মানবসমাজ সৃষ্টির স্বপ্নদ্রষ্টা। দৃঢ় সাহসে স্বপ্ন দেখেছেন তৎকালীন বর্ণবৈষম্যে বিভাজিত উপমহাদেশীয় সমাজ বাস্তবতায়। কাঠামোবদ্ধ বর্ণব্যবস্থার খাঁচায় বন্দি তাঁর অচিন পাখি গেয়েছে- ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে যেদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে...।’ সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন ফকির লালন নারী-পুরুষ বৈষম্য ভেদ করেও। সেই প্রতিকূল সময়েও তিনি সাহসের সাথে ‘ধর্মই পুরুষকে শ্রেষ্ঠ করেছে’- এই সত্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এই ভেদ দেখেই তাঁর গানে তীব্র প্রশ্নবাণ- ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান নারীর তরে কী হয় বিধান বামুন চিনে পৈতে প্রমাণ বামনী চিনে কী প্রকারে...।’ শেষে এ কথা বলা নিশ্চয়ই অযথার্থ হবে না- ফকির লালন সাঁই এক উচ্চমার্গীয় ভাবের অথচ গণমানুষের প্রাণের লোককবি ছিলেন, যিনি গানের মধ্য দিয়ে এক যথার্থ মানবমুক্তির দর্শন বিস্তার করে দিয়ে গেছেন এই বাংলার জনপদ থেকে জনপদে। তাবৎ দুনিয়ায় যারা মানুষের চূড়ান্ত মুক্তির জন্য লড়ছেন, শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরন্তর রত রয়েছেন, তাদের মত ও পথের সাথে লালনজী’র মত ও পথের ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তথা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে মার্কসীয় মানবমুক্তির লড়াইয়ে লালন নিশ্চয়ই সহায়ক স্রোত। লালনের গানে যে মানবমুক্তির মন্ত্র আছে, তান্ত্রিকতার এই দেশে তাকে আশ্রয় করে সমাজতন্ত্রীদের মন্ত্র পৌঁছানো যেতে পারে মানুষের প্রাণে সহজেই। তাতে অন্তত মার্কসীয় গ্রন্থগত দুর্বোধ্য ভাষা থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণের প্রাণে পৌঁছানো যাবে সহজেই। লালন এই ভূমে সমাজতন্ত্রীদের সহযোদ্ধা হোন। লালন সাঁইজীর ১২৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে অপার শ্রদ্ধা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App