×

সাময়িকী

বিবর্ণ স্বপ্নের বেলাভূমি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:৩৭ পিএম

বিবর্ণ স্বপ্নের বেলাভূমি
একা একা উদাস চোখে কাজল শরতের ঝলমলে আকাশ দেখছে অনেকক্ষণ। কোথাও খণ্ড খণ্ড পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ। বিষণ্নতার অতলে তলিয়ে নিজের জীবনের অসহায়ত্ব মেলাতে অন্তহীন ভাবনায় বারবার ফিরে যায় অতীত পানে। শুধুই মনে হচ্ছে তার জীবন ভাসমান মেঘের আকাশের নীল জমিনে ভাসছে শুধুই ভাসছে। সময়ের স্রোতে দিন, মাস, বছর আবর্তিত হচ্ছে জাগতিক নিয়মে। এভাবে বয়ে চলে সময়। কাজলের মনে হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত গভীর শূন্যতায় ভরা। প্রচণ্ড আত্মক্ষরণ নিয়ে যাপিত জীবনের স্রোতের ভেলায় ভেসে চলেছে। প্রতিটি প্রহর কাটে নির্ঘুম। কাজল স্বপ্ন হারিয়ে এখন নিঃসঙ্গ বেদনায় তাকিয়ে আছে অসীমের পানে। গতিহীন, নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণ অর্থহীন মনে করে কাজল শূন্যতায় নিজের অস্তিত্ব খোঁজে। অনন্ত শূন্যতার মধ্যে তার জীবন যেন গতিহীন, অস্তিত্বহীন থেমে আছে। কখনো ভাবে একদিন পরপারের ডাক আসবে। যেখানে তাকে ছুঁতে পারবে না সংসারের যাতনা। যেখানে স্বপ্নগুলো তাকে আবার অন্তিম যাত্রা থেকে ফিরিয়ে আনবে না। যেখানে জীবনের সব কোলাহলের অবসান হবে নিঃসীম শূন্যতায়। বন্ধু অরূপ পাশে বসে পর্যবেক্ষণ করছে কাজলের উদাসীনতা। অরূপের ডাকে কাজল সম্বিৎ ফিরে পায়। অরূপ কাজলকে জিজ্ঞেস করে- কি এতো ভাবছিস বল তো? কাজল বলে ওঠে আমার আর ভাবনা! আমার ভাবনার আষ্টেপিষ্ঠে আমি অনুক্ষণ জড়িয়ে আছি। অরূপ বলে- এতো হেঁয়ালি করে বলছিস কেন? তোর ভেতরে কি চলছে একটু খুলে বলবি? কাজল অস্ফুট স্বরে বলে- তোর কি শোনার সময় হবে আমার জীবনের অদেখা ভুবনের না বলা কথা? অরূপ মাথা নেড়ে জবাব দেয় সে শুনতে চায়। অরূপকে কাজল তার জীবনের টানাপড়েনের কথাগুলো প্রকাশ করছিল অতি সঙ্গোপনে। কাজল অজ পাড়াগাঁয়ে বেড়ে উঠেছে নানা অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। পড়াশোনা মাস্টার্স পর্যন্ত। ছেলের মেধা দেখে মা-বাবা ভেবেছিল ছেলে প্রকৌশল শিক্ষায় বা চিকিৎসা শিক্ষায় গড়ে তুলবে। কিন্তু মাস্টার্স পাস করার পর কাজল আর লেখাপড়ায় অগ্রসর হতে পারেনি। বাল্যের কিছু স্মৃতিগুলো এখনো অমলিন হয়ে আছে আমার যদিও আমি ধ্রুব জানি, সেসবই স্বপ্ন। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এক অপরূপ ও অনন্য নৈসর্গিক পরিবেশে গ্রামখানা ঠিক ছবির মতো। প্রকৃতি অপার মহিমায় সাজিয়েছে পাহাড় আর সমতলের গ্রামীণ জনপদের জীবনযাত্রা। গ্রামের মাটির ঘরে লণ্ঠনের আলোয় পড়াশোনা, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় হাডুডু ও নানা ধরনের গ্রামীণ খেলায় মাতোয়ারা হওয়ার উন্মাদনা তো এখন অতীতের ডায়েরির পাতায় লেখা স্মৃতি। বাড়ির প্রশস্ত উঠোনজুড়ে চাঁদনী রাতের পেলবতায় লুকোচুরি খেলার সেই দুরন্ত সময় কি আর ফিরবে জীবনে। এখন আর সেই প্রশস্ত উঠোন নেই। উঠোনজুড়ে আর্থিক সচ্ছলতার জোরে প্রতিযোগিতা দিয়ে উঠেছে পাকা দালান। আগের সেই আত্মিক বন্ধন আর নেই। সামান্য জায়গার জন্য হাপিত্যেশ করে। নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখার প্রবণতা লক্ষণীয়। কদাচিৎ কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে গ্রামে গেলে মনে হয় আমার সেই ছবির মতন আগের সেই গ্রাম নয়। এ যেন শহরের কোনো গ্রাম। নেই আগের সেই হৃদ্যতা, নেই সেই স্নেহ মায়ার বন্ধন। যে যার মতো। মা-বাবাকে হারিয়েছি অনেক বছর। তারপরও সেই আগের দিনগুলোর কথা ভেবেই গ্রামে ছুটে যাই। গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরেফিরে বেড়ানোর কথা মনে পড়ে। গ্রামের কাছেই বড় দিঘির অতল জলে সহপাঠীদের নিয়ে সাঁতরানো, পদ্ম ফুল তুলে আনার স্মৃতিগুলো এখনো রোমাঞ্চিত করে। সহপাঠীদের সাথে স্কুলে যাওয়ার সেই আনন্দময় শৈশব কৈশোরের দিনগুলো এখনো স্মৃতিতে সতেজ। কৈশোরের কিছু স্মৃতিও আছে। সেসবই স্পষ্ট। সামান্য স্বপ্নেরও ছোঁয়া যেখানে পাই। সব ধরা যায় যেন, মিলিয়ে নেয়া যায়। সময়, স্থানসহ। শৈশবের সেই যুদ্ধদিনের স্মৃতিগুলো এখনো স্মরণে আছে। এখনো অম্লান। গ্রামে পার্শ্ববর্তী হিন্দুদের আশ্রয় গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা, পাকিস্তানি সেনাদের নিপীড়ন, পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের নির্দেশে অসংখ্য নিরীহ হিন্দু জনগণকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা ইত্যাদি এখনো মনে আছে। যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে যাওয়া এবং একটা পুকুরপাড়ের ধারঘেঁষে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সাথে থাকা বড় ভাইদের সাথে আশ্রয় নেয়া এখনো মনের কোণে জ্বলজ্বল করছে। সেই স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। পড়াশোনার জন্য শহরে আত্মীয়ের বাসায় থেকেছি। মাস্টার্স পাস করার পর বহুদিন চাকরির জন্যে চেষ্টা করেছি। পরে একটি বেসরকারি উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানে এক্সিকিউটিভের কাজ পেয়েছি স্বল্প বেতনে। স্বপ্ন ছিল অনেক বড় পদমর্যাদার চাকরি করব। অনেক আত্মীয় পাশে থাকার অভিনয় করেছে এবং প্রলোভিত করেছে। কিন্তু সেটা ছিল নিছক তাদের স্বার্থসিদ্ধির কূটকৌশল। সরলতার জন্য বারবার ধোঁকা খেয়েছি। ঠকেছি বহুবার। স্বপ্ন ছিল একদিন অনেক বড় হবো। মা-বাবার স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবো। বন্ধুর পথ অতিক্রম করেছি আত্মপ্রত্যয়ে। জীবনের পথ মসৃণ নয় জানি। অমসৃণ জীবনের পথ ধরে অবিশ্রান্ত ছুটছি। কাজল এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামল। অরূপকে বললো আমার জীবনের কথা অন্য একদিন শুনবিক্ষণ। অরূপ বললো- তোর কথা আমি শুনতে চাই। কিন্তু তাদের কথা আর এগোয় না। কাজল তার কথা অরূপকে আরেকদিন শোনানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয়। কাজল ধীর পায়ে এগিয়ে চলে তার বাসার দিকে। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কাজল ভাবনার অতলান্তে নিজেকে সমর্পণ করেছে এবং একান্তে ভেবেই চলেছে। গ্রাম থেকে উঠে আসা ভাগ্যান্বেষী যুবক কাজলের চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। দুপায়ে আগাছা মাড়িয়ে তাকে পথ চলতে হয়েছে। বেকার জীবন কতটা দুঃসহ তার চেয়ে আর কে ভালো জানে। কী করেনি সে। টিউশনি করেছে। একটা ভালো চাকরি পাওয়ার আশায় আত্মীয়ের বাসায় শ্রম দিয়েছে। এমএ পাস করলেই বুঝি ভাগ্যের সোনালি সিঁড়ি ধরা দেবে তার কাছে। আত্মীয়ের আশ্বাসে অপেক্ষা করেছে ভালো একটা চাকরির জন্য। আজ, কাল, পরশু। অনেক আশার বাণী। না। তা হয়নি। তাকে আবার পথে নামতে হয়েছে। কাজল বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখছে জীবনযুদ্ধে কেউ কেউ সহজেই বিজয়ের সিঁড়ি পেয়ে উপরে উঠে যায়। যেন বিজয় বড়ই নিরুদ্বিগ্ন। সহজলভ্য। অনায়াসে মিলে যায় সব। আবার কারো কারো জীবনে বিজয় বড়ই দুর্লভ। তারা চড়াই-উৎরাই ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত-বিষণ্ন হয়ে দিনের আলোতে ও পথ হাতড়ে ফেরে। আবার কেউ কেউ হোঁচট খেতে খেতে বুক দিয়ে পাহাড় ঠেলে ঠেলে সামনের বাধা পেরোয়। সে এক কঠিন অসম যুদ্ধ। সে যুদ্ধে পথ অতিক্রম করতে কত জন পথেই নিঃশেষ হয়ে যায়। শেষ দাগ ছুঁতে পারে কেউ কেউ। কাজল হতাশার বেদনায় কাতর হলেও এখনো তার মনের জোর এতটুকু কমেনি। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে একটু একটু করে নিজেকে টেনে তুলেছে ওপরে। অনেক ওপরে। যাকে বলে প্রতিষ্ঠার কাছাকাছি। কাজল এখন একটা করপোরেট অফিসের বড়কর্তা। এভাবে ভাবনার মধ্যে কখন যে বাসার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে খেয়ালই করেনি কাজল। কলিংবেল চাপতেই দরজার ওপার থেকে কে বলে হাঁক দেয় তার হোমমেকার প্রিয়তমা স্ত্রী হৃদিতা। দরজা খুলেই প্রশ্নের তীর ছোড়ে হৃদিতা উত্তরের অপেক্ষায়। কাজল একটু হেসে বললো গিয়েছিলাম শ্বশুরবাড়ি। হলো তো। হৃদিতা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বললো তাই বুঝি? মশাই আমার জানা আছে আপনি কোথায় যেতে পারেন। কাজল বললো আমাকে কি ঘরের বাইরে দাঁড় করিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করবে? হৃদিতা একটা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে প্রিয়তম স্বামীকে ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলো। বারো তেরো বছরের হৃদিতাকে সেই কবে হৃদয়ের অলিন্দে প্রেয়সীর স্থান দিয়েছিল কাজল। কাজল ভাবতেই নস্টালজিক হয়ে যায়। স্বল্পভাষী লাজুক হৃদিতা আজ তার ঘরণী। দূরের ভালোবাসা তাদের দুজনকে এক করে দিয়েছে। গ্রামের মেঠোপথে কখনো দেখা হলেই ডাকতো ডার্লিং বলে। কিন্তু কাজলের ভালোবাসা কখনো প্রকাশ্যে হৃদিতাকে প্রকাশ করেনি। বহুদিন অপেক্ষার পর তাদের জীবনের পথ এক হয়ে গেছে। কাজল ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে চায়ের জন্য অপেক্ষমাণ। কিছুক্ষণ পর চা আর নাস্তা হাতে হৃদিতা এলো। কাজল চা নাস্তার দিকে না দেখে শুধুই হৃদিতাকে দেখছে। হৃদিতাকে আজ কাজলের আরো বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছে। হৃদিতা উপলব্ধি করতে পারলো কাজলের হাবভাব। হৃদিতা দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো বুড়ো বয়সে আবার কি হলো? এ বয়সে এখনো প্রেম করার ইচ্ছে জাগে? এভাবেই নানা খুনসুটিতে জীবনের পথ এতো বছর পেরিয়ে গেছে হৃদিতা-কাজল। হৃদিতা কাজলকে বলে এইতো সেদিন আমাদের দুজনার পথ মিশেছিল এক মোহনায়। ইচ্ছেডানায় ভর করেই স্বপ্ন উড়ানে এক সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলাম। স্বপ্নের আনাগোনা ছিল জীবন ঘিরে। দুজনের দীর্ঘ বাসনার জগত জুড়ে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে আমাদের সন্তানরা। স্বপ্নেরা ছুটছে ক্লান্তিহীন। কাজল মনোযোগ দিয়ে হৃদিতার কথা শুনছে। তবে নিরুত্তর। কাজলের ভাবনায় হতাশা নৈরাশ্যের নীল যন্ত্রণা। কিন্তু প্রকাশ করে না তার অন্তর্ভেদী কষ্টের কথামালা। ইদানীং হৃদিতা কাজলের পরিবর্তন লক্ষ করছে। হৃদিতা বললো কি হলো তোমার আজকাল? বাসায় আসলে ঠিকভাবে কোনো কথা বলো না। চুপচাপ থাক। কি অজানা বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছ? যা আমাকেও বলা যায় না। কাজল বরাবরই চাপা স্বভাবের। তবে হৃদিতার কাছে তার জীবনের ঘটে যাওয়া কথা অকপটে প্রকাশ করেছে। নীরবতা ভেঙে কাজল বললো তুমি তো আমার জীবনের সাথে জড়িয়েই আছো। আমার সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, বেদনা বিষণ্নতা সবই তো তোমার জানা। আর কি জানতে চাও? জীবনের গতি থেমে যাবার কালে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু আমাদের স্বপ্নগুলোর কি হবে? মনে হয় জীবন যুদ্ধে আমি এক পরাজিত সৈনিক। হার মেনেই নিশ্চল, স্থবির পাথরখণ্ড। কেন এতো ভাবছো বলতো? হৃদিতার প্রশ্ন। ভাবনা তো আছেই। ভাবতে হবে আমাদের সন্তানদের জন্য। কাজল বিমর্ষভাবে বলে। ভাবনার কি আছে। তুমি আমি ওদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার জন্য আছি তো। হৃদিতার নির্ভেজাল উত্তর। কাজল বলে কতকাল আমরা ওদের জন্য বেঁচে থাকব? অর্থের প্রাচুর্য নেই, আমাদের অবর্তমানে কে তাদের পথ দেখাবে? তুমি এতো চিন্তা করো না। ওদের পথ ওরা করে নেবে। হৃদিতা কাজলকে আশার কথা বলে। তুমি এত হতাশায় ভুগছো কেন? তুমি অনেক বাধা ডিঙিয়ে এ পর্যন্ত এসেছো। তুমি কখনো এভাবে হতাশায় ভেঙে পড়োনি। তোমার যা মেধা, মনন, শিক্ষা, যোগ্যতা আছে তা দিয়ে তুমি সততার সাথে যেটুকু অর্জন করেছো তা কম কিসে। কাজল ক্ষোভ প্রকাশ করার তীব্রতায় বলতে লাগলো আমার কাছে জগতের সবকিছুই গোলমেলে লাগছে। ব্যাক বেঞ্চাররা এখন শীর্ষে অবস্থান করছে। মেধার কোনো মূল্যায়ন নেই। যে কোনোভাবেই অর্থ প্রাচুর্যের মালিক হলেই সমাজে তার কদর বেশি, তাকে সম্মানিত করা হয়, তাকে নিয়ে সমাজের মানুষের মাতামাতি। এ ধরনের সামাজিক উন্মাদনা আর কতকাল চলবে? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কাজল থামল। একটু মৃদু উত্তেজিত ভাব বিরাজ করছে কাজলের মুখাবয়বে। হৃদিতা অনুভব করলো কাজলের বেদনা, হতাশার উৎস। হৃদিতা আর কথা না বাড়িয়ে সন্তানদের সামলাতে অন্য রুমে চলে গেল। ভোরের সূর্য তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পুবাকাশে। কাজল খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। শরতের গাঢ় নীল আকাশজুড়ে নীল নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে আছে। কাজলের নিত্যদিনের রুটিন কাজ প্রাতঃকাজ সেরে প্রার্থনায় নিজেকে সমর্পণ করা। তারপর প্রাতঃরাশ করে অফিস অভিমুখে যাত্রা। অফিসে যাবার সময় হৃদিতাকে বলে গেল অফিসে কিছু জরুরি মিটিং আছে। ফিরতে দেরি হবে। অফিসে পৌঁছেই কাজে মগ্ন হয়ে গেল কাজল। কাজের ফাঁকে সহকর্মীদের সাথে আলাপনও চলে। সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়। করপোরেট অফিসের বড়কর্তা হিসেবে দায়িত্ব বেশি বিধায় নিজের মজ্জাগত যে ইচ্ছা আছে তার বদৌলতে দক্ষতার সাথে সমস্ত কাজ স¤পাদনের টেকনিকটাও তার কাছে রপ্ত। সবার সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে টিমওয়ার্কের মাধ্যমে সহকর্মীদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে কাজলের কষ্ট হয় না। অফিসের জরুরি মিটিং এবং ক্লায়েন্টদের সাথে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে অফিস থেকে কাজলের বেরোতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। অফিস থেকে বেরোনোর সময় মুঠোফোনে একটা কল আসে। ফোন করেছে তার এক নিকটাত্মীয়। জরুরিভাবে আত্মীয়ের বাসায় যেতে হবে। কি আর করা। নিরুপায় হয়ে আত্মীয়ের বাসা অভিমুখে যাত্রা করলো। ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিলো কোথায় যেতে হবে। পথিমধ্যে হৃদিতাকে ফোনে বলে দিলো আত্মীয়ের বাসায় যেতে হচ্ছে জরুরিভাবে। আত্মীয়ের পারিবারিক ঝামেলা মেটানোর জন্য তাকে ডাকা হয়েছিল। আত্মীয়ের বাসা থেকে ফিরতে অনেক রাত হলো। একেবারে ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত। বাসায় ফিরে হৃদিতার মৃদু বকুনি শুনলো। নিজের সমস্যার সমাধান করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে, আবার অন্যের সমস্যার সমাধান করতে তৎপর। কাজলের উত্তর- কি করবো বলতে পারো। স্বার্থপরতা স্বভাবটা আমার নেই। আমিও অন্যের বিপদে চোখ বুজে থাকতে পারিনে। এটা বলতে পারো আমার মানস জগতের সৎচেতনা। পরের দিন শুক্রবার। বিকেল চারটায় শিল্পকলায় একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেবে কাজল। কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মীদের সাথে একটা সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলেছে কাজল। লেখালেখিতে যুক্ত আছে। তবে নিভৃতচারী। নিজেকে সবার কাছে সেভাবে প্রকাশ করতে পারে না। একটা সংকোচবোধে নিজেকে লুকিয়ে রাখে সর্বক্ষণ। তারপরও বন্ধুদের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার সাহস তার নেই। বাসায় ছুটির দিনে দুপুর পর্যন্ত হৃদিতাকে সময় দিলো। নানা কাজে হৃদিতাকে সাহায্য করলো। সময়ের আগে শিল্পকলায় উপস্থিত হলো। লেখক বন্ধুদের সাথে, অগ্রজ লেখকদের সাথে ভাববিনিময় করে অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য অপেক্ষমাণ। বন্ধু অরূপকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় সামনে এসে বসতে বললো। অরূপ পাশে এসে বসলো। অনুষ্ঠান উপভোগ করলো। অনুষ্ঠান শেষ করে অরূপ কাজলকে নিয়ে বেরুলো। অরূপ ড্রাইভ করছিল। কাজল জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছো ভাই? অরূপ বলে নিরুদ্দেশ যাত্রা। কাজল বলে হেঁয়ালি করছো কেন। অরূপ বলে দেখো না কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। গাড়ি তখন এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। বোট ক্লাবে গিয়ে থামল। কাজল জিজ্ঞেস করে কী কারণে আসা। অরূপ বলে দেখো না তোমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। অরূপ ও কাজল হলের ভেতর প্রবেশ করতেই সব চেনা জানা মুখের স্নিগ্ধ হাসিমাখা অভ্যর্থনা পেল। কয়েকজন বন্ধু তো এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। কাজল আশ্চর্য হলো। অরূপ বললো বন্ধু এটা তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ। আজ জবরদস্ত আড্ডা হবে। বলতে বলতেই শুরু হয়ে গেল আড্ডা। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে আড্ডা সীমাবদ্ধ নেই। আড্ডায় কবিতা, ছড়া, গান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, মানবিকতা, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমকালীন ভাবনা আলোচনায় এসেছে। একেকজনের চুলচেরা বিশ্লেষণ একেক রকম। আবার কখনো বিতর্ক, কখনো হাসিঠাট্টার হুল্লোড়। আবার কখনো বেদনার কথন। আবার কখনো জীবনঘনিষ্ঠ বাক্যালাপ। আড্ডায় চলছে খাওয়া দাওয়া। কখন যে মনের খেয়ালে কাজল আড্ডায় নিজেকে সমর্পণ করেছে সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। কাজল সমাজ চিন্তকের মতো তার নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করেছে। সমাজকে যে অন্ধত্বের কাল ক্রমশ গ্রাস করছে কাজল পয়েন্ট আউট করছে। সমাজ অবক্ষয়, কৈশোরের স্খলন, যুবাদের তারুণ্যে হতাশা, নেশার কালো আঁধারের চোরাগলিতে ভেসে যাওয়া, নারীর সম্ভ্রমহানির নির্মমতা, হত্যা, লুণ্ঠন, অমানবিক আক্রোশে উন্মত্ততা, ক্যাসিনো সংস্কৃতিতে ডুবে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, ধনিক শ্রেণির সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার দুর্দমনীয় প্রতিযোগিতা, লুটেরাদের আধিপত্য বিস্তারের কথন ক্ষোভের উৎস মুখে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো নিঃসৃত হয়েছে কাজলের স্বরধ্বনিতে। আড্ডায় যারা তার সাথে ছিল তারা তো হতবাক। অরূপ কাজলকে বলল কী হয়েছে বন্ধু তোমার। এতো কিছু তুমি এক নিশ্বাসে বলে দিলে! কাজল একটু অপ্রস্তুত হলো। সে তো এতোটা দাপুটে কথা কখনো উচ্চারণ করেনি। স্বভাবে একজন সাদামনের মানুষ। সবাই তাকে বাহবা দিলো। বন্ধুদের অনেকে বললো তুমি তো পত্রিকায় লেখালেখি কর। এসব নিয়ে লেখ। কাজল বললো লিখছি ভাইয়া। তারপরও তো মানুষের শুভবোধের উদয় হয় না। আড্ডা চলেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু কাজলের মনটা কিছুটা অশান্ত হয়ে পড়েছে। অরূপকে কাজল একরকম জোর করে ক্লাব থেকে বাইরে নিয়ে আসলো। অরূপ কাজলকে বোঝে। আজকাল কাজলের মনের মধ্যে যে দহনের চাপা আগুন জ্বলছে অরূপ বেশ উপলব্ধি করছে। তাই অরূপ মাঝেমধ্যে কাজলকে নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। কাজলের মনের চাপটা কমাতে চায়। তারা ঘরে ফেরার জন্য রওনা দিলো। গাড়িতে বেশ চুপচাপ কাজল। কিন্তু মনের মাঝে দহন বেলার গানে হারিয়ে যায়। ছোটবেলায় কাজলের মনে হতো আকাশটা অনেক দূরে! কত দূরে...? হোক না সে দূরে... বহু দূরে। তবু যাদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন থাকে তারা একদিন না একদিন ঠিকই ছুঁয়ে ফেলতে পারে ওই স্বপ্নের আকাশটাকে। ছোট্ট কাজলের ছোট্ট স্বপ্নের একটা জগত ছিল। ছিল স্বপ্নের রঙিন বেলাভূমি। কিন্তু কাজলের স্বপ্নগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে মধ্য গগনে। উদ্দেশ্যহীন পথের বাঁকে স্বপ্নগুলো মিছিল করে। কাজল ভাবছে অনন্ত অজানা দূরের কোনো বেলাভূমিতে হয়তো সে স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে যাবে একদিন। সব শূন্যতায় মিশে যাবে। চলে যাবার ভেলায় একদিন সবাই চলে যাবে। ব্যস্ত হওয়ার মেলায় সবাই একদিন নিঃসঙ্গ হবে। জীবনের খেলাঘরে ভালোবাসার স্বপ্ন বিবর্ণ হবে। ধূসর কবিতার প্রতিটা ছত্রে লেখা হবে বিবর্ণ স্বপ্নের অপ্রাপ্তিগুলো। তবুও জোছনাস্নাত রাতে আনমনা মন খুঁজবে প্রিয় মুখগুলো। নিঃসীম দিগন্তে বিবর্ণ স্বপ্নের বেলাভূমিতে প্রহর গুনবে আমৃত্যু একাকী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App